লিভারপুল বনাম রিয়াল মাদ্রিদ: অন্ধকার সময়ে এক অসাধারণ ফাইনাল

একসময় বায়ার্নে একসঙ্গে ছিলেন, আজ থিয়াগো আর ক্রুস লড়বেন লিভারপুল আর রিয়াল মাদ্রিদের হয়েছবি: টুইটার
বাংলাদেশ সময় আজ শনিবার দিবাগত রাত একটায় প্যারিসে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে মুখোমুখি হবে রিয়াল মাদ্রিদ ও লিভারপুল। এ ম্যাচ সামনে রেখে ইংলিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানে বিশেষজ্ঞ কলাম লিখেছেন বায়ার্ন মিউনিখের জার্মান কিংবদন্তি ডিফেন্ডার ফিলিপ লাম। প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য থাকছে সেটির অনুবাদিত রূপ...

১৫ ফেব্রুয়ারি প্যারিসে চ্যাম্পিয়নস লিগের শেষ ষোলোর প্রথম লেগে যখন হেরে যায় রিয়াল মাদ্রিদ, দুনিয়াটা তখন ভিন্নরকম এক জায়গা ছিল। দ্বিতীয় লেগের সময় যত দিনে এল, রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালিয়েছে। ফুটবল তখন আর অত গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু রিয়াল মাদ্রিদকে ওভাবে অবিশ্বাস জাগিয়ে ম্যাচটা ঘুরিয়ে দিতে যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা সেটা কখনো ভুলবেন না।

এ বছর চ্যাম্পিয়নস লিগ এমন একটা সময়ে হচ্ছে, যখন ইউরোপে যুদ্ধ চলছে। ফাইনালে যাওয়ার পথে তারা (রিয়াল মাদ্রিদ) পিএসজির বিপক্ষে যেভাবে জিতেছে, গত বছরে ফাইনালে খেলা দুই দল চেলসি ও ম্যানচেস্টার সিটিকেও সেভাবেই হারিয়েছে। তাদের প্রতিপক্ষ দুই ম্যাচেই দাপট দেখিয়েছে, রিয়াল গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলোয় বেঁচে গেছে, এরপর প্রতিপক্ষ আর বিশ্ব ফুটবলকে চমকে দিয়েছে অবিশ্বাস মাখানো কিছু মুহূর্তে।

সিটির বিপক্ষে সেমিফাইনালে রিয়াল ৯০তম মিনিটেও ২ গোলে পিছিয়ে ছিল, সেখান থেকে জিতেছে। ম্যাচটা আমাকে ১৯৯৯ চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কাছে বায়ার্ন মিউনিখের বেদনাজাগানো হার, অথবা ২০১২ সালে ‘ফিনালে দাহাওমে’ (ঘরের মাঠের ম্যাচ) চেলসির জয়—আমার সর্বশেষ ধাক্কার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। প্রিমিয়ার লিগে আবার গত রোববার সিটি ০-২ গোলে পিছিয়ে পড়ার পর পাঁচ মিনিটে ৩-২ করে চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেল। এই ব্যাখ্যার অসাধ্য ব্যাপারগুলোই ফুটবলের মজা।

এখন ১৩ বারের চ্যাম্পিয়ন রিয়াল মুখোমুখি হচ্ছে ৬ বারের চ্যাম্পিয়ন লিভারপুলের। রিয়াল আরেকটি মিরাকলের জন্ম দিতে পারবে কি না, সে প্রশ্নে সবার চোখ থাকবে করিম বেনজেমার ওপর। বিশ্বের সেরা স্ট্রাইকারের সবকিছুই রিয়ালকে বোঝায়: প্রতিভা, জিনিয়াস, খেলাটা বোঝার সহজাত ক্ষমতা, নিজের শক্তিতে বিশ্বাস।

