ভিনির গোলে, কোর্তোয়ার গ্লাভসে রিয়ালের ১৪তম মহাকাব্য

চ্যাম্পিয়নস লিগ তাদেরই টুর্নামেন্ট, ট্রফিটা নিয়ে রিয়াল মাদ্রিদের উল্লাসই আরেকবার দেখল ইউরোপছবি: রয়টার্স

স্কোরশিটে লেখা ইতিহাস বলবে, রাতটা ভিনিসিয়ুস জুনিয়রের। বলারই কথা, সেখানে শুধু গোলের সংখ্যা আর গোলদাতার নামই তো লেখা থাকে।

তবে ১৪তম চ্যাম্পিয়নস লিগের পথে স্বপ্নযাত্রার শেষ ধাপে যখন স্তাদ দো ফ্রান্সের ফাইনালে চোখ ফিরবে কোনো রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থকের, কল্পনায় বারবার ভেসে উঠবে এক জোড়া গ্লাভস। শুধু গ্লাভস কেন, হাত-পা-বুক-মাথা...শরীরের কোন অংশ দিয়ে গোল ঠেকাননি থিবো কোর্তোয়া!

৫৯ মিনিটে ভিনিসিয়ুস গোলটা করেছেন, তার আগে-পরে অবিশ্বাস্য দক্ষতায় একের পর এক গোল বাঁচিয়েছেন কোর্তোয়া। দুইয়ের যুগলবন্দীতেই রিয়ালের এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগের অবিশ্বাস্য পথচলার শেষ শিরোপায়। প্যারিসে আজ লিভারপুলকে ১-০ গোলে হারিয়ে ১৪তম চ্যাম্পিয়নস লিগ ঘরে তুলেছে রিয়াল। আনচেলত্তির তাতে রেকর্ড চতুর্থ চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতা হয়ে গেল।

তাঁর অনবদ্য পারফরম্যান্সে এসেছে ট্রফিটা, তাতে চুমু এঁকে দেওয়ার অধিকার কোর্তোয়ারই তো সবচেয়ে বেশি
ছবি: রয়টার্স

ম্যাচের আগে বলে রেখেছিলেন, ‘রিয়াল মাদ্রিদ যখন ফাইনালে খেলে, রিয়াল মাদ্রিদ জেতে।’ দম্ভই মনে হয়েছিল কোর্তোয়ার কথাগুলো শুনে। কিন্তু এমন অবিশ্বাস্য পারফরম্যান্সের পর মনে হয়, এমন দম্ভ কোর্তোয়াকে বেশ মানিয়ে যায়। এমনই অবিশ্বাস্য ছন্দে ছিলেন রিয়ালের বেলজিয়ান গোলকিপার যে, যোগ করা পাঁচ মিনিট সময় মিলিয়ে ৯৫ মিনিটে গড়ানো ম্যাচটার স্থায়ীত্ব আরও ৩০-৪০ মিনিট বেশি হলেও সম্ভবত রিয়ালের চিন্তা ছিল না।

অবশ্য আক্রমণের শেষভাগে এসে নখদন্তহীন হয়ে পড়া লিভারপুলও যে তখন কোর্তোয়ার খুব বেশি একটা পরীক্ষা নিতে পারত না, সে-ও বোধহয় লিখে দেওয়া যায়। রিয়ালকেই ফাইনালে চাওয়া সালাহ কয়েকটি সুযোগ হারানো আর কোর্তোয়ার অবিশ্বাস্য দু-একটি সেভের শিকার হয়ে মাটি চাপড়ানো ছাড়া তেমন কিছুই করে দেখাতে পারলেন না। বল পায়ে অন্য সময়ে দারুণ ট্রেন্ট আলেক্সান্ডার-আরনল্ডের পাস-ক্রস ঠিক হলো না, রবার্টসনের জায়গা ছেড়ে যাওয়ার সুযোগেই লিভারপুল গোলটা খেয়েছে... সব মিলিয়ে প্যারিসে রাতটাতে কিছুই ঠিক হলো না লিভারপুলের।

ঠিক না হওয়ার শুরু ম্যাচের আগে থেকেই, মাঠের বাইরের ঝামেলায়। সেখানেও লিভারপুলের লাল জার্সিধারীরাই ভুগেছেন বেশি। ম্যাচ শুরুর আগে তাঁদের মাঠে ঢোকা নিয়ে ঝামেলায় দুই দফায় ম্যাচ পিছিয়ে শুরু হয় ৩৮ মিনিট পর!

সেটির ধাক্কা সামলে উঠতেই কি না, ম্যাচে প্রাণ আসতে আসতেই প্রায় ১৫ মিনিট চলে গেছে। এরপর? রিয়াল যেভাবে যা চেয়েছে, তা-ই হয়েছে।

লিভারপুল আগ্রাসী ফুটবলে ঝাঁপাবে, রিয়াল কোচ কার্লো আনচেলত্তির তা আঁচ না করতে পারার কোনো কারণ ছিল না। সেটির জবাব কীভাবে দিলেন আনচেলত্তি? জোসে মরিনিও ঢংয়ে! মূলত নিজেদের বক্সের সামনে লিভারপুলকে টেনে এনে পাল্টা আক্রমণে ভিনিসিয়ুসের গতি আর করিম বেনজেমার চাতুর্যকেই ভরসা মেনেছেন। সঙ্গে ৯০ মিনিটজুড়ে একই ছন্দে ওপর-নিচ দৌড়ানোর জন্য ফেদেরিকো ভালভার্দে তো ছিলেনই!

