মোনেম মুন্নার মৃত্যুর ১১ বছর পর তা জেনেছিলেন অটো ফিস্টার
![মুন্নার মৃত্যু সংবাদ ফিস্টার শোনেন ১১ বছর পর! ফাইল ছবি](https://images.prothomalo.com/prothomalo%2Fimport%2Fmedia%2F2018%2F04%2F30%2F83b0b05215e80866b63933a285fdf612-5ae70a3dc692b.jpg?auto=format%2Ccompress)
অটো ফিস্টারকে মনে আছে? বাংলাদেশে যতজন বিদেশি কোচ এসেছেন, তাঁদের মধ্যে নিঃসন্দেহে সেরা ছিলেন এই জার্মান। ১৯৯৫ সালে মিয়ানমারে চার জাতি প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ শিরোপা জিতেছিল তাঁর অধীনেই। সে দলের অধিনায়ক ছিলেন প্রয়াত মোনেম মুন্না। ২০০৫ সালে মুন্নার মৃত্যুর সংবাদটি ফিস্টার পেয়েছিলেন অনেক বছর পর।
‘মুন্না ওয়াজ মিসটেকেইনলি বর্ন ইন বাংলাদেশ’—প্রয়াত মোনেম মুন্নার খেলা দেখে আজ থেকে অনেক বছর আগে এমন মন্তব্যই করেছিলেন জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক জার্মান কোচ অটো ফিস্টার। একজন ফুটবলারের খেলা কতটা মুগ্ধ করলে একজন কোচ এমন মন্তব্য করতে পারেন। ১৯৯৫ সালে মোনেম মুন্নার অধিনায়কত্বে আর বিশ্বখ্যাত এই কোচের অধীনেই মিয়ানমারে চার জাতি ফুটবল টুর্নামেন্টের শিরোপা জিতেছিল বাংলাদেশ। যত দিন ফিস্টার কোচ ছিলেন, মুন্না ছিলেন তাঁর স্নেহধন্য। কিন্তু অবাক হতে হয়, মুন্নার মৃত্যুসংবাদ ফিস্টার শুনেছেন তাঁর মৃত্যুর ১১ বছর পর!
ব্যাপারটা নিজেই প্রথম আলোকে বলেছেন ফিস্টার। ছেলে মাইক ফিস্টারের কাছ থেকে ২০১৬ সালে জানতে পারেন, মুন্না আর বেঁচে নেই। ব্যাপারটা ছিল তাঁর কাছে খুব কষ্টের, ‘মুন্নার মৃত্যুর খবর আমি জানি তাঁর মৃত্যুর ১১ বছর পর। ছেলে মাইক বাংলাদেশ থেকে এসে জানায় সংবাদটা। খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। মনে হয়েছিল কোনো আত্মীয়কে হারালাম।’
২০১৬ সালের দিকে ফিফার ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার হিসেবে মাইক এসেছিলেন বাংলাদেশে। ছেলের কাছ থেকে শিষ্যের মৃত্যুর খবরটা শোনার আগে বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো সম্পর্কই ছিল না ফিস্টারের। আসলে ১৯৯৭ সালে তাঁর বিদায়টা খুব সম্মানজনক ছিল না। সেবার নেপালে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে গ্রুপ পর্ব থেকে বাদ পড়ার পর ফিস্টারকে বিদায় বলে দেয় বাফুফে। সেই ক্ষোভ থেকেই হয়তো বাংলাদেশের কারও সঙ্গে যোগাযোগ রাখেননি। এখনকার মতো প্রযুক্তিগত সুবিধা না থাকার কারণে যোগাযোগ রাখাটাও হয়তো খুব সহজ ছিল না। তা ছাড়া, বাংলাদেশ থেকে যাওয়ার পর ফিস্টারের ব্যস্ততাও ছিল যথেষ্ট। তাঁর অধীনেই ১৯৯৮ বিশ্বকাপে সৌদি আরব আর ২০০৬ সালে টোগো বিশ্বকাপে খেলার ছাড়পত্র আদায় করে নিয়েছিল।
