ব্রাজিলের খেলায় চোখে পড়ল যে পাঁচ বিষয়

কী দুর্দান্ত খেলল ব্রাজিল!ছবি : রয়টার্স

ম্যাচের ৮৫ মিনিট শেষ ততক্ষণে। ব্রাজিল ৫-০ গোলে এগিয়ে। পাঁচ মিনিট পরই সহজ এক জয়ের আনন্দে মাতবেন নেইমাররা। এমন সময় হঠাৎ ডাগআউট থেকে কোচ তিতের চিৎকার শোনা গেল।

‘সামনে যাও, আরও সামনে যাও। আক্রমণ করতে থাক। আমি আরও বেশি গোল চাই!’

তিতের কথাতেই যেন পরিষ্কার হয়ে গেল, এই ব্রাজিল জয় নিশ্চিত করে বসে থাকার মতো দল নয়। কত দলই তো ম্যাচে এগিয়ে থাকার পর বাড়তি আক্রমণ না করে বাকি সময় বসে থাকে, খামোখা আক্রমণ করতে গিয়ে উটকো ঝুঁকি নিতে চায় না। এই ব্রাজিল ওই দলে পড়ে না। এ দল মানেই আক্রমণ, আক্রমণ আর আক্রমণ। পাঁচ গোলে এগিয়ে থেকে জয় নিশ্চিত হওয়ার পরেও মুহুর্মুহু আক্রমণে বিদ্ধ করল লাতিন-প্রতিবেশীদের। সেই আক্রমণের আগুনেই বলিভিয়া ছারখার হয়ে গেল আজ সকালে। আর তাতেই ব্রাজিলের বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের শুরুটা হলো মনে রাখার মতো।

একের পর এক আক্রমণের মালা গাঁথা এই ম্যাচ থেকে নেইমারদের প্রাপ্তি আছে অনেক। বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও চোখে পড়েছে। দেখে নেওয়া যাক এমন পাঁচটি বিষয়!

বাঁধন-হারা নেইমার

দলের সবচেয়ে ভালো, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়টিকে ‘ফ্রি রোল’ দেওয়ার প্রথা আজকের নয়। দলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়টা যেন নিজেকে পরিপূর্ণভাবে মাঠে ফুটিয়ে তুলতে পারেন, এ জন্য অনেক সময় কোচেরা তাঁদের ওপর বাড়তি ছকনির্ভর দায়িত্ব চাপিয়ে দেন না। আর্জেন্টিনায় যেমন লিওনেল মেসি, পর্তুগালে যেমন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, ব্রাজিলে ঠিক তেমনই হলেন নেইমার। আর কোনো ধরনের বাড়তি চিন্তা ছাড়া নেইমারের মতো খেলোয়াড়কে ‘যা ইচ্ছে তাই’ করার সুবিধা দিলে তিনি যে কী কী করতে পারেন, হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে বলিভিয়া। কাগজে কলমে নেইমারকে দেওয়া হয়েছিল বাঁ দিকের উইং সামলানোর দায়িত্ব। কিন্তু নেইমারকে কি আর শুধু এক জায়গায় আটকে রাখা যায়? গোটা ম্যাচ মৌমাছির মতো ছুটে বেড়ালেন সবচেয়ে বড় তারকা, সময়-সুযোগ মতো হুল ফোটালেন বলিভিয়ান রক্ষণভাগের এখানে-সেখানে। মুহূর্তের মধ্যে এমনভাবে রক্ষণভাগের ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতম ছিদ্র বের করলেন, দেখলে হাঁ হয়ে যেতে হয়। গত কয়েক মাস যেসব বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন, প্রত্যেকটার জবাব যেন ধরে ধরে দিতে চাইলেন বল পায়ে। দেখিয়ে দিলেন, ২০২২ বিশ্বকাপে ‘হেক্সা মিশন’ সফল করার জন্য তিনিই হবেন ব্রাজিলের মূল তুরুপের তাস। অন্য কেউ নন।

