মুন্নাদের মৃত্যু নেই

আবাহনীর জার্সি গায়ে মোনেম মুন্না, ১৯৯২ছবি: মোনেম মুন্নার পারিবারিক অ্যালবামের

মুন্না আর নেই—বুক ভেঙে দেওয়া এই দুঃসংবাদটা শোনার মুহূর্তটা এখনো মনে পড়ে। কিডনির সমস্যা দেখা দেওয়ার পর থেকেই শঙ্কাটা ছিল। কিডনি প্রতিস্থাপন করে আসার পরও। তারপরও মুন্নার চলে যাওয়াটা মেনে নিতে খুব কষ্ট হয়েছিল। ৪০ ছোঁয়ার আগেই এমন টগবগে একজন মানুষের জীবনের গল্প ফুরিয়ে যাবে! 

এই করোনাকালে মোনেম মুন্নার কথা আমার আরও বেশি মনে পড়ে। কেন পড়ে, জানেন? এখন তো সবার মুখে মুখে মাস্ক। বেশির ভাগই আকাশি রঙের সার্জিক্যাল মাস্ক। এই মাস্কই মুন্নাকে মনে করিয়ে দেয়। ভারত থেকে কিডনি প্রতিস্থাপন করে আসার পর মুন্নার মুখে সব সময় এ মাস্ক থাকত।

মোনেম মুন্না
ফাইল ছবি

মুন্না নেই, জানি। তারপরও বিশ্বাস করবেন কি না, মুন্না যে নেই, এটা আমার প্রায়ই মনে থাকে না। কথাটা হয়তো অতি নাটকীয় শোনাচ্ছে। শোনালে শোনাবে, আমার যা মনে হয়, তা-ই বললাম। এমন মনে হওয়ার একটা কারণ হতে পারে, শেষ দিকে মুন্নার সঙ্গে এমনিতেও আমার খুব একটা দেখাসাক্ষাৎ হতো না। এখনো হয় না, কী এমন পার্থক্য?

পার্থক্য অনেক। অনেক দিন দেখা না হলেও তখন জানতাম, ফোন টিপলেই ও প্রান্ত থেকে শুনতে পাব আমুদে ওই কণ্ঠস্বর, ‘কী দাদা! আপনি দেশে আছেন?’

শেষ দিকে আরেকটা কথা খুব ‘কমন’ ছিল, ‘আপনি তো ক্রিকেটের লোক হয়ে গেছেন।’ অভিযোগ নয়, মজা করেই বলতেন। কারণ মুন্নার অন্তত ঠিকই জানা ছিল, পেশাগত কারণে ক্রিকেট বেশি লিখলেও ফুটবল-রসেও আমি একই রকম মজে আছি। মুন্নার ক্যারিয়ার যখন মধ্যগগনে, তখন তো আমি পুরোদস্তুর রিপোর্টার। ক্রিকেটের সময় ক্রিকেট, ফুটবলের সময় ফুটবল সবই কাভার করি। মুন্নার তাই ক্রিকেট বেশি কাভার করা সাংবাদিককে ফুটবল-বিরূপ বলে ভুল বোঝার কোনো কারণ ছিল না। ‘ক্রিকেটের লোক’ বলে রসিকতা করার পরই তাই যোগ করতেন, ‘মজা করলাম! ক্রিকেট নিয়ে লিখবেন না তো কী করবেন? ফুটবল তো ধ্বংসই হয়ে গেছে।’

