মেসি-রোনালদো যুগের শেষ টানছেন নেইমার?

মেসি-রোনালদো দ্বৈতশাসনের যুগ শেষ টেনে দিচ্ছেন নেইমার? ফাইল ছবি
মেসি-রোনালদো দ্বৈতশাসনের যুগ শেষ টেনে দিচ্ছেন নেইমার? ফাইল ছবি

কাকাই সর্বশেষ ‘ভাগ্যবান’। এরপর থেকেই ফিফা বর্ষসেরার ট্রফিটাতে লিওনেল মেসি ও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর ‘দুই-চ্ছত্র’ আধিপত্য। সোনালি বলটা অধরা স্বপ্নই হয়ে থেকে গেছে জাভি-ইনিয়েস্তা-ন্যয়ারদের মতো খেলোয়াড়দের জন্যও। এবারও মোটামুটি নিশ্চিত, এই দুজনের একজনের হাতেই উঠতে চলেছে বর্ষসেরা ফুটবলারের এই স্বীকৃতি। তবে আট বছর ধরে চলে আসা এই ‘দ্বৈত-শাসনে’র অবসান হতে চলছে। নেইমারের হাতেই অবসান হবে মেসি-রোনালদো যুগের!

ফর্মের বিচারে সম্ভবত জীবনের সেরা সময়টাই পার করছেন ব্রাজিল ফরোয়ার্ড। মৌসুমে এখন পর্যন্ত বার্সার জার্সিতে মাঠে নেমেছেন ১৪ ম্যাচে। এর মধ্যে লিগে ১০ ম্যাচে গোল করেছেন ১১টি, করিয়েছেন ৩টি। চ্যাম্পিয়নস লিগের ৪ ম্যাচে ২ গোলের পাশাপাশি অ্যাসিস্ট ৩টি। এই মুহূর্তে স্প্যানিশ লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতাও তিনি। তবে শুধু সংখ্যাগুলোর সাধ্য কী নেইমারের মাহাত্ম্য বোঝায়!
ভিয়ারিয়াল ম্যাচের পর দলটির কোচ মার্সেলিনো গার্সিয়া বলেছিলেন, ম্যাচের ভাগ্য গড়ে দিতে পারেন—স্প্যানিশ লিগে এমন খেলোয়াড়দের মধ্যে নেইমারই সেরা। গত কদিনে তাঁর পারফরম্যান্স যাঁকে মনে করিয়ে দিচ্ছে, সেই রোনালদিনহো বলছেন, নেইমার পারবেন বিশ্বসেরা হতে। সাবেক ব্রাজিল খেলোয়াড় রবার্তো কার্লোস ও রিভালদোও বলছেন, পরের বছর কেন? নেইমার এবারের ব্যালন ডি'অরেরই সবচেয়ে বড় দাবিদার!

বার্সেলোনার হয়ে গত কদিনে যা করছেন, তাতে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, ইউরোপিয়ান ফুটবলের খবরগুলো শুরুই হয় নেইমার দিয়ে, শেষও হয় নেইমারে। গত ২৬ সেপ্টেম্বর লিওনেল মেসি হাঁটুতে চোট পেয়ে মাঠ ছাড়ার পর থেকেই যে আলোটা নিজের দিকে টেনে নিয়েছেন ২৩ বছর বয়সী ফরোয়ার্ড। দলের সেরা খেলোয়াড়কে হারিয়েও যে বার্সা লিগের শীর্ষে আছে, তাতে মূল অবদানও তাঁরই। মেসিহীন বার্সার মাঠের ‘নেতা’ নেইমারই। গোল করা বা করানোই বলুন, আর নিচ থেকে খেলা গড়ে দেওয়াই বলুন—নেইমারেই আবর্তিত হচ্ছে বার্সার খেলা, বেশির ভাগ সময় পূর্ণতাও পাচ্ছে নেইমারের পায়েই। মেসির অনুপস্থিতির সুযোগ মাঠে যে স্বাধীনতা পাচ্ছেন, সেটার পূর্ণ সুবিধাটাই তুলে নিচ্ছেন তিনি।

