মেক্সিকােকে ভোগায় অদ্ভুত 'রোগ'

কার্লোস ভেলা ও হাভিয়ের হার্নান্দেজের মতো খুব কম মেক্সিকান খেলোয়াড়ই ইউরোপের ক্লাব ফুটবলে এতটা সময় কাটিয়েছেন। ফাইল ছবি
কার্লোস ভেলা ও হাভিয়ের হার্নান্দেজের মতো খুব কম মেক্সিকান খেলোয়াড়ই ইউরোপের ক্লাব ফুটবলে এতটা সময় কাটিয়েছেন। ফাইল ছবি
>প্রতিভা থাকার পরও কেন মেক্সিকোর ফুটবল আরেকটি পর্যায়ে যেতে পারে না? সমস্যাটি লুকিয়ে আছে একটি অসুখে। মেক্সিকান খেলোয়াড় দেশের বাইরে খেলতে গেলেই নাকি গৃহকাতর হয়ে যান। এই সমস্যাকে বলে জ্যামাইকন সিনড্রোম

বিশ্ব ফুটবলকে খুব বেশি কিছু দিতে পারেননি হোসে জ্যামাইকন ভিয়েগাস। তবে মেক্সিকান ফুটবলকে ‘জ্যামাইকন সিনড্রোম’ নামে একটা শব্দবন্ধ দিয়ে গেছেন। এখনো কোনো মেক্সিকান খেলোয়াড় যখন দেশের বাইরে খেলতে যান, সবার আগে প্রশ্ন ওঠে, তিনি ‘জ্যামাইকন সিনড্রোম’ কাটাতে পারবেন কি না। মেক্সিকোর ফুটবলের সঙ্গে এই ব্যাপারটা এতই জড়িয়ে আছে যে পরশু রাতে বিশ্বকাপের শেষ ষোলোতে ব্রাজিলের কাছে হারের পরও সেই জ্যামাইকন সিনড্রোমের প্রসঙ্গ এল আরও একবার।

ব্যাপারটা তাহলে একটু খুলেই বলা যাক। হোসে ভিয়েগাস নামে মেক্সিকান এক ডিফেন্ডার ছিলেন, ‘জ্যামাইকন’ শব্দটা তখনো তাঁর নামের সঙ্গে যুক্ত হয়নি। পঞ্চাশ থেকে সত্তর দশক পর্যন্ত ভিয়েগাস মেক্সিকান ক্লাব গুয়াদালাহারাতে খেলেছেন। খেলেছেন দেশের হয়ে ১৯৫৮ ও ১৯৬২ বিশ্বকাপেও। গুয়াদালাহারার হয়ে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের কারণে তাঁকে মেক্সিকোর ওই সময়ের সেরা ডিফেন্ডার মনে করতেন অনেকেই। শোনা যায়, পঞ্চাশের দশকের মাঝের দিকে ব্রাজিলিয়ান ক্লাব বোটাফোগোর হয়ে এক ম্যাচে নাকি কিংবদন্তি গারিঞ্চাকেও একেবারে বাক্সবন্দী করে রেখেছিলেন। সেই ভিয়েগাস যখন দেশের হয়ে ১৯৫৮ বিশ্বকাপ খেলতে গেলেন সুইডেনে, তাঁর অন্য এক রূপ বেরিয়ে এল। মাঠে থেকেও যেন নেই, ঠিকঠাক কিছুই করতে পারছেন না। ওই বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বে সুইডেন, ওয়েলস আর হাঙ্গেরির কাছে মোট ৮ গোল খেয়ে বিদায় নিল মেক্সিকো। মনে করা হয়, সব কটি গোলই ভিয়েগাসের ভুলে। কেন এমন হলো?

