মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে থাকা এক পাকিস্তানির গল্প

সিনেমার গল্প নয়। পাকিস্তানি হয়েও এ দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানের অত্যাচার মেনে নেননি গফুর বালুচ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সামনে দাঁড়িয়ে গেলেন এক পাকিস্তানিই। তাঁর সমর্থন ছিল এ দেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের প্রতি। বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশকে আপন করে নেওয়া সেই মানুষটির গল্পটা শোনা যাক।

কোচিং থেকে অবসর নেওয়ার পর অসহায় জীবন যাপন করছিলেন গফুর বালুচ। তাই তাঁর জন্য ১৯৮৫ সালে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে ব্রাদার্স ইউনিয়ন ও আবাহনী লিমিটেডের মধ্যকার চ্যারিটি ম্যাচের আয়োজন করেছিলেন তাঁর শিষ্যরা। সে ম্যাচ শুরুর আগে হাত নেড়ে দর্শকদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন তিনিছবি: সংগৃহীত

থমথমে বাংলাদেশ, ১৯৭১। ঢাকার গোপীবাগ আরও অশান্ত। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের আশায় গন্তব্যহীন মানুষের ছুটে চলা-কোথায় গেলে বাঁচবে প্রাণটা। আশার আলো দেখতে না পাওয়া কিছু মানুষ জীবনের মায়া ভবিষ্যতের হাতে ছেড়ে দিয়ে থেকে গেলেন গোপীবাগের নিজ ভিটেতেই। কতটা সৌভাগ্যবান-ই না ছিলেন তাঁরা, তাঁদের জন্য পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সামনে দাঁড়িয়ে গেলেন এক পাকিস্তানিই।

সিনেমার গল্প নয়, সত্যি। মানুষটি ছিলেন পাকিস্তান জাতীয় দলের ফুটবলার আবদুল গফুর বালুচ। পাকিস্তানি হয়েও এ দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানের অত্যাচার মেনে নেননি। তাঁর সমর্থন ছিল এ দেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের প্রতি। ১৯৫৮ সালে ফুটবলের কাবুলিওয়ালা ট্যাগ নিয়ে এসে সেই যে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নাড়ি-নক্ষত্রের সঙ্গে বন্ধন, স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় বাংলার সঙ্গে অবাঙালি গফুরের ভালোবাসার সম্পর্ক গভীর থেকে হলো আরও গভীরতম। আর শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের বালুচ সম্প্রদায়ের মানুষটি স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিকেই বানিয়েছিলেন তাঁর অহংকৃত ও শেষ আপন ঠিকানা হিসেবে।

পাকিস্তানের করাচিতে অনুষ্ঠিত কায়েদে আজম ট্রফিতে বাংলাদেশ জাতীয় দলের সঙ্গে গফুর বালুচ (বাঁ থেকে ষষ্ঠতম স্থানে)। বাংলাদেশ জাতীয় দলের কোচ হিসেবে এটিই ছিল তাঁর প্রথম দায়িত্ব
ছবি: সংগৃহীত

ঢাকায় অনুষ্ঠিত আগা খান গোল্ডকাপ খেলতে ১৯৫৮ সালে প্রথম ‘বাংলায়’ পা রাখেন পাকিস্তান জাতীয় দলের এই স্টপার। এরপর থেকেই শুরু হয় তাঁর ‘বাংলাদেশি’ হয়ে ওঠার গল্প। পূর্ব পাকিস্তানে খেলোয়াড়ি জীবন শুরু করেছিলেন ওয়ান্ডারার্সের জার্সিতে। ষাটের দশকে যে ফুটবল উপহার দিয়েছেন, সে গল্প এখনো কোনো ক্ষুরধার মস্তিষ্কের ফুটবলপ্রেমীর মুখ থেকে শোনার সৌভাগ্য হলে বর্তমান তরুণ প্রজন্মও আচ্ছন্ন হয়ে পড়বে গফুরের ফুটবলশৈলীতে। তবে একজন গফুর খেলার মাঠ ছাপিয়ে বাংলাদেশিদের হৃদয়ে নায়কের আসনে বসে আছেন পাকিস্তানি থেকে বাংলাদেশি হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে।