প্রয়াত ফুটবল তারকা মোনেম মুন্না
ফাইল ছবি

বাংলাদেশের ফুটবলের অধোগতি নিয়ে খুব মনঃকষ্ট ছিল মুন্নার। থাকারই কথা। তিনি যে বাংলাদেশের ফুটবলের ওই বর্ণময় আর এই বিবর্ণ যুগের সেতুবন্ধ। দুটিরই তিনি প্রত্যক্ষ সাক্ষী। মানের দিক থেকে বাংলাদেশের ফুটবল কখনোই এমন আহামরি কিছু ছিল না। কিন্তু যা ছিল, তা নিয়েই উন্মাদনাটা তো ছিল। সেই উন্মাদনার মৃত্যু নিজের চোখেই দেখেছেন। দেখেছেন পুরো দেশকে দু্ই ভাগ করে দেওয়া, দর্শকে উপচে পড়া গ্যালারির আবাহনী-মোহামেডান কীভাবে সব ঔজ্জ্বল্য হারিয়ে শুধুই ‘আরেকটি ম্যাচ’ হয়ে গেছে! দেখেছেন অথর্ব কর্মকর্তাদের ব্যর্থতায় বাংলাদেশের ফুটবল জোড়াতালির ওপর আরও জোড়াতালি লাগিয়ে কীভাবে জীর্ণ থেকে জীর্ণতর হয়ে যাচ্ছে!

বাংলাদেশের ফুটবলের শেষ সুপারস্টার তিনি—এটা মুন্নাকে যতটা আনন্দ দিত, কষ্টও বোধ হয় কম দিত না। স্টার বা তারকা অনেকেই হয়, তবে সুপারস্টার বা মহাতারকা আসে কালেভদ্রে। মুন্না ছিলেন বাংলাদেশের ফুটবলের সেই মহাতারকা। একজন খেলোয়াড়ের সুপারস্টার হতে শুধু খেলোয়াড়ি দক্ষতাই যথেষ্ট নয়, আরও কিছু লাগে। বাড়তি একটা ঝলক, ব্যক্তিত্বে বাড়তি একটা মাত্রা—‘ক্যারিশমা’ দিয়েই বোধ হয় সবটা বোঝানো যায়। মুন্নার মধ্যে সেই ক্যারিশমাটা এমনই ছিল যে বাংলাদেশের ফুটবলে আলাদা একটা অধ্যায় বরাদ্দ রাখতে হবে তাঁর জন্য।

১৯৮৬ সিউল এশিয়ান গেমসে প্রথমবারের মতো জাতীয় দলের হয়ে খেলেন মোনেম মুন্না
ছবি: মোনেম মুন্নার পারিবারিক অ্যালবামের

কারও দ্বিমত থাকতেই পারে, থাকাটাই স্বাভাবিক। আমি শুধু ব্যক্তিগত মতটাই জানাতে পারি, বাংলাদেশের ফুটবলে সুপারস্টার বললে মুন্না ছাড়া আর একটি নামই আসে। কাজী সালাউদ্দিন। তবে একটা বিবেচনায় সালাউদ্দিনও মুন্নার কাছে কিছুটা ম্লান হয়ে যান। সালাউদ্দিন ছিলেন স্ট্রাইকার, ফুটবলের সবচেয়ে গ্ল্যামারাস পজিশনে খেলার সুবিধাটা ছিল তাঁর পক্ষে। ফুটবল গোলের খেলা, আর গোল যিনি করেন, দর্শক-সমর্থকদের হৃদয়ে ঢুকে যাওয়ার অর্ধেক পথ তো তিনি আগেই এগিয়ে থাকেন। ডিফেন্ডারের তারকা হওয়াটা সে তুলনায় অনেক কঠিন। এটা তো সৃষ্টিশীলতার কাজ নয়, বরং এখানে সাফল্য লুকিয়ে সৃষ্টিশীলতাকে ব্যর্থ করে দেওয়ায়। তারপরও মুন্নার এমন দর্শকপ্রিয় হতে পারাটাই বুঝিয়ে দিচ্ছে, তাঁর মধ্যে খেলার বাইরেও ‘কিছু একটা’ ছিল। তা এমনই যে ওপার বাংলাতেও মুন্না নামটা হয়ে গিয়েছিল একই রকম উন্মাদনার প্রতিশব্দ। মুন্না ইস্টবেঙ্গলের হয়ে মাঠ আলো করে আসার পর যতবার কলকাতায় গেছি, ‘বাংলাদেশের সাংবাদিক’ পরিচয় পাওয়ার পর বেশির ভাগ মানুষের অবধারিত প্রথম প্রশ্নটাই হয়েছে, ‘মুন্না কেমন আছে?’ কলকাতার সাংবাদিক বন্ধুদের পর্যন্ত এই একটা নামে উচ্ছ্বাসে ভেসে যেতে দেখেছি, ‘মাইরি, প্লেয়ার একটা বানিয়েছিস তোরা! কী খেলাটাই না খেলেছিল!’