ব্যালন ডি’অরের ভোটাভুটি শুরু হয়েছে গত ২৬ অক্টোবর, শেষ হবে এই মাসের ২০ তারিখে। বড় ভালো সময়েই ‘পূর্ণ দ্যুতিতে’ জ্বলে উঠেছেন নেইমার। এ সময়ে তিন ম্যাচ খেলেছেন, তিনটিতেই ম্যান অব দ্য ম্যাচ। ঔজ্জ্বল্য ছড়াচ্ছেন গত মৌসুম থেকেই। বার্সেলোনার ট্রেবল জয়ের পেছনে মেসি প্রধান নায়ক ছিলেন, তবে পার্শ্বনায়ক হিসেবে নেইমারের ৩৯ গোলের ভূমিকাও কম নয়। সঙ্গে যোগ করুন চ্যাম্পিয়নস লিগের কোয়ার্টার ফাইনালের দুই লেগ, সেমিফাইনালের দুই লেগ ও ফাইনালের মতো গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচগুলোতে গোল করাটাও।

তবে গত ১২ মাসে ক্লাবের হয়ে রেকর্ডটা ভালো হলেও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একমাত্র ‘অ্যাসাইনমেন্টে’ অবশ্য হতাশ করেছেন ব্রাজিল অধিনায়ক। কোপা আমেরিকায় কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বাদ পড়েছে ব্রাজিল। দল তো খারাপ করেছেই, নেইমার নিজেও ডেকে এনেছেন অযাচিত কলঙ্ক। ভালোই খেলছিলেন টুর্নামেন্টে, প্রথম ম্যাচে এক গোল ও দুর্দান্ত এক অ্যাসিস্টও করেছিলেন। হঠাৎ কি হলো, কলম্বিয়ার বিপক্ষে দ্বিতীয় ম্যাচে মেজাজ হারিয়ে পেলেন লাল কার্ড। চার ম্যাচের নিষেধাজ্ঞাও জুটল তাতে।

কিন্তু সেটি মাথায় রাখলেও নেইমার কখনো কখনো ঔজ্জ্বল্যে মেসি-রোনালদোকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। সেই সঙ্গে তাঁর ২৩ বছর বয়সটাও বিবেচনা করবেন। রোনালদো বয়সের কাছে আত্মসমর্পণ করে ধার হারাচ্ছেন। এই মৌসুমে ১৭ ম্যাচে ১৩ গোল—যেকোনো ফরোয়ার্ডের জন্যই গর্ব করার মতো। কিন্তু বাস্তবতা হলো, রোনালদো লিগে ১১ ম্যাচের সাতটিতেই গোল পাননি। পুরো মৌসুমে ১৫ ম্যাচে গোল নেই নয়টিতেই!

মেসির সর্বনাশটা করেছে চোট। মাঠ ছাড়ার আগের ৯ ম্যাচে ৬ গোল করেছিলেন বার্সার ‘নাম্বার টেন’। কোপা আমেরিকার শিরোপা জিততে না পারলেও টানা দুটো বড় টুর্নামেন্টের ফাইনালে দলকে নিয়ে গেছেন, এও তো কম অর্জন নয়। সঙ্গে বার্সাকে আরও একবার ট্রেবল জেতানো—মেসির হাতে ব্যালন ডি’অর উঠবে এটা রোনালদোই মেনে নিচ্ছেন। কিন্তু ৩১-এর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা রোনালদো আর ২৯-এ পা দিয়ে ফেলা মেসির রাজত্ব শেষের পথে বলেই মনে হচ্ছে। অন্তত মেসি-রোনালদো দুজনের মধ্যে একজনকে জায়গা ছেড়ে দিতে হবেই নেইমারের কাছে।

তিনজনের কে কেমন করেছেন সেটি বিবেচনার সুবিধার্থে একটি তালিকা দেওয়া হলো। হুস্কোরড এই তালিকাটি করেছে গত বছরের ২২ নভেম্বরের পর থেকে এই পর্যন্ত লিগ ও চ্যাম্পিয়নস লিগে মেসি, নেইমার ও রোনালদোর পারফরম্যান্স নিয়ে। তাতে সব দিক বিবেচনায় একটু এগিয়ে থাকছেন লিওনেল মেসিই।

                    মেসি      নেইমার    রোনালদো
ম্যাচ               ৪৩          ৪৫         ৪৮
গোল               ৪৫         ৩৩          ৫০
ম্যাচ প্রতি গোল ০.৯৫৬    ০.৭৩       ০.৯৬
অ্যাসিস্ট            ১৬        ১২          ১৫
গোলে শট        ২১০      ১৪৯         ৩১২
গোল/শট
কনভারশন রেট  ২১.৪%   ২২.১%     ১৬%
কি পাস           ১০০      ১১৪         ৭৯