স্বাধীনতার উষালগ্নে তাঁর হাত ধরে গোপীবাগের সোনালি প্রজন্মের ব্রাদার্সের গড়ে ওঠা। ফুটবলার পরিচয়ের গণ্ডি ছাড়িয়ে পরিচিত হয়েছিলেন ব্রাদার্সের ‘ওস্তাদ গফুর’ হিসেবে। আর বাঙালি-অবাঙালি ভেদ-বিচার না করে খেলোয়াড়ি মনোভাব পরিচয়টা পোক্ত করে প্রমাণ করেছিলেন, এই স্বাধীন বাংলাদেশই তাঁর ঠিকানা। ১৯৮২ সালে পাকিস্তানের করাচিতে অনুষ্ঠিত কায়েদে আজম ট্রফিতে জাতীয় দলের কোচের দায়িত্ব দিয়ে গফুরের সেই ‘বাংলাদেশি’ সত্তাকে সম্মান জানিয়েছিল বাংলাদেশ।

জীবনের শেষ অধ্যায়ে চিরকুমার গফুরের নিঃসঙ্গ জীবনের শেষ নিশ্বাস এই বাংলার মাটিতেই এবং শুয়ে আছেন তাঁর প্রিয় গোপীবাগেই। ১৯৯৭ সালের ২৫ জুনের সকালটা সবে দুপুরে গড়াতে শুরু করেছে। গফুর বালুচ নেই-খবরটা ছড়িয়ে পড়তেই ডুকরে কেঁদে ওঠে বাংলাদেশ।

গফুর বালুচের কোচিংয়ে ১৯৮১ সালে আগা খান গোল্ডকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ব্রাদার্স ইউনিয়ন দল। মাঝে সাদা শার্ট পরিহিত কোচ গফুর
ছবি: সংগৃহীত

সংক্ষিপ্ত পরিচয় ও বাংলাদেশ অধ্যায়

ষাটের দশকে পাকিস্তানের মারকানি ফুটবলারনির্ভর হয়ে পড়েছিল ঢাকা ওয়ান্ডারার্স, মোহামেডান, ইপিআইডিসি। ঢাকার মাঠে আলো ছড়িয়েছিলেন তোরাব আলী, ওমর, আবদুল্লাহ, মাওলা বক্স, আমির বক্স, আলী নেওয়াজ, আলী আকবর, কাদের বক্স, রসুল বক্স, ইউসুফ, কালা গফুর, গফুর বালুচসহ আরও অনেকে।

তাঁদের মধ্যে বিশেষ করে স্টপার গফুর বালুচের কথা বলতেই হয়। ১৯৩৬ সালে করাচিতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। শোনা যায়, মায়ের দিক থেকে তিনি ছিলেন ইরানি বংশোদ্ভূত। ১৯৫১ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সেই করাচির কাদরি স্পোর্টস ক্লাবের হয়ে প্রথম বিভাগ লিগে খেলোয়াড়ি জীবন শুরু হয় তাঁর। ১৯৫৮ সালে করাচি কিকার্স দলের হয়ে আগা খান গোল্ডকাপে খেলতে প্রথমবারের মতো ঢাকায় আসা।

১৯৫৯ সালের ওয়ান্ডারার্সের জার্সিতে ঢাকা লিগে অভিষেক হয়ে খেলেন টানা সাত মৌসুম। ১৯৬৬ সালে ইপিআইডিসিতে (বর্তমানে বিজেএমসি) যোগ দিয়ে দলটিকে ১৯৬৭-৬৮ সালে লিগ চ্যাম্পিয়ন করেন। পরের বছর আবার ফিরে যান ওয়ান্ডারার্সে। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে শেষবারের মতো জার্সি গায়ে চাপিয়েছিলেন কিছু সময়ের জন্য। সে বছর ছিলেন মূলত বিআইডিসি নামের দলটির কোচ। কিন্তু শেষ খেলায় জার্সি গায়ে চাপিয়ে মাঠে নেমে অবসর। সে বছর দলটি হয়েছিল চ্যাম্পিয়নও। এরপর পুরোপুরি কোচিংয়ে নাম লেখানো দিয়েই শুরু হয় ‘গফুর ওস্তাদ’ যুগ।

