লিভারপুলকে শোকসাগরে ভাসিয়ে দেওয়া ঘটনার আজ ৩৬তম বার্ষিকী। সেই উপলক্ষে লেখাটি কিছু পরিমার্জনের পর পুনঃপ্রকাশ করা হলো।
‘প্রতি বার আমি যখন অ্যানফিল্ড যাই, শ্যাঙ্কলি গেটের কাছে এসে থেমে যাই খানিক। হিলসবরো মেমোরিয়ালের দিকে চোখ চলে যায় আমার। সেই ৯৬ জন লিভারপুল সমর্থক, যারা ১৯৮৯ সালের এফএ কাপ সেমিফাইনাল দেখতে গিয়ে কখনও ঘরে ফেরেনি, তাঁদের উদ্দেশ্যে দেওয়া মানুষের শ্রদ্ধার্ঘ্য দেখতে থাকি। আমার গাড়ি আস্তে আস্তে যখন স্মৃতিস্মারকটা অতিক্রম করতে থাকে, তখন আস্তে আস্তে ওই ৯৬ জন মানুষের নাম পড়তে থাকি। আমার চোখ চলে যায় একজনের নামের দিকে - জন-পল গিলহুলি, দশ বছর বয়সী সেই লিভারপুল সমর্থক, যে সেদিন শেফিল্ড থেকে আর ফেরেনি। আমি জন-পলকে চিনতাম। ও আমার চাচাত ভাই...’
লিভারপুল কিংবদন্তি স্টিভেন জেরার্ডের প্রথম আত্মজীবনী ‘স্টিভেন জেরার্ড - মাই অটোবায়োগ্রাফি’-র প্রথম অধ্যায়ের শুরু দিককার কিছু লাইন।
বইটা শুরুই হয়েছে হিলসবরো মেমোরিয়াল নিয়ে তাঁর যাতনা, আর চাচাত ভাই জন-পলকে হারানোর আক্ষেপ দিয়ে। সেই জন-পল, যে ফুটবলার হওয়ার পেছনে ছিল স্টিভেন জেরার্ডের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। ‘জন-পল মারা গেছে...’— সংবাদটি আশৈশব তাড়িয়ে বেড়িয়েছে জেরার্ডকে। লিভারপুলের জার্সি গায়ে জড়ানোর স্বপ্ন জন-পলের মনেও যে উঁকি দেয়নি, সেটাও কি নিশ্চিতভাবে বলা যায়? যে স্বপ্ন ভাই পূরণ করতে পারেনি, সে স্বপ্ন নিজেই পূরণ করবেন - এটাই হয়ে গেল জেরার্ডের জীবনের লক্ষ্য। ভাইয়ের অপূর্ণ আশাকে পূরণ করার জন্যই গোটা ক্যারিয়ার উৎসর্গ করেছেন জেরার্ড। আলোঝলমলে ক্যারিয়ারের একটাই আক্ষেপ, প্রিমিয়ার লিগটা জেতা হয়নি শুধু। এ ছাড়া লিভারপুলের দশজন সমর্থককে জিজ্ঞেস করা হলে অন্তত নয়জন লিভারপুল ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম খেলোয়াড় হিসেবে জেরার্ডের নাম বলবেনই।
প্রিয় ক্লাবের হয়ে ভাইয়ের অর্জন দেখে আকাশের থেকে নিশ্চয়ই স্মিত হাসি হাসবেন পল। আনন্দে ভরে উঠবে তার মন। লিভারপুলের প্রতি তার অকুণ্ঠ ভালোবাসা - যে ভালোবাসার দাম প্রাণ দিয়ে চুকিয়েছে সে, সেই প্রাণাধিক ভালোবাসা যে সার্থক করেছেন জেরার্ড!
