সামির শাকিরের চোখে জল দেখেছিলেন আলফাজ

আলফাজ আহমেদ। ছবি: এএফপি।
আলফাজ আহমেদ। ছবি: এএফপি।

গোয়ায় দ্বিতীয় সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ দলকে নিয়ে কোনো প্রত্যাশাই ছিল না দেশের ফুটবলপ্রেমীদের। প্রত্যাশা না থাকার কারণ ছিল মূলত দুটি। কাঠমান্ডুতে আগের সাফে ভীষণ ব্যর্থতা আর তার আগের একটা মৌসুমে ঘরোয়া লিগ অনুষ্ঠিত না হওয়া। সাফের আগে প্রাথমিক দল যখন ঘোষণা হয়, ফুটবলাররা ছিলেন পুরোপুরি খেলার সঙ্গে সংস্পর্শহীন।

এমন অবস্থায় ইরাকি কোচ সামির শাকিরের হাতে যখন খেলোয়াড়দের তুলে দেওয়া হয়, এই অভিজ্ঞ কোচও খুব একটা আশার বাণী শোনাতে পারেননি। কিন্তু সবাইকে ভুল প্রমাণ করে বাংলাদেশ দারুণ খেলেছিল সাফের সেই আসরে। প্রতিযোগিতার ফাইনালে উঠে ভারতীয় তারকা বাইচুং ভুটিয়ার অনন্য শৈলীর কাছে হার না মানলে ইতিহাসে গোয়ার সেই আসরকে ভিন্ন একটা জায়গাই দিতে হতো।
আলফাজ আহমেদ জাতীয় দলের জার্সি গায়ে খেলেছেন দীর্ঘ দিন। খেলেছেন সাফের চারটি আসর। বাংলাদেশ দলের এ স্ট্রাইকারের দৃষ্টিতে ১৯৯৯ সালে গোয়ার সেই আসরে রীতিমতো অসম্ভবকেই ‘সম্ভব’ করার প্রত্যয়ে নেমেছিলেন শাকির, ‘গোয়ার সাফে আমাদের দারুণভাবে উদ্দীপ্ত করেছিলেন সামির শাকির। তিনি আমাদের ভেতরে সাফ জয়ের প্রেরণা সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি কথা বলতেন ম্যাচ বাই ম্যাচ। প্রথম ম্যাচটার পর দ্বিতীয় ম্যাচ—এভাবে এগোতেন তিনি। আমরা সেবার ফাইনালে গিয়েও ভারতের কাছে হেরে গিয়েছিলাম। ফাইনালে প্রথমার্ধে খুব অল্প সময়ের মধ্যে বাইচুং ভুটিয়ার দুটি গোল আমাদের পিছিয়ে দিয়েছিল। বাকিটা সময় আমরা ম্যাচে ফিরি সামির শাকিরের উদ্দীপনাময়ী। জুয়েল রানা পেনাল্টি মিস করেছিল। মিজানুর রহমান ডনের একটা শট বার পোস্টে লেগে ফেরত এসেছিল। ম্যাচের পর খেয়াল করেছিলাম উনি চোখ মুচছেন।’
ইরাকের সাবেক বিশ্বকাপ তারকা সামির শাকিরের যে ব্যাপারটা আলফাজকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করত, খেলোয়াড় চিনতে পারার অসাধারণ ক্ষমতা, ‘উনি নিজে ইরাকি জাতীয় দলে খেলেছেন। ছিয়াশিতে মেক্সিকো বিশ্বকাপে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। তাঁর অভিজ্ঞতা ছিল অন্যরকম। তিনি দারুণ খেলোয়াড় চিনতে পারতেন। জাতীয় দলের একাদশে মোস্তফা আনোয়ার পারভেজ, মনোয়ার হোসেন কিংবা আনোয়ার হোসেনদের মতো প্রতিভাবানদের জায়গা দিয়েছিলেন। যারা পরে বাংলাদেশের ফুটবলের বড় নাম হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছিল।’

বাংলাদেশের সাবেক ইরাকি কোচ সামির শাকির । ছবি: প্রথম আলো।
বাংলাদেশের সাবেক ইরাকি কোচ সামির শাকির । ছবি: প্রথম আলো।