গফুর বালুচের কোচিংয়ে ১৯৭৩ সালে তৃতীয় বিভাগ ফুটবল লিগে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ব্রাদার্স ইউনিয়ন। মাঝে সাদা ট্র্যাকস্যুট পরিহিত গফুর
ছবি: সংগৃহীত

স্বাধীনতাযুদ্ধে ভূমিকা

স্বাধীনতাকাঙ্ক্ষী বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) সঙ্গে গফুরের পরিচয় ১৯৫৮ সালে, যিনি নিজেই নিজের বিচার, বুদ্ধি ও পেশাগত পরিকল্পনাকে বাংলাদেশে নিবেদন করলেন। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় করাচিতে ফিরে না গিয়ে পরোক্ষভাবে কাজ করলেন বাংলাদেশের হয়েই। থাকতেন গোপীবাগের ভূত বাংলায় (বর্তমানে আনসার ক্যাম্প)। গোপীবাগের অনেক মানুষ আছেন, যাঁদের পাকিস্তান আর্মির হাত থেকে বাঁচিয়েছেন তিনি। পাকিস্তান জাতীয় দলের খেলোয়াড় পরিচয়টাই পাকিস্তান আর্মির সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন গোপীবাগবাসীকে বাঁচানোর জন্য।

ব্রাদার্স দলের সাবেক অধিনায়ক ও গোপীবাগেরই সন্তান শহীদউদ্দিন আহমেদ (সেলিম) বলেন, ‘খোকা (সাদেক হোসেন খোকা) ভাইয়ের মুখ থেকে অনেকবার শুনেছি, মুক্তিযুদ্ধের সময় গফুর ওস্তাদ তাঁদের অনেক সহযোগিতা করেছেন। এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ওস্তাদের বাসাতেই রাখা হতো। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়ার ব্যবস্থাও করতেন।’

১৯৭৩ সালে গফুর নিজেও শহীদউদ্দিনকে বলেছেন, ‘আমার সঙ্গে খেলত এক আর্মি অফিসার। আমাকে সব সময় সন্দেহ করত। ও আমার কাছে এসে বলত, আমি মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছি। রুমে ঢুকে উঁকি দিত, কিন্তু কখনো কঠোরভাবে চেক করত না।’

১৯৮১ সালে আগা খান গোল্ডকাপে চ্যাম্পিয়ন ব্রাদার্স দল। মাঝে সাদা ট্র্যাকস্যুট পরিহিত গফুর
ছবি: সংগৃহীত

গোপীবাগের গফুর

কোচ গফুর বালুচকে গোপীবাগের কিশোর-যুবক, এমনকি সেখানকার অনেক বয়স্ক ব্যক্তি, যাঁরা একসময় ফুটবলের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, গুরুভক্তির ষোলো আনা উজাড় করে সবাই ওস্তাদ বলে ডাকেন। ইপিআইডিসি ক্লাবে খেলা ও কোচিং করানোর সুবাদে তৎকালীন গোপীবাগের ভূত বাংলায় তাঁর যে অধ্যায় শুরু হয়েছিল, মৃত্যুর আগপর্যন্ত গোপীবাগই তাঁর শেষ ঠিকানা। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ফুটবলের ফুল ফুটিয়ে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন গোপীবাগের তরুণসমাজ গঠনের কাজে।

১৯৭২ সাল থেকে এলাকার তরুণদের সঙ্গে মিশে গেলেন একজন প্রিয় ওস্তাদ-বড় ভাই হিসেবে। মহল্লার মানুষের কাছে তিনি ছিলেন মহৎ ব্যক্তির মতো। ফুটবল, ব্রাদার্স আর গোপীবাগই ছিল তাঁর আবেগ ও ভালোবাসা। ব্রাদার্সের দায়িত্ব ছাড়ার পর এলাকার এক পরিবারের দেওয়া দুই রুমের একটি বাসাতেই থাকতেন।