শুধু জেরার্ডই নন, লিভারপুলের প্রতিটা মানুষের ওপর হিলসবরোর প্রভাব এমনই পরিব্যপ্ত। লিভারপুলকে শোকসাগরে ভাসিয়ে দেওয়া ঘটনার আজ ৩৬ তম বার্ষিকী। অ্যানফিল্ড জুড়ে আজ শুধুই হিলসবরোর দুঃসহ স্মৃতি। লিভারপুলের ইতিহাস বলুন কিংবা ইংল্যান্ডের ফুটবল ইতিহাস, অথবা গোটা বিশ্বের ফুটবল ইতিহাসেই একটা মর্মান্তিক দিন ১৯৮৯ সালের ১৫ এপ্রিল। শেফিল্ড ওয়েনসডে ক্লাবের হিলসবরো স্টেডিয়ামে সেদিন এফএ কাপের সেমিফাইনালে লিভারপুল-নটিংহাম ফরেস্ট ম্যাচের সময় হুড়োহুড়িতে পদপিষ্ট হয়ে মারা গিয়েছিলেন ৯৭ জন লিভারপুল–সমর্থক।
দুই দলের সমর্থকদের সংঘর্ষ যাতে না হয়, সে জন্য স্টেডিয়ামে নির্ধারিত করে দেওয়া হয়েছিল নির্দিষ্ট গ্যালারি। ঐতিহ্য আর সমর্থনে বড় ক্লাব হওয়ার পরেও লিভারপুলের জন্য নির্ধারিত জায়গাটা ছিল বেশ ছোট। কিন্তু দর্শক হয়েছিল নির্ধারিত আসনসংখ্যার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি।
আসনসংখ্যার অপ্রতুলতা প্রিয় ক্লাবের ম্যাচ দেখার ইচ্ছের চেয়ে বড় হতে পারেনি লিভারপুল-ভক্তদের কাছে। দর্শকের চাপ সামলাতে না পেরে ম্যাচ শুরুর অল্প কিছুক্ষণ আগে ম্যাচের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা নির্দেশ দিলেন আরও একটি প্রবেশদ্বার খুলে দিতে। তাতেও কী সমস্যা মিটেছিল! ওই পথ দিয়ে স্টেডিয়ামের যে অংশে যাওয়া যেত, গ্যালারির ওই অংশগুলো পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল আগেই।
ধারণক্ষমতার দ্বিগুণেরও বেশি দর্শক এমনিতেই জায়গার অভাবে হাঁসফাঁস করছিলেন, তার ওপর পেছনের মানুষের চাপে ভিড়ের সামনের মানুষগুলো চিড়ে-চ্যাপটা হতে থাকেন। অনেকে ঝুঁকি নিয়ে ওপরের গ্যালারিতে উঠতে চেয়েও পারেননি। সে জায়গাও যে দর্শক পরিপূর্ণ ছিল!
ফলে সামনের নিরাপত্তাবেষ্টনীর সঙ্গে সেঁধিয়ে যেতে থাকেন তাঁরা। প্রবল জনস্রোত সইতে না পেরে একপর্যায়ে ভেঙে যায় নিরাপত্তাবেষ্টনী। লাফিয়ে মাঠে পড়তে থাকেন দর্শকেরা। ফলে যা হওয়ার, তাই হয়েছিল। এই হুড়োহুড়িতে পায়ের তলায় চাপা পড়ে ঘটনাস্থলেই নিহত হন বেশির ভাগ লিভারপুল–সমর্থক।
পরে জানা গিয়েছিল, সব মিলিয়ে সংখ্যাটা ৯৬। পরে আরও একজন প্রাণ হারান। আহত হয়েছিলেন আরও ৭৬৬ জন। দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, এই দুর্ঘটনাস্থল থেকে সেদিন মাত্র ১৪ জনকে হাসপাতালে নেওয়া সম্ভব হয়েছিল। যা আয়োজকদের ব্যবস্থাপনার দিকেও প্রশ্নের আঙুল তুলেছিল। ফুটবলকে ভালোবেসে এমন মৃত্যু, কে মানতে পারে!