ভিয়েগাসকে জিজ্ঞেস করার পর তিনি বলেছিলেন, মেক্সিকোর বাইরে এসে মন টিকছে না তাঁর। তিনি কিছুই করতে পারছেন না ঠিকমতো। বাবা-মা, পরিবার, বন্ধু—সবার কথা মনে হচ্ছে শুধু। খেতে পারছেন না ঠিকমতো। একটা ম্যাচের আগের রাতে নাকি তিনি হোটেলের বারান্দায় বসে একে একা কাঁদছিলেনও। গৃহকাতর যাকে বলে আরকি! সেই থেকে তাঁর নামে ‘জ্যামাইকন’ শব্দটা যোগ হলো। মেক্সিকান ভাষায় যারা অল্পতেই কান্নাকাটি করে অস্থির করে ফেলে, তাদের জ্যামাইকন বলা হয়।

শুরুতে ব্যাপারটা হাসিঠাট্টার মতোই ছিল। কিন্তু তা আরও বড় হয়ে দেখা দিল ১৯৬১ সালে, পরের বছরের বিশ্বকাপ সামনে রেখে মেক্সিকো ইংল্যান্ড সফরে। একটা স্থানীয় দলের সঙ্গে মেক্সিকো হারল ৮-০ গোলে! ওই ম্যাচের পর ভিয়েগাস বললেন, দেশের বাইরে এসে তাঁর জীবন নাকি অর্থহীন লাগছে। এবার তাঁর এই সমস্যাকে পাকাপাকিভাবে ‘জ্যামাইকন সিনড্রোম’ নাম দিয়ে দেওয়া হলো। সেই থেকে যেসব মেক্সিকান খেলোয়াড়ই দেশের বাইরে গিয়ে এমন গৃহকাতর হয়ে যান, তাঁরা জ্যামাইকন সিনড্রোমে ভুগছেন বলে ধরে নেওয়া হয়। এত কিছুর পরেও ভিয়েগাস ১৯৬২ বিশ্বকাপে গেছেন, তবে প্রথম ম্যাচেই ব্রাজিলের কাছে ২ গোল খাওয়ার পর বাকি দুই ম্যাচে আর নামানো হয়নি তাঁকে।

তো হঠাৎ আবার এই জ্যামাইকন সিনড্রোমের প্রসঙ্গ কেন এল? এনেছেন আসলে মেক্সিকোর কোচ হুয়ান কার্লোস ওসোরিও। সামারায় ব্রাজিলের কাছে মেক্সিকোর হারের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘ব্রাজিলের মতো একটা দলের বিপক্ষে সমানে সমানে লড়াই করে হারা, যেনতেন কথা নয়। মনে রাখতে হবে, ব্রাজিলিয়ান খেলোয়াড়েরা কোথায় খেলে। ইউরোপের সব বড় লিগে, বড় ক্লাবের খেলোয়াড় ওরা।’ মেক্সিকো কীভাবে উন্নতি করতে পারে? পরামর্শ দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘মেক্সিকোর খেলোয়াড়দেরও ইউরোপে যেতে হবে, বড় লিগে খেলতে হবে। যেমনটা ব্রাজিলিয়ানরা করে।’

কিন্তু মেক্সিকান খেলোয়াড়েরা ইউরোপে যাবেন কী, তাঁরা তো সেই জ্যামাইকন সিনড্রোমই কাটাতে পারেন না! এখন এই ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপের যুগেও দেশের বাইরে থাকতে মনে টিকে না মেক্সিকান খেলোয়াড়দের। এই বিশ্বকাপে মেক্সিকোর দলটাই দেখুন না,২৩ জনের মধ্যে মাত্র ১১ জন খেলেন ইউরোপে। অন্যদিকে ব্রাজিল দলে ইউরোপিয়ান ক্লাবের খেলোয়াড় ২০ জন!

হ্যাঁ, সামর্থ্যের একটা ব্যাপার তো আছেই। সবাই তো নিশ্চয়ই আর ইউরোপের বড় ক্লাবে খেলার মতোও নন। কিন্তু যাঁদের সেই সামর্থ্য আছে, তাঁরাও যে দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে খুব আগ্রহী, তা নয়। হুগো সানচেজ, রাফায়েল মার্কেজ, হাভিয়ের হার্নান্দেজদের মতো কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে বেশির ভাগ মেক্সিকান খেলোয়াড় দেশের ক্লাবে খেলেই খুশি। তবে বিশ্বমঞ্চে আরও বড় কিছু করতে গেলে বোধ হয় এই জ্যামাইকন সিনড্রোম কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করতেই হবে মেক্সিকান ফুটবলারদের।