ক্লাবের পক্ষ থেকে তাঁকে অনেকবারই পাকিস্তানে পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু গা করেননি গফুর। আসলে গফুর তত দিনে মনেপ্রাণে হয়ে উঠেছিলেন গোপীবাগবাসীর একজন। কোচিং করিয়ে পাওয়া অর্থ দিয়ে গোপীবাগ মহল্লার গরিব-দুঃখী মানুষের অভাব-অনটন মেটানোর চেষ্টাও করে গেছেন তিনি।

গফুর বালুচের হাতেই কলি থেকে ফুল হয়ে পরবর্তীকালে দেশের ফুটবলে তারকা হয়ে উঠেছিলেন শেখ মোহাম্মদ আসলাম, সালাম মুর্শেদী, হাসানুজ্জামানের (বাবলু) মতো ফুটবলাররা। আসলাম, সালামদের নিয়ে ১৯৮০ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এএফসি অনূর্ধ্ব-১৯ বাছাইপর্বে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ। সবার মাঝে সাদা ট্র্যাকস্যুট পরিহিত কোচ গফুর বালুচ
ছবি: সংগৃহীত

গোপীবাগের ছেলে ব্রাদার্সের হয়ে খেলে তারকাখ্যাতি পাওয়া হাসানুজ্জামান বাবলু তৎকালীন সময়ের চিত্রটা তুলে ধরেন, ‘স্বাধীনতার পর গোপীবাগ ত্রাস এলাকায় পরিণত হয়। কিন্তু গফুর ওস্তাদ এলাকাটিকে বদলে ফেলেছিলেন। তিনি বলতেন, “এলাকার প্রতিটা ইটের নিচ থেকে একজন করে খেলোয়াড় বের করে আনব। এটা হবে ফুটবলের কারখানা। এখান থেকে শয়ে শয়ে ফুটবলার বের হয়ে আসবে। ”’

কোচিং ক্যারিয়ার

কোনো একাডেমিক সনদ না থাকা সত্ত্বেও কোচিংয়ে সফল হয়েছিলেন। ফুটবলের মৌলিক বিষয় পাস, রিসিভ, শুট, হেড, বড়জোর আরও কয়েকটি কেতাবি গুণ দিয়ে কী দারুণ একটি ফুটবল দল গঠন করা যায়, তার প্রমাণ তিনি রেখে গেছেন ব্রাদার্স ইউনিয়নে, বাংলাদেশ জাতীয় যুব দল ও মূল জাতীয় দলে। বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯, যুব ফুটবল, প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ ও কায়েদে আজম ট্রফিতে জাতীয় দলের কোচ ছিলেন।

ব্রাদার্স ইউনিয়নের একেবারে শুরু থেকেই পালন করেন কোচের দায়িত্ব। তিল থেকে শুরু করে ব্রাদার্স ইউনিয়নকে বানিয়েছিলেন দেশের সেরা ক্লাব। তাই দেশের ফুটবলানুরাগীরা তাঁকে বেশি চিনেছেন ‘ব্রাদার্সের গফুর বালুচ’ হিসেবে।

খেলা ছেড়ে দেওয়ার পরও গফুরের সুঠাম দেহে চর্বির রেশ পর্যন্ত নেই। তৎকালীন ভূত বাংলা নামক যে বাড়িতে অবস্থান করতেন, সে বাড়ির ছাদে তিনি
ছবি: সংগৃহীত

ব্রাদার্স অধ্যায়টা বাদ দিলে গফুরের কোচিং ক্যারিয়ার তেমন বড় নয়। ১৯৭৩ সালে তৃতীয় বিভাগে ব্রাদার্সের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার বছরেই গফুরের কোচিংয়ে প্রথম বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয় বিআইডিসি। ১৯৮২ সালে ব্রাদার্সের দায়িত্ব ছাড়ার পর ১৯৮৪-৮৫ সালে মুক্তিযোদ্ধা সংসদকে কোচিং করান। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে কোচিং করিয়েছেন বিআইডিসি, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, বিজেএমসি, সাধারণ বীমা ও ওয়াপদা ফুটবল দলকে। একই সঙ্গে ছিলেন বেশ কয়েকটি ক্লাবের উপদেষ্টা কোচ। কোচিং ভান্ডারে মণিমুক্তার মতো শোভা পাচ্ছে বাংলাদেশ জাতীয় দলের কোচ হওয়ার কৃতিত্বও। ১৯৮৬ সালে ব্রাদার্সের কোচ হয়েই কোচিং ক্যারিয়ারের ইতি টানেন।

