সেই দিন এই দিন

২০০৫ এএফসি অনূর্ধ্ব-১৭ মেয়েদের চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ l ছবি: সংগৃহীত
২০০৫ এএফসি অনূর্ধ্ব-১৭ মেয়েদের চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ l ছবি: সংগৃহীত

ফ্লাইট ছিল সন্ধ্যায়। প্রথমবারের মতো বিমানে চড়বে ফুটবলার অংম্রা চিং মারমা। ভয় পাচ্ছিল, আবার ভালো লাগা অনুভূতিও ছিল। শুধু অংম্রা নয়, বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৭ মেয়েদের দলের সব ফুটবলারেরই সেটিই ছিল প্রথম বিমানভ্রমণের অভিজ্ঞতা।

২০০৫ সালের এপ্রিলে দক্ষিণ কোরিয়ায় এএফসি অনূর্ধ্ব-১৭ মেয়েদের চ্যাম্পিয়নশিপে খেলতে গিয়েছিল বাংলাদেশ। বয়সভিত্তিক ওই প্রতিযোগিতা দিয়েই আন্তর্জাতিক ফুটবলে অভিষেক বাংলাদেশের মেয়েদের।

মৌলবাদীদের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে ২০০৩ সালে দেশে গোড়াপত্তন হয় মেয়েদের ফুটবলের। প্রথম এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশনের (এএফসি) আমন্ত্রণ আসে দুই বছর পরই—২০০৫ সালে। এই প্রতিযোগিতায় বাছাইপর্ব ছিল না। গুয়াম, হংকং ও জাপানের সঙ্গে ‘বি’ গ্রুপে খেলেছিল বাংলাদেশ।

মেয়েদের ফুটবলে তখন হামাগুড়ি দিতে শেখা বাংলাদেশ মৌলবাদীদের হুমকি-ধমকি ও বাস্তবতা বিবেচনায় আদিবাসী মেয়েদের প্রাধান্য দেয়। ১১ জন আদিবাসী মেয়েকে নিয়েই ২৩ সদস্যের দল গড়ে কোরিয়া পাঠায় বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন।

মাত্র তিন মাসের অনুশীলনে কোরিয়া যাওয়ার আগে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ৪টি প্রস্তুতি ম্যাচ খেলার সুযোগ পায় দলটি। কিন্তু কোরিয়ার মাঠে তাদের মুখোমুখি হতে হয় কঠিন বাস্তবতার। প্রথম ম্যাচে গুয়ামের কাছে ১-০ গোলে হার। পরের ম্যাচে জাপান গুনে গুনে দিয়েছিল ২৪ গোল! গ্রুপের শেষ ম্যাচে হংকংয়ের সঙ্গে লড়াই করলেও হেরেছিল ২-৩ ব্যবধানে।

ওই দলের ম্যানেজার ছিলেন ফেডারেশনের তৎকালীন মহিলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক কামরুন নাহার ডানা। কোচ ছিলেন শেখ জামাল ধানমন্ডির বর্তমান গোলরক্ষক কোচ মোশারফ হোসেন বাদল।

জাপানের কাছে সেদিন বৃষ্টির মতো গোল খাওয়া মেয়েদের উত্তরসূরিরা এখন প্রতিপক্ষকে গুনে গুনে গোল দেয়। দিন বদলে গেছে, এই তো মাত্রই কদিন আগে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাইপর্বে কিরগিজস্তানকে ১০-০ গোলে বিধ্বস্ত করেছে কৃষ্ণারা! মেয়েদের এমন সাফল্যে গর্বে বুকটা ভরে ওঠে কামরুন নাহার ডানার, ‘মাঠে কৃষ্ণা-মৌসুমীদের যখন গোল করতে দেখি, তখন কী যে ভালো লাগে! অথচ আমাদের মেয়েরা একদিন ফুটবল খেলবে, এভাবে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করবে, তা ভাবতেই পারত না কেউ।’ মেয়েদের ফুটবল শুরু করতে গিয়ে টেলিফোনে মৃত্যুর হুমকিও পেয়েছিলেন ডানা।

যাই হোক, সেদিনের চারা গাছ এখন ফল দেওয়া শুরু করেছে। বয়সভিত্তিক অনূর্ধ্ব-১৬ পর্যায়ে বাংলাদেশ এখন এশিয়ার সেরা আটে। এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপের চূড়ান্ত পর্বে ওঠায় নারী ফুটবলের প্রথম কোচ মোশারফ বাদলও উচ্ছ্বসিত, ‘মাঠে বসে এই মেয়েদের খেলা দেখি, আনন্দে বুকটা ভরে ওঠে। শুধু আক্ষেপ, আমি যে মেয়েদের প্রথম কোচ ছিলাম, তা কেউ স্মরণ করে না।’

২৪ গোল খাওয়ার ম্যাচটিতেও স্বাভাবিকভাবেই ডাগআউটে ছিলেন বাদল। এমন হারের সাক্ষী হওয়া কতটা অস্বস্তির ছিল? বাদলের উত্তর, ‘লজ্জার কিছু তো ছিল না। মেয়েরা যে মাঠে সেদিন ৯০ মিনিট খেলতে পেরেছিল, সেটাই অনেক বেশি।’ ওই ম্যাচে এক নম্বর গোলরক্ষক ছিল কেমি চাকমা। পরে কোচ গোলবৃষ্টি দেখে নামিয়ে দেন মিনা খাতুনকে (মনা)।

অংম্রা মারমা কোরিয়ায় তিনটি ম্যাচেই খেলেছেন। ২৪ গোলের দুঃস্বপ্ন এখনো ভুলতে পারেননি, ‘আমরা তো তখন ফুটবলে লাথিই দিতে পারতাম না। ওই ম্যাচে গোলকিপারের সামনে আমরা ১০ জন দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিন্তু কী থেকে কী হচ্ছিল, কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল কখন ৯০ মিনিট শেষ হবে!’

ঢাকায় সানজিদা-কৃষ্ণাদের এমন দাপুটে পারফরম্যান্স দেখে ভীষণ খুশি অং¤ম্রা, ‘এখন মেয়েরা স্কুল পর্যায় থেকে খেলে আসছে। আমরা ২৪ গোল খেতাম, ওরা ১০ গোল দিচ্ছে—একজন মেয়ে ফুটবলার হিসেবে এটা ভাবতেই অনেক গর্ব হয়।’

প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা ওই দলের অনেকে খেলা ছেড়ে দিয়েছেন। কেউ ঘরকন্নায় ব্যস্ত। অনেকে প্রবাসী। ওই দলের অধিনায়ক আয়েশা আক্তার ফুটবল ছেড়ে কিছুদিন ক্রিকেট খেলেছেন। ইতি ইসলাম উশু খেলছেন, ফাতেমা খাতুন হ্যান্ডবল খেলেন, হাসিনা বেগম আনসারের কর্মকর্তা। মিনা খাতুন যুক্তরাজ্যে থাকেন।

অংম্রা, মিনাদের মনে এখন আর ২৪ গোলের হতাশা নেই। কৃষ্ণা-সানজিদা-আনুচিংরা যে তাঁদের মাথা উঁচু করে কথা বলার সুযোগ দিচ্ছে।