রোনালদো রিয়ালকে চান, রিয়াল তাঁকে চায় না

চ্যাম্পিয়নস লিগে জুভেন্টাসের হয়ে এবারও শেষ ষোলোতে বাদ পড়েছেন রোনালদো।ছবি: রয়টার্স

যদি নতুন কোনো প্রেমের সম্পর্কের মতো করে ভাবতে চান, সে ক্ষেত্রে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর এখন একপক্ষীয় প্রেম। নতুন প্রেমে পড়া প্রেমিকের মতো, প্রেমিকার—বা এ যুগের হিসাবে বলা যায় ‘ক্রাশে’র—সাড়া পাওয়ার অপেক্ষায় কাটছে যাঁর সময়। রোনালদো আছেন রিয়াল মাদ্রিদের হাতছানির অপেক্ষায়।

আর যদি পুরোনো সম্পর্ক জোড়া লাগার মতো করে ভাবতে চান, সে ক্ষেত্রে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো আর রিয়াল মাদ্রিদ সম্পর্কে বিচ্ছেদ টেনে দেওয়া দুজন, যাঁদের একজনের আবার সম্পর্ক জোড়া লাগানোর ইচ্ছা। কিন্তু আগ্রহের পারদে অন্যজনের প্রায় বিপরীতে অবস্থান।

স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যমের গুঞ্জন তা-ই বলছে। তিন বছর আগে নতুন কিছুর স্বাদ পাওয়ার আশায় রিয়াল ছেড়ে রোনালদো পাড়ি জমিয়েছিলেন ইতালিতে, জুভেন্টাসে। উত্থানের চেয়ে পতনে ভারী নতুন সম্পর্কে এখন রোনালদো-জুভেন্টাস দুপক্ষেরই ভালোবাসা উবে গেছে। রোনালদো পুরোনো প্রেমে ফিরতে চান।

কিন্তু স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যম দেপোর্তেস কুয়াত্রো জানাচ্ছে, যতই গোল করে যান, খেলোয়াড়ি ক্যারিয়ারের যৌবন পেরিয়ে বার্ধক্যে চলে আসা এই রোনালদোকে ফিরিয়ে নিতে চায় না রিয়াল।

গত সপ্তাহে চ্যাম্পিয়নস লিগের শেষ ষোলোতে রোনালদোরই দেশের ক্লাব পোর্তোর হাতে শেষ হয়েছে জুভেন্টাসের স্বপ্ন। রোনালদো যাওয়ার পর তিন মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগে কোয়ার্টার ফাইনাল পেরোনো হয়নি জুভের, এ নিয়ে দুই মৌসুমে বাদ পড়ল শেষ ষোলোতে। অথচ রোনালদো যাওয়ার আগের তিন মৌসুমে জুভ দুবার ফাইনাল খেলেছে! রিয়াল ছেড়ে ২০১৮ সালে রোনালদো সেখানে গিয়েছিলেনই ইতালিয়ান ক্লাবটিকে চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতানোর ‘চ্যালেঞ্জ’ নিয়ে।

পোর্তোর কাছে বাদ পড়ার পর হতাশ রোনালদো।
ছবি: রয়টার্স

চ্যালেঞ্জ? নাকি মোহ? রিয়ালে টানা তিনটিসহ পাঁচ মৌসুমে চারটি চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার পর রোনালদোর উঁচু বেতনের দাবি ছিল, তা মানেনি রিয়াল। জুভেন্টাস সেই সুযোগটা নিয়েছে। ইতালিতে আয়ের ওপর ২৫ শতাংশ কর দিতে হয়, ইংল্যান্ড-স্পেনে যে সুযোগ নেই।

এ তো গেল অর্থের মোহ, ক্যারিয়ারজুড়ে রেকর্ডকে ‘প্রিয় শিকার’ বানিয়ে রাখা রোনালদো ৩৩ বছরে জুভেন্টাসে যাওয়ার পেছনে রেকর্ডের নির্দোষ মোহও কি ছিল না? ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড আর রিয়াল মাদ্রিদের পর জুভেন্টাসে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতবেন, জুভেন্টাসে জিতলে সেটি হতো ক্লাবটিতে ১৯৯৬ সালের পর প্রথম চ্যাম্পিয়নস লিগ...রোনালদোর এই মোহে আসক্ত না হওয়ার কারণ ছিল না।

কিন্তু তিন বছর পেরিয়ে মোহভঙ্গ হলো। চ্যাম্পিয়নস লিগ তো জেতা হলোই না, যে ইতালিয়ান লিগ রোনালদো যাওয়ার আগেই চোখ বন্ধ করে জিতে চলেছিল জুভেন্টাস, সেটিও এবার হারানোর পথে। লিগে শীর্ষে থাকা ইন্টার মিলানের চেয়ে এক ম্যাচ বেশি খেলে ১০ পয়েন্ট পিছিয়ে আন্দ্রেয়া পিরলোর জুভেন্টাস।

সঙ্গে যোগ করে নিন করোনার প্রভাব। রোনালদোর বেতন আর পোষাতে পারছে না জুভ। ৩৬ বছর বয়সী পর্তুগিজের চুক্তিতে আরও এক বছর বাকি থাকলেও তাঁর গায়ে ‘বিক্রি হইবে’ ট্যাগ লাগিয়ে দিয়েছে ইতালিয়ান ক্লাবটি।