ফাইনালের আগে শেষ অনুশীলনে বেনজেমারা
ছবি: রয়টার্স

পিএসজির বিপক্ষে ও ১৭ মিনিটে ৩ গোল করেছে, নকআউট পর্বে ছয় ম্যাচে ১০ গোল। চ্যাম্পিয়নস লিগে এক মৌসুমে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর গোলের রেকর্ড ছুঁয়ে ফেলেছে, ফাইনালে ওকে (রোনালদো) পেরিয়েও যেতে পারে। (তথ্যটা ভুল, চ্যাম্পিয়নস লিগে এক মৌসুমে সবচেয়ে বেশি গোলের রেকর্ডে প্রথম তিনটিই রোনালদোর, তবে বেনজেমা এখনো সবচেয়ে বেশি গোলের রেকর্ডটা ছুঁতে পারেননি। ২০১৩-১৪ মৌসুমে রোনালদো ১৭ গোল করেছিলেন, এই মৌসুমে এখন পর্যন্ত বেনজেমার গোল ১৫টি।)

মাঠের বাইরে বেনজেমার কিছু অপরাধ ওকে নির্দ্বিধায় ভালোবাসতে দেয় না। তবে ও সর্বকালের সেরাদের একজন। এরই মধ্যে চারবার চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছে। প্যারিসে লুকা মদরিচ, কাসেমিরো ও টনি ক্রুসের (যে কিনা তার চার শিরোপার প্রথমটি জিতেছে বায়ার্নের হয়ে) মতো তারও আলফ্রেডো ডি স্টেফানোকে ছুঁয়ে ফেলার সুযোগ আছে। সেই ডি স্টেফানো, যিনি ১৯৫৬ থেকে ১৯৬০ সালে টানা পাঁচবার শিরোপাটা জিতিয়ে রিয়াল মাদ্রিদ নামের কিংবদন্তির সূচনা করেছেন।

শৃঙ্খলা ব্যাপারটা বেনজেমার সঙ্গে যায় না। ওকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে এমন কোচকে দরকার, যিনি জানবেন তিনি কাকে নিয়ে কাজ করছেন, তা-ও এমন একটা ক্লাবে, যেখানে সব ফুটবলারই খেলার স্বপ্ন দেখে। পাঁচবার চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে ওঠা প্রথম কোচ কার্লো আনচেলত্তিই এই মুহূর্তে রিয়াল মাদ্রিদের জন্য সবচেয়ে ভালো কোচ।

সিটির বিপক্ষে ম্যাচে তিনি ১০ মিনিটের মধ্যে ক্রুস, মদরিচ ও কাসেমিরোকে উঠিয়ে নেন। পতন ঠেকাতে এমন সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে সঠিক মুহূর্ত বেছে নিতে সহজাত ক্ষমতা লাগে। আর আনচেলত্তির মতো একজন, যিনি কিনা টাচলাইনে সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে এই খেলোয়াড়দেরই মতামত নেন, খেলোয়াড়দের কাছে তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা কখনো কম হয় না।

গ্যালাকটিকোস—অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে এটাই রিয়াল মাদ্রিদের ঐতিহ্য। প্রত্যেক প্রজন্মেই সেরাদের সেরা খেলোয়াড়েরা খেলেছে তাদের দলে। এই খেলোয়াড়দের কেউ স্পেন থেকে গেছে, কেউ দক্ষিণ আমেরিকা থেকে। মাঝেমধ্যে যখন ইউরোপের অন্য অঞ্চল থেকে গেছে, সেটিও গেছে ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, ইতালি ও জার্মানির মতো ফুটবলে ঐতিহ্যবাহী দেশগুলো থেকেই। সিটি আর বিশেষ করে পিএসজি চেষ্টা করছে রিয়ালকে নকল করার, এই গ্ল্যামার তারাও চায়। কিন্তু এক দশকেও তারা রিয়ালকে ধরতে পারেনি। ওরা এখনো অনুসরণকারীই থেকে গেছে। আর রিয়াল? যদি কিলিয়ান এমবাপ্পেকে না-ও পায়, তবু নিজেদের মতো করেই থাকবে।

