ভারত যেদিন নেমেছিল খালি পায়ে...

নিজেদের ইতিহাসের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলতে মাঠে নামছে ভারতীয় ফুটবল দল। ছবি: টুইটার
নিজেদের ইতিহাসের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলতে মাঠে নামছে ভারতীয় ফুটবল দল। ছবি: টুইটার
স্বাধীন ভারতের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ মাঠে গড়িয়েছিল কবে? আসুন ফিরে দেখি সেই সময়


ব্রিটেনের বাইরে সবচেয়ে পুরোনো স্বীকৃত ফুটবল টুর্নামেন্ট কোনটি?

প্রশ্নটির জবাব খুঁজতে যেতে হবে ভারতে। যেখানে ক্রিকেটই শেষ কথা। ক্রিকেটের প্রতি ভারতীয়দের অবুঝ প্রেমে চাপা পড়ে আছে আরেকটি উপাখ্যান—ফুটবলপ্রেম। সেই প্রেম এখন আই-লিগ আর আইএসএলের মাধ্যমে কিছুটা উন্মোচিত হলেও একসময় ভারতে ফুটবলই ছিল শেষ কথা। ১৩০ বছর আগে এখানেই শুরু হওয়া ডুরান্ড কাপকে ব্রিটেনের বাইরে সবচেয়ে পুরোনো ফুটবল টুর্নামেন্ট হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

ভারতীয়রা সে সময় ফুটবলকে গ্রহণ করেছিল খালি পায়ে। তত দিনে ফুটবলটা বাইরের বিশ্ব বুট পরেই খেলা শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু ভারতীয়রা বুট কেন পরত না? আর্থসামাজিক পরিস্থিতিই এর মূল কারণ। তখনকার ভারতীয় সমাজে জুতো পরার অভ্যাস খুব একটা ছিল না। ফুটবল-টুটবল যা-ই খেলা হতো, সেখানে জুতো পরার কথা ভাবার সুযোগ কোথায়? এ ছাড়া ব্রিটিশদের বুট পরার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বুট ছাড়া ফুটবল খেলার ব্যাপারে ভারতীয়দের একটা জেদও কাজ করত। ১৮৭৭ সালের সেপ্টেম্বরে গোরা ময়দানে ফুটবল খেলছিল ব্রিটিশ সৈন্যরা। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় খালি পায়ে বলটা লাথি মেরে সৈন্যদের ফিরিয়ে দিয়েছিলে নগেন্দ্র প্রসাদ সর্বাধিকারী। ধারণা করা হয়, ফুটবলে খালি পায়ে সেটাই কোনো ভারতীয়ের প্রথম কিক।

ভারতে ফুটবল খেলার ‘জনক’ হিসেবে খ্যাতি পাওয়া নগেন্দ্র প্রসাদ ১৮৮৫ সালে কলকাতায় গঠন করেছিলেন শোভাবাজার ক্লাব। কলকাতায় ফুটবল খেলার জনপ্রিয়তা পাওয়ার পেছনে এই ক্লাবটির ভূমিকা অপরিসীম। খালি পায়ে খেলা শুরুর অনুসন্ধানে এই ক্লাবের উদ্ধৃতি দিয়েছেন ক্রীড়া-সাংবাদিক রাখাল ভট্টাচার্য তাঁর ‘কলকাতার ফুটবল’ বইয়ে: ‘(শোভাবাজার ক্লাবে) ফুটবল খেলতে তাঁদের মনে বুটের কথা উদয় হলো না। শুধু পায়ে বল শুট করার, পায়ের আঙুল দিয়ে কৌশলে বল টেনে নেওয়ার এবং আলগা পায়ে তরতর করে দৌড়বার কায়দা রপ্ত করে ফুটবলকে তারা নতুন রূপ দিল।...নিজেদের মধ্যে দল ভাগ করে খেলে, অন্য পাড়ার ছেলেদের ডেকে এনে ম্যাচে নামায়। তোড়জোড়-হাঙ্গাম-হুজ্জোতের বালাই নেই; গায়ে গেঞ্জি বা শার্ট, পরে হাফপ্যান্ট বা হাঁটু তুলে এঁটে পরা ধুতি ও বল। দুটো বাঁশ পুঁতে দুমাথায় দড়ি বাঁধলেই গোল তৈরি হয়।’