বেনজেমা খুব একটা আলো ছড়াতে পারেননি, কিন্তু তার দরকারও পড়েনি রিয়ালের। গ্লাভস হাতে কোর্তোয়া বিশ্বসেরা গোলকিপারের দাবিটা জানাতে ক্লাব ফুটবলের সবচেয়ে বড় মঞ্চই বেছে নিয়েছেন। যে দানি কারভাহাল ছন্দের অভাবে ভুগছিলেন, তিনি খেললেন সাম্প্রতিক সময়ে নিজের অন্যতম সেরা ম্যাচ।

আগের রাউন্ডগুলোয় এমবাপ্পে, ভের্নারদের সামনে ভুগেছেন, তাঁকে সামনে পেয়ে লিভারপুলের নতুন অস্ত্র লুইস দিয়াজ কী করেন, সেটি দেখার ছিল। দিয়াজ তো দিয়াজ, কারভাহালের পারফরম্যান্সের পর মনে হবে, মেসি-রোনালদো-পেলে-ম্যারাডোনারাও যদি আজ লিভারপুলের জার্সিতে নামতেন, তবু হয়তো লিভারপুলের বাঁ দিক থেকে বক্সে তেমন ঢোকা হতো না!

লিভারপুল আক্রমণের পর আক্রমণ করেছে ঠিকই, বরং খেলাটা রিয়ালের অর্ধেই বেশি হয়েছে। লিভারপুল শটও নিয়েছে ঢের। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, রিয়ালের ৪ শটের বিপরীতে লিভারপুলের শট ২৪টি। বলের দখলেও লিভারপুলই এগিয়ে ৫৪-৪৬ শতাংশ ব্যবধানে এগিয়ে ছিল। কিন্তু লিভারপুলের এই ২৪ শটের বেশিরভাগই হয়তো তেমন ভয় ধরাতে পারেনি রিয়ালে, আর যখন ধরিয়েছে, তখন কোর্তোয়া তো ছিলেনই প্রাচীর হয়ে!

আলতো ছোঁয়ায় বল জালে জড়িয়ে দিয়েছেন ভিনিসিয়ুস, শেষ পর্যন্ত তাতেই রচিত ব্যবধান।
ছবি: রয়টার্স

কিন্তু উল্টোদিকে রিয়াল যতবার লিভারপুল বক্সে ঢুকেছে, তার বেশিরভাগ সময়ে লিভারপুল কেঁপেছে। প্রথমার্ধের শেষ দিকে বেনজেমার একটি গোল অফসাইডের বিতর্কিত অভিযোগে বাতিল না হলে তখনই এগিয়ে যায় রিয়াল!

বিরতির পর অবশ্য বেশিক্ষণ আর অপেক্ষায় থাকতে হয়নি রিয়ালকে। ডান দিক থেকে বক্সে ঢুকে ভালভার্দের দারুণ গতিময় নিচু ক্রস ঠেকানোর সাধ্য ছিল না লিভারপুল রক্ষণের, বাঁ দিকে ফাঁকা হয়ে পড়া ভিনিসিয়ুস শুধু পা ছুঁইয়েই কাজ সেরেছেন। স্কোরশিটে তো শেষ পর্যন্ত তাতেই বাজিমাত!

লিভারপুল এমন সুযোগ একেবারে কম পায়নি। মূলত তো লিভারপুলের আক্রমণ আর রিয়ালের রক্ষণের লড়াই-ই হয়েছে, তাতে প্রথমার্ধে লিভারপুলের সবচেয়ে ভালো সুযোগটা পেয়েছিলেন সাদিও মানে। কিন্তু তাঁর শট দারুণ ক্ষিপ্রতায় ঢকিয়ে দেন ভিনিসিয়ুস, বল পোস্টে লেগে ফেরত আসে। দ্বিতীয়ার্ধে সবচেয়ে বড় সুযোগটা সালাহর, নিজেদের বক্স থেকে ভেসে আসা বল নিয়ন্ত্রণে নিয়ে দারুণ শট করেন, কিন্তু ওই যে, বাজপাখির ক্ষিপ্রতায় কোর্তোয়া ফিরিয়ে দিয়েছেন সেসব।

রিয়াল মাদ্রিদও কি সুযোগ কম পেয়েছে! বিরতির আগে বেনজেমার গোল বাতিল হলো অফসাইডে, বিরতির পর ভিনিসিয়ুসের গোল তো হলোই, এরপরও পাল্টা আক্রমণে বেনজেমার শেষ পাসটা ঠিক হলে কিংবা ফ্রি-কিকে ফাঁকায় বল পেয়েও কাসেমিরো শট নিয়ে নিলে হয়তো ১৪তম শিরোপা উৎসবের প্রস্তুতি আরও আগেই নেওয়া হয়ে যেত রিয়াল সমর্থকদের।

তা যে হয়নি, সেটি নিয়ে মনে হয় না রিয়াল সমর্থকদের কারও কোনো আপত্তি আছে। আট বছরে পাঁচ চ্যাম্পিয়নস লিগ, সব মিলিয়ে ১৪তম, কার্লো আনচেলত্তির রেকর্ড চতুর্থ... চ্যাম্পিয়নস লিগে যে রিয়ালের জমিদারির ঘোষণাই আরেকবার দেওয়া হলো প্যারিসে।