লিভারপুলের খেলার ধরন ভিন্ন। ওদের ফুটবলে পার্থক্য গড়ে দেওয়ার মতো ব্যাপারগুলো হচ্ছে শারীরিক ক্ষমতা, গতি, প্রায় প্রতিটি পজিশনের খেলোয়াড়েরই বল নিয়ে সামনে ওঠার চেষ্টা। বেশির ভাগ দলই এভাবেই খেলতে চায়। আবেগের প্রকাশ দেখা ইউরোপা লিগের ফাইনালে আইনট্রাখট ফ্রাঙ্কফুর্ট এভাবেই হারিয়েছে রেঞ্জার্সকে। কিন্তু (খেলায় আবেগের বহিঃপ্রকাশে) লিভারপুলের দক্ষতার ধারেকাছে কেউ নেই। এই মুহূর্তে ওদের এই খেলার ধরন বন্দরঘেঁষা শহরটার শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে মেলে।

সেখানে সাত বছরে ইয়ুর্গেন ক্লপ ও তাঁর খেলোয়াড়দের মধ্যে একটা বন্ধন গড়ে উঠেছে। লিভারপুলের আন্ডারডগ মানসিকতাটা মাঠে ছড়িয়ে দেওয়ায় তিনি দারুণ দক্ষ। ইতিহাসের সেরা সব দলের মতোই লিভারপুলও খেলার একটা নিজস্ব ধরন তৈরি করে নিয়েছে, যেটার কারণেই পাঁচ বছরে তৃতীয় চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল খেলছে ওরা। বার্সেলোনার স্লোগান ছিল ‘মোর দ্যান আ ক্লাব’, বায়ার্নের ‘মিয়া সান মিয়া’, আর লিভারপুলে ভার্জিল ফন ডাইক, ট্রেন্ট আলেক্সান্ডার-আরনল্ড আর সাদিও মানেরা ‘নেভার ওয়াক অ্যালোন।’

এখানে আলাদা করে প্রত্যেক খেলোয়াড়ের চেয়ে দলটাই বড়।

অনুশীলনে হাসিখুশি ক্লপ-সালাহরা
ছবি: রয়টার্স

একসময়ের লিভারপুলের সেরা খেলোয়াড় ফিলিপে কুতিনিও সেটা বোঝেনি। বার্সেলোনা আর বায়ার্নেও ও কিছু করতে পারেনি, এখন খেলছে অ্যাস্টন ভিলায়। অন্যদিকে, মোহাম্মদ সালাহ লিভারপুলের মানুষের কাছের তারকা। ১২ বছর বয়সে থাকার সময় ও মিসরে চার ঘণ্টা ধরে বাসে চড়ে অনুশীলনে যেত, আজ ও হল অব ফেমে জায়গা করে নিয়েছে। এই যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা, নিজেকে তুলে ধরার অদম্য চাওয়া...এটাই লিভারপুলের পরিচয়।

বেনজেমার রিয়ালের সঙ্গে ওদের চেয়ে বেশি অমিল আর কারও হতে পারে না। সে কারণেই এই ম্যাচ দেখার জন্য আরও বেশি উন্মুখ আমি।

অবশ্যই যুদ্ধের এই সময়ে শুধু আনন্দ নিয়ে ফুটবল উপভোগ করা যাচ্ছে না। এটার প্রভাব ইউরোপের মানুষের ওপর পড়ে, বিশেষ করে ইউক্রেনের মানুষের ওপর। ত্রান্সনিস্ত্রিয়ার ক্লাব শেরিফ তিরাসপোলের কাছে গ্রুপ পর্বে নিজেদের মাঠে হেরেছিল রিয়াল মাদ্রিদ। ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউরোপা লিগে ব্রাগার বিপক্ষে ম্যাচের পর সেই দলটার (শেরিফ তিরাসপোল) ইউক্রেনিয়ান কোচ ইউরি ভেরনিদুব নিজেদের দেশের হয়ে লড়ার জন্য দল ছেড়ে গেছে। কয়েক মাস আগেই বার্নাব্যুতে দলকে জেতালেন, আর এখন বন্দুক হাতে সম্মুখসমরে দেশের মানুষের হয়ে লড়ছেন।

২০২২ সালের ফুটবলের গল্পই এমন!