৩৬ বছর পর আজও বন্ধু-স্বজনদের এমন মৃত্যু মানতে পারেন না জেরার্ডের মতো আরও হাজার-হাজার লিভারপুল ভক্ত। এই দিন এলে যেন শোকের চাদরে ঢেকে যায় গোটা লিভারপুল শহর। হিলসবরো স্মৃতিস্মারকে ফুলেল ভালোবাসায় সিক্ত হন মহাপ্রয়াণে বিদায় নেওয়া ৯৭ সমর্থক। নিজের কাজে বসে না লিভারপুল বাসিন্দাদের বেদনার্ত মন। বুকের ওপর ভার হয়ে চেপে বসে পরপারে পাড়ি জমানো বন্ধু-আত্মীয়ের হাজারো স্মৃতি।
আর যাঁরা সেদিন মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফিরেছিলেন? জীবিত থেকেও যেন জীবন্মৃত হয়েই আছেন তাঁরা। চোখের সামনে তাঁদের মতোই ফুটবলপাগল মানুষের মৃত্যুদৃশ্য সহ্য করার মানসিক শক্তি তাঁদের অনেকেরই ছিল না, এখনও নেই। যার প্রভাব পড়েছে তাঁদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও পেশাগত জীবনে। স্টিভেন হোয়াইটলের কথাই ধরা যাক।
সেদিন হিলসবরোতে অবশ্য ছিলেন না হোয়াইটল। ভাগ্যের ফেরে বেঁচে গিয়েছিলেন, কিন্তু ওই ‘ভাগ্য’ই তাঁর জীবনকে করে তুলেছিল দুঃসহ। আজীবন লিভারপুল ভক্ত হোয়াইটল সেদিন ম্যাচটা সশরীরে দেখতেই চেয়েছিলেন। তাঁর কাছে সেদিনের ম্যাচটার টিকিট ছিল। কিন্তু অফিসের কাজ পড়ে যাওয়ায় হিলসবরো যাওয়া হয়নি। যেতে পারছেন না দেখে টিকিটটা এক বন্ধুকে দিয়ে দিয়েছিলেন হোয়াইটল। তাঁর পরবর্তী জীবনের গল্পও হয়তো ওই এক টিকিটেই লেখা হয়ে গিয়েছিল। যে বন্ধুকে টিকিট দিয়েছিলেন, তাঁর নামও ঢুকে গেছে না-ফেরার দেশে চলে যাওয়া ৯৭ জনের তালিকায়।
তাঁর জন্য এক বন্ধুকে প্রাণ দিতে হয়েছে, ব্যাপারটা কখনই মানতে পারেননি হোয়াইটল। ‘সারভাইভারস গিল্ট’ বলে যে একটা ব্যাপার থাকে, সেটাই তাঁকে তাড়া করে বেড়িয়েছে বাকি জীবন। চেষ্টা করেছিলেন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার, পারেননি। পরের ২২ বছর ধরে বন্ধুর মৃত্যুর জন্য নিজেকে দায়ী করে গেছেন। মানসিক ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠতে লড়াই করে গেছেন। জিততে পারেননি। মনোবিদের সাহায্য নিতে বেধেছে। বিষণ্নতা কাটাতে ওষুধ খেয়েছেন, কিন্তু মনের ক্ষত সেরেছে কই! সারাজীবন তিল তিল করে জমানো অর্থ থেকে ৬১ হাজার পাউন্ড দান করেছিলেন হিলসবরো মেমোরিয়াল ট্রাস্টে, অপরাধবোধটা যদি কমে!
কমেনি নিশ্চয়ই। শেষ পর্যন্ত ২০১১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি সব সমস্যার সমাধানে একটা পথ বেছে নেন, করুণতম পথ। চলন্ত ট্রেনের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে ‘সারভাইভারস গিল্ট’ থেকে মুক্তির স্বাদ নেন হোয়াইটল। হোয়াইটল তো তাও মরে মুক্তি পেয়েছেন, কিন্তু বাকিরা? নিয়ত সংগ্রাম করে যাচ্ছেন সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনের আশায়। বছরের পর বছর ধরে যে সংগ্রাম আরও কঠিন হয়েছিল অন্যায় এক দাবির কারণে।
দীর্ঘদিন হিলসবরো-ট্র্যাজেডিকে দুর্ঘটনা বলে দাবি করা হতো। নিহত ব্যক্তিদের স্বজনেরা তা মানেননি। নির্মম এই ঘটনার বিচার দাবি করে আসছিলেন অনেক দিন ধরে। এ নিয়ে মামলাও হয় ২০১৪ সালে। অবশেষে ইংল্যান্ডের বিচার বিভাগের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ তদন্তের পর ২০১৬ সালে সেই মামলার রায় দেওয়া হয়। ৯ সদস্যের জুরিবোর্ড ৭-২ সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে বলেন, সেদিন ৯৬ জনের মৃত্যু আসলে নিছক দুর্ঘটনা নয়, এর পেছনে দায়ী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
আদালতের বয়ানে, পুলিশের ভুলেই এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। সেদিন ম্যাচের কমান্ডিং অফিসার ভুল সিদ্ধান্ত না নিলে হয়তো ভেঙে পড়ত না নিরাপত্তাবেষ্টনী, হয়তো বেঁচে যেত ৯৭ তরতাজা প্রাণ। বলার অপেক্ষা রাখে না, বছরের পর বছর ধরে এই মিথ্যে দাবির গ্লানি বয়ে বেড়ানো হিলসবরো–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এ রায়ে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। স্বজন হারানোর ক্ষতে একটু হলেও প্রলেপ পড়েছে তাঁদের। ইংল্যান্ডের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন তো আদালতের এই রায়কে ইংল্যান্ডের বিচারব্যবস্থার ইতিহাসে একটি মাইলফলক বলেও উল্লেখ করেছিলেন তখন।