নেইমারকে আটকানোর সাধ্য ছিল না বলিভিয়ার।
ছবি: রয়টার্স

ফুলব্যাকদের স্বাধীনতা

কাগজে-কলমে ব্রাজিল নেমেছিল ৪-৩-৩ ছকে। ছক এমন হলেও আসলে মাঠে অধিকাংশ সময়ে সেটা হয়ে যাচ্ছিল ৪-২-৩-১। ৪-২-৩-১ ছকে নামা ব্রাজিলের গোলবারে ছিলেন না আলিসন, এদেরসনদের কেউ। সে জায়গায় নেমেছিলেন পালমেইরাসের ওয়েভারতন। সামনে সেন্ট্রাল ডিফেন্সে থিয়াগো সিলভা-মার্কিনিওসের জুটি, দুই ফুলব্যাক হিসেবে আতলেতিকো মাদ্রিদের রেনান লোদি (বাম) ও জুভেন্টাসের দানিলো (ডান)।

দুই রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডার হিসেবে খেলে ওপরে থাকা চারজনকে আক্রমণ করার পূর্ণ লাইসেন্স দিয়েছিলেন অ্যাস্টন ভিলার তরুণ মিডফিল্ডার দগলাস লুইজ ও রিয়াল মাদ্রিদের কাসেমিরো। সবার ওপরে ফিরমিনো, পেছনে কুতিনিও, বাঁয়ে নেইমার, ডানে সদ্য গ্রেমিও থেকে বেনফিকায় যোগ দেওয়া উইঙ্গার এভারতন সোয়ারেস।

৪-২-৩-১ ছক দিয়ে যদি আপনি আক্রমণ করতে চান, তবে সে ক্ষেত্রে একদম প্রাথমিক নিয়ম হলো, দুই ফুলব্যাক ওপরে উঠে যাবে। ফলে ছক হয়ে যাবে ২-৩-৫ কিংবা ৩-২-৫। ৪-২-৩-১ ছক দিয়ে আক্রমণ করার একদম সহজতর কথাই এটা। তিতে এই কাজটাই ক্রমাগত করিয়েছেন দুই ফুলব্যাক দিয়ে। সঙ্গে বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সেরা কোচ ম্যানচেস্টার সিটির পেপ গার্দিওলার একটা কৌশল যুক্ত করে দিয়েছিলেন। বায়ার্ন মিউনিখের কোচ হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত গার্দিওলা তাঁর দলের যেকোনো একজন ফুলব্যাককে আক্রমণের সময় যেকোনো একজন মিডফিল্ডারের সঙ্গী হয়ে ‘ছদ্ম মিডফিল্ডার’ হয়ে যেতে বলেন। এই ম্যাচে দানিলোর মধ্যে এই বিষয়টা দেখা গিয়েছে। ফলে ব্রাজিলের পায়ে যখনই বল ছিল, ওপরে থাকা চারজনের (ফিরমিনো, নেইমার, এভারতন, কুতিনিও) সঙ্গে যোগ দিয়েছেন লেফটব্যাক রেনান লোদি। ফলে দুটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে -

  • দুই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের মধ্যে যেকোনো একজন (অধিকাংশ সময়ে কাসেমিরো) ছদ্ম-সেন্টারব্যাক হয়ে ঢুকে গেছেন দুই সেন্টারব্যাক থিয়াগো সিলভা-মার্কিনিওসের মাঝখানে। বাকি একজন পালন করেছেন ‘বক্স-টু-বক্স’ মিডফিল্ডারের ভূমিকা (অধিকাংশ সময়ে লুইজ), যার কাজ ছিল সমানতালে ওপর-নিচ করতে করতে রক্ষণ ও আক্রমণের মাঝে ক্রমাগত সংযোগ স্থাপন করা। রাইটব্যাক দানিলো একটু উঠে উক্ত ‘বক্স-টু-বক্স’ মিডফিল্ডারের সঙ্গে জুটি বেঁধেছেন মাঝমাঠে (৩-২-৫ এর ক্ষেত্রে)।

  • দুই সেন্টারব্যাককে পেছনে রেখে রাইটব্যাক দানিলো একটু ওপরে উঠে দুই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। ওপরে থেকেছেন বাকি পাঁচজন (২-৩-৫ এর ক্ষেত্রে)।

আক্রমণের সময়ে ৪-২-৩-১ এর এই রূপান্তরিত সংস্করণটার অসাধারণ বিজ্ঞাপন দেখিয়েছে আজ ব্রাজিল।