ব্রাদার্স ইউনিয়নের ‘ওস্তাদ’

ব্রাদার্স ইউনিয়ন ও গফুর বালুচ যেন ছিলেন একই বৃন্তে দুটি ফুল। স্বাধীনতার পর ব্রাদার্স ইউনিয়নের একেবারে শুরু থেকেই পালন করেন কোচের দায়িত্ব। গোপীবাগ মহল্লার দলখ্যাত ব্রাদার্স তাঁর হাত ধরেই লাভ করে ঐতিহ্যবাহী খেতাব। সত্তরের দশকে দলটি দেশের সেরা ক্লাবের সঙ্গে হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশের তারুণ্যের প্রতীক। তাঁর অধীনেই ১৯৭৩ সালে ব্রাদার্সের অগ্রযাত্রা শুরু হয়ে সে বছরই তৃতীয় বিভাগ ফুটবলে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন। কমলা জার্সির দলটি পরের বছরই জিতে নেয় দ্বিতীয় বিভাগের শিরোপা।

প্রথম বিভাগে পা রাখার পথে শেষ ম্যাচটি ব্রাদার্স জিতেছিল ৮ গোলের বিশাল ব্যবধানে। ১৯৭৫ সালে প্রথম বিভাগে ব্রাদার্স তাদের প্রথম ম্যাচেই তৎকালীন চ্যাম্পিয়ন আবাহনী ক্রীড়া চক্রকে হারিয়ে চমক সৃষ্টি করে। মহল্লার খেলোয়াড়দের নিয়ে গঠিত দলটিই ১৯৭৮ সালে হয় লিগ রানার্সআপ এবং ১৯৭৯ সালে আগা খান গোল্ডকাপ ফুটবল প্রতিযোগিতায় হয় যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন।

১৯৮০ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ২২ তম যুব এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশসহ অংশগ্রহণ করে পাঁচটি দেশ। লিগ ভিত্তিতে হওয়া টুর্নামেন্টটিতে চ্যাম্পিয়ন হয়ে চূড়ান্ত পর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে কাতার। গ্রুপ রানার্সআপ হিসেবে দ্বিতীয় পর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছিল বাংলাদেশও।

১৯৭৩-এ তৃতীয় বিভাগ ও ১৯৭৪-এ দ্বিতীয় বিভাগে গোলের পর গোল, বাবলু-মোহসিনদের হ্যাটট্রিকের পর হ্যাটট্রিক পাওয়া ব্রাদার্স ইউনিয়নকে একটি দুর্ভেদ্য দলে পরিণত করেছিলেন। ১৯৭৫-এ প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হওয়ার পরও কয়েক বছর ব্রাদার্স ছিল তারুণ্যের প্রতীক। চ্যাম্পিয়নশিপের লক্ষ্যে দেশসেরা খেলোয়াড়দের নিয়ে আবাহনী-মোহামেডান দল গড়লেও মহল্লার ছেলেদের নিয়েই চ্যাম্পিয়ন হওয়ার লড়াই করেছে ব্রাদার্স। যদিও একটি লিগ শিরোপা ওঠেনি তাদের হাতে। ১৯৮৫ সালে ব্রাদার্সের কোচের পদ ছাড়ার গল্পটাও বালুচের জন্য সুখকর ছিল না।

তৎকালীন ব্রাদার্সের হয়ে খেলে তারকাখ্যাতি পাওয়া হাসানুজ্জামান বাবলু সেই দল সম্পর্কে স্মৃতি রোমন্থন করেন, ‘১৯৭৩ সালে তৃতীয় বিভাগে আমরা অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হলাম। ওই বছরে ছয়ের নিচে গোল নেই আমাদের, ওপরে ১৯ গোল পর্যন্ত ছিল। ১৯৭৪ সালে দ্বিতীয় বিভাগেও অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন। সেখানে নিচে ৪ গোল, সর্বোচ্চ ১০ গোল।’