গোয়ার সাফের প্রথম ম্যাচেই স্বাগতিক ভারতের মুখোমুখি হয়েছিল বাংলাদেশ। সে ম্যাচটি গোলশূন্য ড্র হয়। দ্বিতীয় ম্যাচে বাংলাদেশ পাকিস্তানকে হারায় ৪-০ গোলে। এর মধ্যে একটি করেছিলেন আলফাজ। সেমিফাইনালে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ ছিল নেপাল। সে ম্যাচটি বাংলাদেশ নিজেদের করে নেয় ২-১ গোলে। মিজানুর রহমান ডনের পাশাপাশি সে ম্যাচের আরেক গোলদাতা ছিলেন আলফাজই।
নেপালের বিপক্ষে সেই সেমিফাইনালটা নিজের স্মৃতিতে আলাদা একটা জায়গাই দিয়েছেন আলফাজ। ম্যাচের আগের দিন গ্যাসট্রিকের আক্রমণে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। খেলার আগেও পুরোপুরি সুস্থ ছিলেন না। কিন্তু সামির শাকির তাঁকে একাদশে রেখেছিলেন। ম্যানেজারের ‘রক্তচক্ষু’ উপেক্ষা করে আলফাজের কাছে এসে বলেছিলেন, ‘আলফাজ, জানি তোমার খেলতে কষ্ট হবে, কিন্তু তোমাকে আমার দরকার। তুমি খেল। দেশের জন্য এতটুকু করতে পারবে না তুমি?’
কোচের মুখে এমন কথা শুনলে কোনো খেলোয়াড়ই বসে থাকতে পারবেন না, আলফাজও পারেননি। তিনি খেলেছিলেন এবং একটি গোলও করেছিলেন, ‘ম্যাচে আমাকে খেলানোর ব্যাপারটা ম্যানেজার সাহেব মোটেও পছন্দ করেননি। তিনিও একজন সাবেক তারকা ফুটবলার। তিনি খেলাটা বুঝতেন। আমি পুরো ম্যাচে মাত্র দুই-তিনবার বল ধরেছিলাম। প্রচণ্ড খারাপ লাগছিল আমার। কিন্তু ডাগ আউটে কোচের দিকে তাকিয়ে খুব মায়া লাগছিল। তাঁর চেহারায় আমার প্রতি অগাধ আস্থা আর বিশ্বাস দেখেছিলাম। ম্যানেজার ম্যাচের একপর্যায়ে আমাকে তুলে নিতে বলেছিলেন, কিন্তু সামির শাকির তা শোনেননি। আমি তাঁর আস্থার প্রতিদান দিয়েছিলাম গোল করে। মিজানুর ডনের প্রথম গোলটাতেও আমার অবদান ছিল।’
সামির শাকিরের এই আন্তরিকতার প্রতিদান খেলোয়াড়েরা গোয়ার সাফে দিতে পারেননি। কিন্তু কয়েক মাস পরেই দিয়েছিলেন। ১৯৯৯ সালেই কাঠমান্ডুতে অষ্টম সাফ গেমসে তাঁর অধীনে ‘স্বর্ণ-খরা’ দূর করেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু সামির শাকির বেশিদিন থাকতে পারেননি বাংলাদেশের কোচ হিসেবে। কেন থাকতে পারেননি, সেটি অবশ্য ভিন্ন আলোচনা।
আলফাজের গোলেই কাঠমান্ডু সাফ গেমসে সোনা জিতেছিল বাংলাদেশ। ফাইনালে নেপালের বিপক্ষে বাংলাদেশের ১-০ গোলের জয়ের নায়ক তখন আরও ভালো করে বুঝতে পারেন সামির শাকিরকে, ‘খুব বড় মাপের খেলোয়াড়-কোচ ছিলেন সামির শাকির। বাংলাদেশের প্রতি ছিল আলাদা একটা টান। যেহেতু আবাহনীর খেলোয়াড় হিসেবে ঢাকা লিগে খেলেছেন, মোহামেডানের মতো দলের কোচ ছিলেন, তাই বাংলাদেশের প্রতি তাঁর টানটা বুঝতে পারতাম। সাফ গেমস জয়ের দিন তিনি খুব আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন। কথা বলতে তাঁর গলা কাঁপছিল। খেলোয়াড়দের সঙ্গে নিজের আবেগকে মিশিয়ে ফেলা এমন বিদেশি কোচ সত্যিই বিরল। আমি এখনো বিশ্বাস করি, আমাদের জন্য সবচেয়ে কার্যকর বিদেশি কোচ ছিলেন তিনিই।’