মুন্না সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়ন অনেকটা এমন, ‘দুর্দান্ত ফুটবলার ছিল মুন্না। মাঠের জাত নেতা ছিল সে।’ ১৯৯৫ সালে মিয়ানমারে শিরোপা জেতা বাংলাদেশ দলটাই ফিস্টারের কাছে অন্য রকম, ‘আমি খুব ভালো একটা প্রজন্ম পেয়েছিলাম। মুন্না তো ছিলই, সঙ্গে ছিল মামুন জোয়ার্দার, আরমান, রকিব, নকিব, রনজন, মিজান ও মাসুদ রানাদের মতো খেলোয়াড়। সত্যি বলতে কী, নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের ফুটবল যথেষ্ট শক্তিশালীই ছিল।’
মিয়ানমারের সেই শিরোপা আজও রোমাঞ্চিত করে ফিস্টারকে, ‘আমি এত বছর পরও সেই শিরোপা জয়ের মুহূর্তগুলো মনে রেখেছি। আমাদের প্রস্তুতিও ছিল ভালো। ফেডারেশন সেই টুর্নামেন্টে ভালো করার জন্য অনেক সুযোগ-সুবিধা করে দিয়েছিল। সবকিছু মিলিয়েই এসেছিল শিরোপা।’
তবে ফিস্টারকে পোড়ায় ১৯৯৫ মাদ্রাজ (এখন চেন্নাই) সাফ গেমসের ফুটবলে সোনা জিততে না পারাটা, ‘পুরো গেমসেই আমরা ছিলাম দুর্দান্ত। অসাধারণ খেলেছিল বাংলাদেশ। ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে আমরা ১-০ গোলে হেরে যাই। সে হারটা আমি আজও মানতে পারি না। ওই ম্যাচে আমাদের দুর্ভাগ্যও ছিল। মিজানের একটা দারুণ হেড মনে হচ্ছিল গোলে চলে যাচ্ছে, কিন্তু সেটা ক্রসবারে লেগে ফিরে এল। গোলটি হয়ে গেলে ম্যাচের ফল অন্য রকম হতে পারত। বাংলাদেশ খুব ভালো খেলছিল।’
বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলে এখনো পর্যন্ত যতজন কোচ এসেছেন, তাঁদের মধ্যে নিঃসন্দেহে ফিস্টার ছিলেন সেরা। নিজের ক্ষুরধার ফুটবলমস্তিষ্ক দিয়ে ফুটবল দুনিয়াতেই অন্যতম সমাদৃত ব্যক্তিত্ব তিনি। অথচ, ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ একেবারে বিনে পয়সাতেই তাঁকে কোচ হিসেবে পেয়েছিল। বাংলাদেশ-জার্মানি সাংস্কৃতিক বিনিময় চুক্তির অধীনে তাঁকে পাঠিয়েছিল জার্মান সরকার। তাঁর বেতন-ভাতা পরিশোধ করত জার্মান সরকারই। এমন একজন কোচ বাংলাদেশে কাজ করতে এসে প্রায় বসে বসেই কাটিয়ে দিয়েছিলেন দুটি বছর।
৮০ বছর বয়সে বাংলাদেশের ফুটবলের খবর পান। এ দেশের ফুটবলটা যে ঠিকপথে নেই, সেটাও জানেন। তবে ফুটবলের বর্তমান অবস্থা নিয়ে কোনো মন্তব্য নেই তাঁর। তবে তাঁর হৃদয়ে বাংলাদেশ আছে। আছেন মোনেম মুন্না। মামুন জোয়ার্দার, মাসুদ রানা, আরমান, রকিব, মিজানরা। প্রিয় শিষ্যদের সঙ্গে দুই দশক আগের সুখস্মৃতি রোমন্থনেই তাঁর আনন্দ।