প্রথম বিভাগ লিগ সম্পর্কে বাবলু বলেন, ‘১৯৭৫ সালে প্রথম বিভাগে আবাহনী ক্রীড়া চক্রের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচ। মনে আছে পত্রিকায় কাজী সালাউদ্দিন সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ওদের তো স্টেডিয়ামের ঘাস চিনতেই কয়েক বছর লেগে যাবে। অথচ আবাহনীকে হারিয়ে দিয়েই আমাদের লিগ শুরু। যদিও ১৯৭৫ সালে গিয়েই ব্রাদার্স প্রথম হারের স্বাদ পাই মোহামেডানের বিপক্ষে। তৃতীয় বিভাগ থেকে শুরু করে ব্রাদার্সের এই প্রথম হার। তা-ও ৩০ সেকেন্ড আগে গোল খেয়ে। ২০ পয়েন্টের জায়গায় পেলাম ১৮ পয়েন্ট।’

ব্রাদার্সের কোচের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার পর একেবারেই বেকার হয়ে পড়েন ওস্তাদ। খাওয়ার মতো টাকাও তাঁর কাছে ছিল না।
হাসানুজ্জামান বাবলু, জাতীয় দলের সাবেক খেলোয়াড়

বাংলাদেশের কোচ

তরুণ খেলোয়াড়দের নিয়ে অপ্রতিরোধ্য ব্রাদার্স ইউনিয়ন গড়ে তোলার স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ যুব দলের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয় গফুরের হাতে। এরপর ১৯৮১ সালে প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ লাল দলের কোচ ছিলেন। পরের বছর পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত কায়েদে আজম ট্রফিতেও বাংলাদেশ দলের দায়িত্ব ছিল তাঁর হাতে।

১৯৮০ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ২২ তম যুব এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশসহ অংশগ্রহণ করে পাঁচটি দেশ। লিগ ভিত্তিতে হওয়া টুর্নামেন্টটিতে চ্যাম্পিয়ন হয়ে চূড়ান্ত পর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে কাতার। গ্রুপ রানার্সআপ হিসেবে দ্বিতীয় পর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছিল বাংলাদেশও। বাছাইপর্বের চারটি ম্যাচের মধ্যে তিনটিতেই জেতে বাংলাদেশ। কাতারের বিপক্ষে ২-১ গোলে হার ছাড়া নেপালের বিপক্ষে ৫-১, ওমানের বিপক্ষে ২-০ ও ভারতের বিপক্ষে ১-০ গোলে জিতেছিল বাংলাদেশ। এই টুর্নামেন্টের পর ভাগ্যবান কোচ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল গফুরকে। কারণ, একই আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে সর্বাধিক ম্যাচ জিতেছিল বাংলাদেশ। ১৯৮২ সালে মূল জাতীয় দলের কোচের দায়িত্ব পেয়েছিলেন তিনি।

অবিবাহিত জীবন

ফুটবল, ব্রাদার্স আর গোপীবাগ নিয়েই যৌবন-জীবন পার করে দিয়েছিলেন। বিয়ে না করা প্রসঙ্গে ক্রীড়া জগৎকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘কেয়া হোগা শাদি বানাকে, আকেলি হু, আচ্ছিই তো হু। ইয়ে ফুটবলই তো মেরা সনসার-মোকাম বিবি বাচ্চা। ইস সে জেয়াদা মুঝে কুচ ভি নেহি চাইয়ে (কী হবে বিয়ে করে, একা আছি বেশ তো আছি। এই ফুটবলই তো আমার ঘর-সংসার, স্ত্রী সন্তান। এর চেয়ে বেশি আমার কিছুই চাওয়ার নেই।’

বলে লাথি দিয়ে নিজের জন্য আয়োজিত হওয়া চ্যারিটি ম্যাচের উদ্বোধন করছেন গফুর বালুচ
ছবি: সংগৃহীত