তাই ধারণা করা হয়, আর্থসামাজিক ও সংস্কৃতিগত কারণ থেকেই ভারতে তখন খালি পায়ে ফুটবল খেলা হতো। সে যা–ই হোক, ১৮৮৮ সালে শুরু হওয়া ডুরান্ড কাপ ভারতে ফুটবলের জনপ্রিয়তায় দারুণ ভূমিকা রেখেছিল। এর ৫৯ বছর পর স্বাধীনতার মুখ দেখল ভারত। তত দিনে ভারতে ফুটবলের কাঠামোটা স্থায়ী। মোহনবাগান-ইস্ট বেঙ্গল দ্বৈরথ জমজমাট। অর্থাৎ জাতীয় দল গঠনের মতো রসদ পেয়ে গিয়েছিল ভারত। ১৯৪৮ লন্ডন অলিম্পিকে তাই নতুন পরিচয়ে খেলার সুযোগ পেল দেশটি। স্বাধীন দেশ হিসেবে এটাই ছিল ভারতের প্রথম আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্ট।

লন্ডন অলিম্পিকে খেলার জন্য আরও ২২টি দেশের মতো আবেদন করেছিল অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশন (এআইএফএফ)। এর মধ্যে নতুন ও খাটো শক্তির দলগুলোকে নিয়ে গঠন করা হয় প্রিলিমিনারি রাউন্ড। এই রাউন্ডে ভারতের খেলা পরেছিল সাবেক বার্মার (মিয়ানমার) বিপক্ষে। আরও চারটি দলের সঙ্গে তখনকার বার্মা নাম প্রত্যাহার করে নেওয়ায় সরাসরি মূল পর্বে খেলার সুযোগ পায় শৈলেন মান্না-তাজ মোহাম্মদদের ভারত। কোচ ছিলেন মোহনবাগানের সাবেক ডিফেন্ডার বলাইদাস চট্টোপাধ্যায়।

অলিম্পিকে অংশ নিতে ১৮ জন ফুটবলার নিয়ে লন্ডনগামী জাহাজে উঠেছিল ভারতীয় দল। তখনো ফিফা সদস্য ফি জমা দেয়নি এআইএফএফ। অলিম্পিক ফুটবলে অংশ নিতে পারবে কি না, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিল অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশন। কিন্তু ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের (এফএ) মধ্যস্থতায় ব্যাপারটি সুরাহা হওয়ায় আর কোনো সমস্যা হয়নি। মূল পর্বে মাঠে নামার আগে লন্ডনে পাঁচটি প্রস্তুতি ম্যাচ খেলেছিল ভারতীয় দল। এই পাঁচ ম্যাচে ৫ গোল হজমের বিপরীতে তাঁরা ৩৯ গোল করেছিল! আরও আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, ভারতের বেশির ভাগ ফুটবলারই খেলেছেন বুট ছাড়াই। বড়জোর অ্যাঙ্কলেট পরে, ফুটবলে সেটি আসলে খালি পা-ই বোঝায়।

এরপর চলে এল মূল পর্বের লড়াই। ইস্ট লন্ডনের ইলফোর্ড শহরে সেদিন রচিত হলো ইতিহাস। ফুটবলের ময়দানে ফ্রান্সের মুখোমুখি হলো সদ্য স্বাধীন দেশ ভারত। তালিমেরান আওয়ের নেতৃত্বে সেদিন মাঠে নামা ভারতীয় একাদশের আটজনই ছিলেন খালি পায়ের ফুটবলার। ক্রিকেটফিল্ড স্টেডিয়ামে সেদিন এক অভিনব লড়াই দেখার প্রহর গুনছিলেন দর্শকেরা। বুট পরা বনাম বুটহীন ফুটবলারদের লড়াই। অথচ দুই দলের ফরমেশন একই ছিল ২-৩-৫। প্রথমার্ধে রেঁনে কুরবিনের গোলে প্রত্যাশামতোই এগিয়ে গেল ফ্রান্স। কারণ, প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলতে নামা ভারত এই লড়াইয়ে স্বাভাবিকভাবেই ‘আন্ডারডগ’।

কিন্তু সবাইকে চমকে দিয়ে ৭০ মিনিটে সমতায় ফিরল ভারত। আহমেদ খান ও ভজরাভেলুর দুর্দান্ত ওয়ান-টু থেকে পাওয়া পাসে গোল করেন সরঙ্গপানি রমন। ভারত ম্যাচটা জিতেই যেত যদি দু-দুটি পেনাল্টি মিস না করত! প্রথমটি মিস করেন ভারতের কিংবদন্তি ফুটবলার শৈলেন মান্না। পরেরটি তিনি নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েও মিস করেছিলেন। এর খেসারত দিতে হয় নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার এক মিনিট আগে। ৮৯ মিনিটে রেঁনে পেরসিলনের গোলে ম্যাচটা জিতে নেয় ফ্রান্স। আর ভারতকে নিজেদের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচে হার মেনে নিতে হয়েছিল আজ, এই দিনে!