ড্রিবল             ২৪২      ১৭৮         ৭১
ট্যাকল             ৩২        ৬৪          ১৫

পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যাচ্ছে, গোলপোস্টের সামনে সবচেয়ে ভয়ংকর রোনালদো। তবে মেসিও খুব একটা পিছিয়ে নেই। আর গত ১২ মাসে নেইমারের ৩৩ গোল দেখালেও সংখ্যাটা আরও বাড়তে পারত। মেসি না থাকার সময়টাতে যে ৮ ম্যাচে তাঁর ১০ গোল। এই দ্বিমুখী ধরনের কারণ, মেসি মাঠে থাকলে নেইমারকে খেলতে হয় লেফট উইংয়ে। এখন যেমন মাঝ মাঠের দিকে ঘেঁষে এসে দলের খেলায় আরও বেশি সংযুক্ত হচ্ছেন, মেসি থাকার সময়ে এই স্বাধীনতাটা পান না নেইমার। সেই দায়িত্ব তখন মেসির কাঁধে পড়ে। স্প্যানিশ ফুটবল বিশেষজ্ঞ গিলেম বালেগও বলছেন, মেসি না থাকার এই সময়টাতে বলে নেইমারের টাচ, তাঁর গোল ও অ্যাসিস্টের সংখ্যা মেসি থাকার সময়ের চেয়ে দ্বিগুণ বেড়েছে।

বর্তমান ফুটবলে লেফট উইঙ্গারকে মাঝে মাঝে নিচে নেমে রক্ষণেও সাহায্য করতে হয়। যেটি ট্যাকলের পরিসংখ্যানেও বোঝা যাচ্ছে। অন্য দুজনের চেয়ে দ্বিগুণ এগিয়ে নেইমার। গোলের সুযোগ সৃষ্টিতে মেসি এগিয়ে থাকলেও ‘কি’ পাসের সংখ্যায় নেইমার তাঁকে ছাপিয়ে গেছেন। এটা হয়েছে ‘এমএসএন’ জুটির রসায়নের কারণে।

তবে ব্যালন ডি’অ​রের ফল নির্ধারিত হবে ভোটাভুটিতে, তাতে সংখ্যার চেয়েও হয়তো ভোটদাতার মনোভাবটাই বেশি প্রাধান্য পাবে। কে জিতবেন, সেটি তা-ই আগে থেকে অনুমান করা যাচ্ছে না। তার জন্য অন্তত আরও ৬০ দিন অপেক্ষা করতেই হচ্ছে। তবে সম্ভাবনার বিচারে ২০১৬ সালের ১১ জানুয়ারি জুরিখের মঞ্চে রোনালদো বা নেইমারকে দর্শক বানিয়ে ক্যারিয়ারে পঞ্চমবারের মতো বর্ষসেরা হওয়ার সম্ভাবনাটা বেশি মেসিরই।
আর স্প্যানিশ ফুটবল বিশেষজ্ঞ গিলেম বালেগের বিশ্বাস, বর্ষসেরা হতে না পারলেও রোনালদোকে ছাপিয়ে বর্তমানে দ্বিতীয় সেরা ফুটবলার নেইমার। আর এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারলে মেসি-রোনালদো যুগের শেষ হবে, শুরু হবে মেসি-নেইমার যুগ। আর কে জানে, রোনালদো দৃশ্যপট থেকে সরে গেলে মেসিও হয়তো আগের মতো ক্ষুধার্ত থাকবেন না। গোলের চেয়ে খেলা বানিয়ে দেওয়াতেই ​মনোযোগী হবেন বেশি। কে জানে, এখান থেকেই হয়তো শুরু হচ্ছে নেইমার যুগের!

তবে শর্ত ওই একটাই—ধারাবাহিকতা। এক মৌসুমে অবিশ্বাস্য জ্বলে উঠেছেন আরও অনেকেই। কিন্তু মেসি-রোনালদোর মতো প্রতি মৌসুমেই নিজেই নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার নেশায় বুঁদ হয়ে ভালো থেকে আরও ভালো খেলার চ্যালেঞ্জটা কেউ নিতে পারেনি। নেইমারের জন্য এটাই এখন সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। তথ্যসূত্র: স্কাই স্পোর্টস।