মোহনবাগান ও সালাউদ্দিনের সেই গোল!

১৯৭২ সালে ঢাকা একাদশ ও মোহনবাগানের সেই ম্যাচটি। ছবি: সংগৃহীত।
১৯৭২ সালে ঢাকা একাদশ ও মোহনবাগানের সেই ম্যাচটি। ছবি: সংগৃহীত।

মনে আছে সেই গোলটি? কাজী সালাউদ্দিন ফিরে যান বাহাত্তরের প্রথম দিকে। স্মৃতিতে তুলে আনেন কলকাতা মোহনবাগানের বিপক্ষে ঢাকা একাদশের জার্সি গায়ে জীবন্ত হয়ে থাকা স্মরণীয় সেই গোলটির মুহূর্ত, ‘মাঝমাঠে ফাউল পেলাম আমরা, ফ্রি-কিক। তারপর কায়কোবাদ বলটা সেন্টার করলে আমি তা অনুসরণ করছিলাম। দুজন ডিফেন্ডার আসছিল, বল বাতাসে রেখেই সাইড ভলিতে দ্বিতীয়বার দিয়ে জালে পাঠাই। এয়ার থেকে এয়ারে গোল। ওই গোলটা আমার জীবনই দিল পাল্টে।’

সত্যিই তাই। সালাউদ্দিন নতুন দিনের ঠিকানা খুঁজে নিয়েছিলেন সেই গোলে । স্বাধীনতার পর হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের ফুটবলে সবচেয়ে বড় তারকা। নিজেই বলেন,‘ মোহনবাগানের বিপক্ষে ওই গোল আমাকে মানুষের আরও কাছে পৌঁছে দেয়। নিজের মধ্যে তারকা তারকা অনুভূতি হতো তখন।’
৪৫ বছর পেছনে তাকিয়ে পাকিস্তান দলে খেলা সাবেক ফুটবলার ও কোচ গোলাম সারওয়ার টিপুও সেটিই বলছেন, ‘এই গোলটিই সালাউদ্দিনকে সালাউদ্দিন হওয়ার পথে এগিয়ে নেয়।’ আর মোহনবাগানের বিপক্ষে ওই গোলের পরদিন দৈনিক বাংলায় ক্রীড়া সাংবাদিক কামরুজ্জামান লিখেছিলেন ‘সালাউদ্দিন বাংলাদেশের ফুটবলে ভরসা দিল। তাঁর অসাধারণ গোলটি অনেক দিন মনে রাখবেন দর্শকেরা।’
এত দিন পর গোলটির স্মৃতি রোমন্থন করার কারণ আজ বাংলাদেশের ফুটবলে ‘মোহনবাগান’ নামটা ঘুরে ফিরে আসছে। সেটি এএফসি কাপের কল্যাণে। এশিয়ার দ্বিতীয় সেরা ক্লাব টুর্নামেন্টে আজ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় কলকাতায় নিজেদের মাঠে ঢাকা আবাহনীর মুখোমুখি হবে মোহনবাগান। ফুটবল রোমান্টিকদের এই ম্যাচটা ফিরিয়ে নিচ্ছে স্বাধীনতার পর ফুটবলেরই সেই নস্টালজিয়ার দিনগুলিতে।
এমনিতে কলকাতার দলগুলোর সঙ্গে ঢাকার দলগুলোর সাক্ষাৎ হয় খুবই কম। আবাহনী-মোহনবাগান তো কালেভদ্রে। ১৯৯০ সালে ফেনীতে আজমেরী বেগম গোল্ডকাপে এই মোহনবাগানকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল আবাহনী। সেদিন আকাশি নীলের অধিনায়ক ছিলেন দলটির আজকের ম্যানেজার সত্যজিৎ দাশ রুপু। ওই বছর কেরালায় আবাহনী যে নাগজি ট্রফি জিতেছিল, সেটিও এই মোহনবাগানকে হারিয়েই। কিন্তু ২৬ বছর পর আজ মোহনবাগানের বিপক্ষে আরেকটি জয়ের আশা করার সাহস আবাহনী পাচ্ছে না। কারণ, এই আবাহনী ভঙ্গুর। রক্ষণ দুর্বলতা প্রবল। মাঝমাঠে খেলা তৈরি করার মতো নির্ভরযোগ্য চরিত্র নেই। গোল করার খেলোয়াড়ের অভাব—সে তো বাংলাদেশের ফুটবলেরই ক্লিশে হয়ে যাওয়া গল্প।
স্বাধীনতার পরপরই ১৯৭২ সালে প্রথম কোনো বিদেশি দল হিসেবে মোহনবাগানই ঢাকায় এসেছিল । বাংলাদেশ জাতীয় দলের আড়ালে ‘ঢাকা একাদশ’ ছিল তাদের প্রতিপক্ষ। তখনো আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের জাতীয় ফুটবল দলের অস্তিত্ব নেই, জাতীয় দল গড়া হয়েছিল আরও পরে, ১৯৭৩ সালে, মালয়েশিয়ার মারদেকা কাপে। যাই হোক, ওই ঢাকা একাদশ-মোহনবাগান প্রীতি ম্যাচ দেখতে ঢাকা স্টেডিয়ামের গ্যালারি পরিপূর্ণ। মোহনবাগানও ছিল দারুণ শক্তিশালী দল। তারায় তারায় পূর্ণ। ব্রাদার্সের কোচের ভূমিকায় সাম্প্রতিক সময়ে একাধিকবার ঢাকায় কাজ করা সৈয়দ নঈমউদ্দিন তখন মোহনবাগানের ফুটবলার এবং অবশ্যই বড় তাস। ভারতীয় ফুটবল কিংবদন্তি চুনি গোস্বামী সেই দলের অলংকার। দলটা ছিল অলিখিতভাবে ভারতের জাতীয় ফুটবল দলই।
সে সময় ভারতের ফুটবল বলতে বোঝাত বাংলাকেই, নির্দিষ্ট করে বললে কলকাতাকেই। মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, মোহামেডান, এই দলগুলোর হাতে থাকত ভারতীয় ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্বের পতাকা। বাহাত্তরে মোহনবাগানের সেই ঢাকা সফরের ওই সময় ভারত ছিল এশীয় ফুটবলের অন্যতম বড় শক্তি। দুর্ধর্ষ দল। ১৯৬৪ সালে এশিয়ান কাপে রানার্সআপ হয়েছিল তারা। সেই ভারত মাঝখানের বহু বছর পথ হারালেও আবারও খুঁজে নিয়েছে পথের দিশা। বাংলাদেশের ফুটবল তো রংই হারিয়ে ফেলেছে।
সবুজ মেরুন জার্সিধারীদের জালে সালাউদ্দিনের সেই গোলটির কথা কী জানেন আবাহনীর আজকের ফুটবলাররা? হয়তো জানেন, আবার জানেনও না! তবে মোহনবাগানের জালে আবারও বল পাঠিয়ে কেউ যদি নায়ক হতে পারেন, তাতেই কিন্তু লাভ বাংলাদেশের ফুটবলের।