তাঁর জন্য চ্যারিটি ম্যাচ

ব্রাদার্সের কোচের পদ ছাড়ার পর একপ্রকার বেকারই হয়ে পড়েন তিনি। জীবনযাপন চালিয়ে নেওয়ার মতো অর্থ তাঁর কাছে ছিল না বলে জানা যায় বিভিন্ন সূত্র থেকে। কিন্তু কারও কাছ থেকে হাত পেতে কোনো কিছু নেওয়ার অভ্যাস ছিল না। তাঁর শিষ্যরা গফুরের সৌজন্যে ১৯৮৫ সালে চ্যারিটি ম্যাচের আয়োজন করেছিলেন। মাত্র তিন দিনের পরিকল্পনায় নামমাত্র প্রচারেই সে ম্যাচ থেকে আয় হয়েছিল আড়াই লাখ টাকা। পুরো অর্থ ব্রাদার্স ইউনিয়নসংলগ্ন ব্যাংকে সঞ্চয় করে দেন খেলোয়াড়েরা।

সেই চ্যারিটি ম্যাচের স্মৃতিচারণা করেন হাসানুজ্জামান বাবলু, ‘ব্রাদার্সের কোচের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার পর একেবারেই বেকার হয়ে পড়েন ওস্তাদ। খাওয়ার মতো টাকাও তাঁর কাছে ছিল না। ১৯৮৫ সালে আমরা খেলোয়াড়েরা বসে আবাহনীর সঙ্গে একটি চ্যারিটি ম্যাচের আয়োজন করি। তিন দিনের ঘোষণায় ম্যাচ আয়োজন করে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা ওঠে। ক্লাবের সামনে একটা ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলে দিই। বাকিটা জীবন এই অর্থ দিয়েই কাটিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল।’

পাকিস্তানে না ফিরলেও গিয়েছিলেন

স্বাধীনতাযুদ্ধের পরপরই গফুরের ভাগনে কাইউম চেঙ্গিজি (এককালে পাকিস্তান জাতীয় ফুটবল দলের তুখোড় সেন্টার ফরোয়ার্ড) ঢাকায় এসেছিলেন মামাকে সঙ্গে করে পাকিস্তানে নিয়ে যেতে। কিন্তু ভাগনেকে হতাশ করে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। এ ছাড়া ১৯৭১-এ তাঁর এক ভাই, যিনি পাকিস্তানি একটি রেজিমেন্টের জাঁদরেল অফিসার ছিলেন, গফুরকে নিতে এসে হতাশা নিয়ে ফিরতে হয়েছিল তাঁকেও। ক্রীড়া জগতের তথ্য অনুযায়ী দ্বিধাহীন চিত্তে প্রত্যাখ্যান করে গফুর বলেছিলেন, ‘আহিন্দা ক্যাভি না আও, হাম পাকিস্তান নেহি যায়েঙ্গে।’

করাচির সম্ভ্রান্ত পরিবারের একজন সন্তান হওয়া সত্ত্বেও তিনি বাংলাদেশের কঠিন জীবনকেই আপন করে নিয়েছিলেন। তিনি ব্রাদার্স, গোপীবাগ ও বাংলাদেশের জন্য যা করেছেন, তাঁর স্বীকৃতি সেভাবে পাননি।
হাসানুজ্জামান বাবলু, জাতীয় দলের সাবেক খেলোয়াড়

অবশ্য ১৯৮২ সালে গফুর পাকিস্তানে গিয়েছিলেন। তবে ফিরে যাওয়া নয়, তাঁর যাওয়া করাচিতে অনুষ্ঠিত কায়েদে আজম ট্রফিতে বাংলাদেশ দলের কোচ হিসেবে। সেবার তাঁর শিষ্যদের নিজের পাড়াতেও ঘোরাতে নিয়ে গিয়েছিলেন গফুর।

সেই দলের খেলোয়াড় ছিলেন হাসানুজ্জামান বাবলু। ৩৯ বছর আগের স্মৃতি রোমন্থন করে শোনালেন, ‘করাচিতে গিয়ে ওস্তাদ তাঁর মহল্লায় বাড়িতে বাড়িতে নিয়ে আমাদের ঘুরিয়েছিলেন। তাঁর এলাকায় তাঁর খুব জনপ্রিয়তা দেখেছি। প্রতিবেশীরা বলেছিলেন, এবার দেশেই থেকে যাও। যতটুকু মনে পড়ে, তাঁর মা-বাবা জীবিত ছিলেন না।’
তিনি বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে পাকিস্তানে গিয়েছিলেন বলে নিশ্চিত করেছেন সে দলের একাধিক খেলোয়াড় ও তৎকালীন ক্রীড়া সাংবাদিকেরা। প্রখ্যাত সাংবাদিক এবিএম মূসা তাঁর ‘মুজিব ভাই’ বইয়ে গফুরের পাসপোর্ট পাওয়ার প্রসঙ্গটি উল্লেখ করেছেন। সেখানে উঠে এসেছে দেশের ঐতিহ্যবাহী আবাহনী ক্লাবের প্রতি গফুরের অবদানও।