লেফটব্যাক হিসেবে লোদির খেলা চোখে পড়েছে।
ছবি: রয়টার্স

লোদি বোঝালেন, দরকার নেই মার্সেলোর
ম্যাচে দারুণ নজর কেড়েছে রেনান লোদির খেলা। লেফট উইঙে থাকা নেইমারের সঙ্গে তাঁর খেলা দেখে মনে হয়েছে, দুজন দুজনকে কত যুগ ধরেই-না চেনেন! মনে হয়েছে, দুজনের মধ্যে যেন ‘টেলিপ্যাথিক’ সংযোগ আছে কোনো। একজন আরেকজনের অবস্থান না দেখেই বুঝতে পারছিলেন অপরজন মাঠের কোথায় থাকবেন। নেইমার বাম উইং থেকে প্রায়ই ভেতরে ঢুকে যাচ্ছিলেন, তখন আদর্শ আক্রমণাত্মক লেফটব্যাকের মতো ওপরে জায়গা ফাঁকা পেয়ে উঠে গেছেন লোদি। রক্ষণেও ছিল পূর্ণ মনোযোগ, প্রতিপক্ষের সঙ্গে সাত ‘ডুয়েলের’ ছয়টাই জিতেছেন। তিন ম্যাচ খেলে তিনবার গোলে সহায়তা করলেন এই নিয়ে। লোদি এমন ফর্মে থাকলে, আগামী কোপা আমেরিকা বা বিশ্বকাপের জন্য মার্সেলোর অভাব অনুভূত হবে না ব্রাজিল শিবিরে।

মাঝমাঠের আরেক রত্ন

ব্রাজিলের মাঝমাঠে কার্যকরী খেলোয়াড়ের অভাব কখনই ছিল না, নেই এখনো। কাসেমিরো, ফাবিনিও, ফার্নান্দিনিওর পাশাপাশি এই ম্যাচে ব্রাজিল আরও একজন রত্নকে পেল, যার ওপর ভরসা রাখে যায়। দগলাস লুইজের বিচক্ষণতা, অবস্থানগত চাতুর্য ও জ্ঞান; কখন ওপরে যেতে হবে, কখন নামতে হবে—মুগ্ধ করেছে ব্রাজিল সমর্থকদের। ট্যাকল কিংবা বল কেড়ে নেওয়ার সময়েও যেমন তিনি ছিলেন, ছিলেন নেইমার-কুতিনিও-ফিরমিনোদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের সময়েও। অথচ আজই প্রথম ব্রাজিলের মূল একাদশে ছিলেন অ্যাস্টন ভিলার এই তরুণ! যতগুলো পাস দিয়েছেন, তার ৯৫% সফল। পাঁচ বার লম্বা পাস দিতে গিয়েছেন, পাঁচবারই সফল হয়েছেন। প্রতিপক্ষের আক্রমণ ভেঙে দেওয়া, বল কেড়ে নেওয়াতেই মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন। লেফটব্যাক লোদি যখনই উঠে যাচ্ছিলেন, বলিভিয়ার প্রতি আক্রমণে থিয়াগো সিলভা, মার্কিনিওসরা যেন একা হয়ে না পড়েন, এ জন্য নিচে নেমে গেছেন প্রায়ই।

নিজের পছন্দের জায়গায় পরিচিত কুতিনিও।
ছবি: রয়টার্স

পছন্দের জায়গায় কুতিনিওর ঝলক

গত কয়েক বছর ধরে ফিলিপ কুতিনিও সবাইকে বুঝিয়েছেন, উইঙ্গার কিংবা সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার হিসেবে নয়, কুতিনিও সবচেয়ে কার্যকরী খেলা তখনই দেন, যখন তিনি সেন্ট্রাল অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার বা ‘নাম্বার টেন’ ভূমিকায় খেলেন, স্ট্রাইকারের ঠিক পেছনে। তিতে সেটা বুঝেছেন। ওই জায়গাতেই খেলিয়েছেন বার্সা তারকাকে। আর কুতিনিও-ও ঝলক দেখিয়েছেন ইচ্ছেমতো।
সামনে পেরুর বিপক্ষে ম্যাচ। বুধবার সকালে। সে ম্যাচে নেইমাররা এই ফর্ম ধরে রাখলেই বোঝা যাবে, আসলেই এগিয়ে যাচ্ছে ব্রাজিল।