রিয়ালে রোনালদোর শেষ দিন।
ছবি: এএফপি

জুভেন্টাস চ্যাম্পিয়নস লিগ থেকে বাদ পড়ার পর থেকেই রোনালদোর ক্লাব ছাড়ার গুঞ্জন ভাসছে। এর মধ্যে স্প্যানিশ টিভি অনুষ্ঠান এল চিরিঙ্গিতোতে বিখ্যাত সাংবাদিক ইয়োসেপ পেদ্রেরোল বোমা ফাটিয়েছেন। জানালেন, রোনালদোর এজেন্ট জর্জ মেন্দেস রিয়াল মাদ্রিদের সঙ্গে কথা বলছেন। আলোচনার বিষয়, রোনালদো-রিয়াল পুনর্মিলনী।

রোনালদো রিয়াল ছেড়ে ভালো নেই, রিয়ালও বা রোনালদোকে ছেড়ে দিয়ে কী এমন হাতি-ঘোড়া মেরেছে? গত মৌসুমে লিগ জিতেছে বটে, তবে সেটি জিনেদিন জিদানের কৌশল আর রক্ষণের শক্তিতে। এই মৌসুমে রক্ষণ আবার ভঙ্গুর। আক্রমণে রোনালদোর মৌসুমপ্রতি ৪০ থেকে ৫০ গোলের শূন্যতা পূরণ করা হয়নি। সেটির মূল্য দিতে হচ্ছে চ্যাম্পিয়নস লিগে।

এই মৌসুমে শেষ ষোলোতে আতালান্তার মাঠে দ্বিতীয় লেগ এখনো বাকি, প্রথম লেগে নিজেদের মাঠে ১-০ গোলে জিতেছে জিদানের দল। তার আগের দুই মৌসুমে? রোনালদো যাওয়ার পরের মৌসুমে বাদ পড়েছে শেষ আটে, যেটির পর রোনালদোর পাশাপাশি ২০১৮ সালে ক্লাবের ডাগআউট ছেড়ে যাওয়া জিদানকে ফেরানো হয়েছে। গত মৌসুমে রিয়াল বাদ পড়েছে শেষ ষোলোতে। এবার শেষ ষোলোর বৈতরণি পার না হতে পারলে বিচ্ছেদের পর থেকে চ্যাম্পিয়নস লিগে রোনালদো আর রিয়ালের রেকর্ড একই থাকবে!

বিচ্ছেদটা তাই দুই পক্ষের কারও জন্যই লাভজনক হয়নি, তা বোঝাই যায়। কিন্তু বিচ্ছেদটা তখন পারস্পরিক সম্মতিতে হয়েছিল। রিয়ালের এখন মনে হচ্ছে, সে অধ্যায় শেষ, দুজনের দুটি পথ বেঁকে গেছে দুদিকে। রিয়ালের চোখ এখন হালের সেনসেশন আর্লিং হরলান্ড আর কিলিয়ান এমবাপ্পের দিকে। বয়স পেছনে ফেলে আসা রোনালদোর উঁচু বেতন, তাঁকে পেতে গেলে হরলান্ড-এমবাপ্পেদের হারানোর ঝুঁকি, সব বিবেচনায় নিয়ে রোনালদোকে শুধু পুরোনো দিনের মধুর স্মৃতিতেই রাখতে চায় রিয়াল। যে স্মৃতি জানাবে, একসঙ্গে হাত ধরে হাঁটার সময়গুলো সুন্দর ছিল।

রিয়ালে রোনালদোর প্রথম দিন।
ছবি: এএফপি

তবে রোনালদো ‘সাদা হাতি’ হলেও এখনো মরা হাতি তো নন! জুভেন্টাস রোনালদোকে বাজারে তুলছে, রিয়াল তাঁকে পাশ কাটিয়ে অন্যদিকে তাকাচ্ছে—আর এই সুযোগটা নিতে চাইছে ফরাসি ক্লাব পিএসজি। এমনটাই জানাচ্ছে স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যম দেপোর্তেস কুয়াত্রো।

এমবাপ্পে যদি রিয়াল কিংবা লিভারপুল অথবা অন্য কোনো দলে চলে যান, আর বার্সেলোনা থেকে যদি লিওনেল মেসি না আসেন, সে ক্ষেত্রে রোনালদোকে দলে টানতে চাইবে ফরাসি ক্লাবটি।

গত মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে খেলা পিএসজি এবার মেসির বার্সাকে গুঁড়িয়ে দিয়ে শেষ আটে উঠে গেছে। জুভেন্টাস কিংবা রিয়ালের চেয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের সম্ভাবনায়-শক্তিতে প্যারিসের ক্লাবটিই এই মুহূর্তে এগিয়ে আছে বটে!

এত গুঞ্জনের মধ্যে কাল রিয়াল মাদ্রিদের সংবাদ সম্মেলনে জিদানকে প্রশ্ন করা হয়েছিল রোনালদোর সম্ভাব্য প্রত্যাবর্তন নিয়ে। রিয়াল কোচ কোনো সরাসরি উত্তর দেবেন না, তা অনুমিতই ছিল। তবে প্রশ্ন যেখানে ভবিষ্যৎ জড়িয়ে, রিয়াল কোচের উত্তরটা হলো ‘অতীত কাল’ সূচক শব্দে, ‘ক্রিস্টিয়ানো রিয়ালের জন্য কী, সেটা আপনারা জানেন। ও এখানে কী করেছে, ওকে আমরা কতটা ভালোবাসি। ও এখানে যেটা করেছে, সেটা ইতিহাসে লেখা থাকবে। এই স্মৃতিগুলো মধুর। কিন্তু ও এখন জুভের খেলোয়াড়, ওখানে দারুণ করছে। এমন গুঞ্জন তো অনেকই শোনা যায়।’