এবিএম মূসা লিখেছেন, ‘আমি এ ক্লাবের (ব্রাদার্স ইউনিয়ন) ১৯৫০ সালে প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলাম। সেই কারণে কামাল (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বড় ছেলে ও আবাহনী ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা) একদিন আমাকে অনুরোধ করলেন তাঁর নতুন ফুটবল দল গঠনে পরামর্শ দিতে ও সহায়তা করতে। আমি ব্রাদার্সের অবৈতনিক কোচ গফুর বালুচকে মাঝেমধ্যে আবাহনীর মাঠে নিয়ে আসতাম। ব্রাদার্সের মতো কলকাতা মোহামেডানের এককালীন খেলোয়াড় বালুচের আবাহনী গঠনেও অবদান রয়েছে। অপ্রাসঙ্গিক হলেও উল্লেখ করছি, পরবর্তীকালে বালুচ যখন পাকিস্তানে চলে যেতে চাইলেন, তখন আমি জাতীয় সংসদ সদস্য হিসেবে তাঁকে পাসপোর্ট পাওয়ার জন্য একটি অনাপত্তি দিয়েছিলাম।’

গফুর বালুচের প্রিয় শিষ্য ছিলেন হাসানুজ্জামান (বাবলু)। শিষ্যেরও প্রিয় ছিলেন ওস্তাদ গফুর বালুচ। তাই বিয়ের পাগড়ি ও মালা তাঁর হাত থেকেই পরেছিলেন হাসানুজ্জামান
ছবি: সংগৃহীত

প্রাপ্য সম্মান পাননি তিনি

মৃত্যু-পরবর্তী সময়ে দু-এক বছর মৃত্যুবার্ষিকী পালন করে বালুচকে স্মরণ করা হলেও ধীরে ধীরে তা বন্ধ হয়ে যায়। আর এখন তো সে বালাই নেই। অথচ বালুচের স্বীকৃতি ও ত্যাগস্বরূপ ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাবে তাঁর মূর্তি বা স্মৃতিস্তম্ভ থাকা উচিত ছিল বলে মনে করেন ক্লাবটির সূচনালগ্নের খেলোয়াড়েরা। শেষ জীবনে ওস্তাদের দুঃখ-কষ্টের গল্পগুলোও পোড়ায় তাঁর শিষ্যদের। যে মানুষটি পাকিস্তানের বর্ণাঢ্য জীবন ছেড়ে ব্রাদার্স, গোপীবাগ ও বাংলাদেশের মায়ায় পড়ে এখানেই পার করে দিলেন জীবনের বড় অংশ, অন্তত থাকার মতো তাঁর নিজের একটা ঠিকানা পাওয়া উচিত ছিল বলেও মনে করেন তাঁরা।

বাংলাদেশে বালুচ তাঁর প্রাপ্য সম্মান পাননি বলেই মনে করেন হাসানুজ্জামান বাবলু, ‘ওস্তাদের জন্য আমাদের রক্তক্ষরণ হয়। করাচির সম্ভ্রান্ত পরিবারের একজন সন্তান হওয়া সত্ত্বেও তিনি বাংলাদেশের কঠিন জীবনকেই আপন করে নিয়েছিলেন। তিনি ব্রাদার্স, গোপীবাগ ও বাংলাদেশের জন্য যা করেছেন, তাঁর স্বীকৃতি সেভাবে পাননি। ব্রাদার্স ক্লাবে গফুর ওস্তাদের মূর্তি থাকা উচিত ছিল। আমাদের প্রজন্মের পর আর কেউ জানবে না ওস্তাদের ইতিহাস। তাঁর স্মৃতি সংরক্ষণ করা প্রয়োজন।’

* লেখাটি ২০২১ সালের প্রথম আলো ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।