মুন্না কীভাবে মুন্না হতে পেরেছিলেন, সেই ব্যাখ্যা দেওয়ার ভার ফুটবল বিশেষজ্ঞদের ওপর ছেড়ে দিলাম। ফুটবলীয় বিশ্লেষণ তাঁরা করুন। এই অধম সাংবাদিক নিজের উপলব্ধি থেকে এটুকু জানাতে পারে, খেলোয়াড়ি দক্ষতার সঙ্গে কোনো কিছুকেই অসম্ভব মনে না করার দুর্জয় সাহস আর সহজাত নেতৃত্বগুণ মুন্নাকে আর দশজন ফুটবলারের চেয়ে আলাদা করে দিত। আর ছিল ক্ষুরধার ফুটবল-মস্তিষ্ক, ‘রাফ অ্যান্ড টাফ’ ভাবমূর্তির কারণে যা বেশির ভাগ সময় আড়ালেই থেকে গেছে।

১৯৯০ বেইজিং এশিয়ান গেমসে প্রথমবারের মতো জাতীয় দলকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মোনেম মুন্না। ছবিতে তাঁকে জাপানের অধিনায়কের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করতে দেখা যাচ্ছে
ছবি: খন্দকার তারেক

মাঠের মুন্নার মতো মাঠের বাইরের মুন্নার মধ্যেও অন্য রকম একটা আকর্ষণ ছিল। কথাবার্তায় খুব পরিশীলিত ছিলেন না, তাতেই আরও বেশি অকৃত্রিম মনে হতো তাঁকে। ভণ্ডামি-তোষামোদি ছিল তাঁর দুচোখের বিষ, মুখের ওপর অপ্রিয় সত্যি কথা বলে দিতে দুবার ভাবেননি। এসব কারও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হলে তাঁকে ঘিরে এমনিতেই বাড়তি একটা আকর্ষণ তৈরি হয়। মুন্নাকে ঘিরেও হতো।

ম্যাচের আগে-পরে, কখনো কোনো আড্ডায় টুকরা-টাকরা কথাবার্তা তো কতই হয়েছে, তবে মুন্নার জীবন-ক্যারিয়ার এসব নিয়ে বড় ইন্টারভিউ করেছিলাম একটাই। সালটা ঠিক মনে নেই, ১৯৯৩-৯৪ সালের দিকেই হবে। সেই ইন্টারভিউয়ে মুন্নার একটা কথা এখনো মনে গেঁথে আছে। নারায়ণগঞ্জে ছোটবেলায় খেলার কারণে পড়া ফাঁকি দেওয়ায় এক শিক্ষক মুন্নাকে শাস্তি দিতে দিতে বলেছিলেন, ‘যদি খেলতে চাস, ভালো করে খেল। জীবনে যা-ই করবি, এক নম্বর হবি। যদি চোরও হোস, এক নম্বর চোর হবি।’

ঘটনাটা বলতে বলতে মুন্নার গলাটা ধরে এসেছিল। ‘আপনি তো এক নম্বরই হয়েছেন’—এ কথায় মুন্নার মুখে দেখেছিলাম শিশুর সারল্যমাখা ওই হাসিটা।

এখনো হঠাৎ হঠাৎ মনে হয়, একদিন হয়তো কোথাও মুন্নার সঙ্গে আবার দেখা হয়ে যাবে। আবার সেই হাসিটা দেখব। মুন্না যে আর নেই, এটা মনেই থাকে না।

নেই, কে বলল? মুন্নারা মরে নাকি!