সেভিয়া দেখাল, কেন তারা ইউরোপার ‘রিয়াল মাদ্রিদ’

সেভিয়ার ইউরোপা লিগ জয়ের উচ্ছ্বাস।ছবি: রয়টার্স

অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে, ইউরোপা লিগ (সাবেক উয়েফা কাপ) এর ফাইনালে সেভিয়া উঠলেই শিরোপা যাবে তাদের ঘরে। গত দেড় দশকে স্প্যানিশ দলটা ইউরোপা লিগের ফাইনালে উঠেছে পাঁচবার, জিতেছে প্রত্যেকবারই।

এবারও ব্যতিক্রম হল না। প্রতিপক্ষ যতই ইন্টার মিলানের মতো শক্তিশালী দল হোক, সেভিয়া বুঝিয়ে দিল, ইউরোপা লিগের ফাইনালে উঠলে তাদের শিরোপা থেকে দূরে রাখা যায় না। টুর্নামেন্টটাতে শিরোপার রেকর্ডটা আগেই তাদের ছিল, কোলনে কাল ইন্টারকে ৩-২ গোলে হারিয়ে রেকর্ডটাকে ‘৬’-এ নিয়ে গেল হুলেন লোপেতেগির সেভিয়া। বুঝিয়ে দিল, তারাই ইউরোপা লিগের ‘রিয়াল মাদ্রিদ।’ চ্যাম্পিয়নস লিগ বললে যেমন সেই টুর্নামেন্টে রেকর্ড ১৩ বার শিরোপা জেতা রিয়ালের কথা আসবে সবার আগে, ইউরোপায় সেই দলটা সেভিয়া।

গোটা ম্যাচই ছিল সেভিয়ার ব্রাজিলিয়ান ডিফেন্ডার দিয়েগো কার্লোসের ভুল আর সেগুলোর প্রায়শ্চিত্ত করার ম্যাচ। খলনায়ক হয়ে ম্যাচ শুরু করা এই ডিফেন্ডারই ম্যাচ শেষে দলের নায়ক। ইন্টার মিলানের বেলজিয়ান স্ট্রাইকার রোমেলু লুকাকুর হলো উল্টোরথে যাত্রা—ম্যাচের শুরুতে দলকে এগিয়ে নিয়ে নায়ক, শেষদিকে আত্মঘাতী গোলে বনে গেলেন খলনায়ক। তাঁর আত্মঘাতী গোলই গড়ে দিয়েছে শিরোপাভাগ্য।

গায়ে-গতরে শক্তিশালী আর প্রতিপক্ষ গোলপোস্টের সামনে দারুণ ফর্মে থাকা লুকাকুকে কীভাবে আটকাতে পারেন কার্লোস—ম্যাচের আগে সেটি ছিল আলোচনায়। ম্যাচের চতুর্থ মিনিটেই তাতে প্রথম ধাক্কা খেলেন কার্লোস, লুকাকুর সঙ্গে গতিতে না পেরে উঠে ফাউল করে বসেন বক্সের ভেতর। নিজের আদায় করা পেনাল্টিতে গোল করেন লুকাকু। কার্লোসের চোখেমুখে তখন রাজ্যের হতাশা, লুকাকুর মুখে তখন বিজয়ের হাসি।

হুলেন লোপেতেগির (বাঁ থেকে দ্বিতীয়) অভিব্যক্তি যেমনটা বলে, শিরোপার আনন্দ বুঝি এমনই হয়!
ছবি: রয়টার্স

দারুণ জমে ওঠা প্রথমার্ধে গোল হলো আরও তিনটি, তিনটি গোলেই দারুণ মিল— তিনটিই হয়েছে তিন দুর্দান্ত হেডে। সমতায় ফিরতে সেভিয়া সময় নিল মাত্র আট মিনিট। ডান দিক থেকে ম্যানচেস্টার সিটির সাবেক উইঙ্গার ও সেভিয়ার অধিনায়ক হেসুস নাভাসের মাপা ক্রসে দারুণ হেডে গোল করেন ডাচ স্ট্রাইকার লুক ডি ইয়ং। প্রথাগত স্ট্রাইকার হিসেবে বহু বছর ধরেই আয়াক্স, নিউক্যাসলের মতো ক্লাবে আলো ছড়ানো ডি ইয়ং সেমিতে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে বদলি নেমে গোল করে জিতিয়েছিলেন দলকে। সেই সুবাদে ইউসেফ এন-নেসেরির বদলি হিসেবে কাল ফাইনালে একাদশে জায়গাটা ডি ইয়ং কাজে লাগিয়েছেন দারুণভাবে।

৩৩ মিনিটে আবারও আরেক হেডে গোল করে দলকে এগিয়ে দেন ডি ইয়ং। এবার সাহায্যকারীর ভূমিকায় পোড় খাওয়া আর্জেন্টাইন তারকা এভার বানেগা। সেভিয়ার জার্সিতে গতকালই শেষ ম্যাচ খেলেছেন ৩২ বছর বয়সী আর্জেন্টাইন মিডফিল্ডার। কিছুদিন পর আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেবেন কাতারি ক্লাব আল শাবাবে। সাবেক এই ইন্টার ও ভ্যালেন্সিয়া তারকা খুব করে চেয়েছিলেন সেভিয়ার হয়ে নিজের শেষ ম্যাচটা নিজের রঙে রাঙাতে। সেটিই হলো, তাঁর ফ্রি-কিক থেকেই এবারের হেড ডি ইয়ংয়ের।

ফাইনালে জোড়া হেডে গোল করার রেকর্ড এতদিন ইউরোপা লিগ বা চ্যাম্পিয়নস লিগ—কোনো ইউরোপীয় প্রতিযোগিতাতেই ছিল না। ডাচ স্ট্রাইকার দলকে এগিয়ে নিয়ে নিজেও নাম লিখিয়েছেন রেকর্ডবুকে। দুমিনিট পরই ম্যাচে আবার সমতা। প্রথমার্ধের চতুর্থ গোল হিসেবে হেড করে গোল করে ইন্টারকে সমতায় ফেরান দিয়েগো গডিন, উরুগুয়ের যে সেন্টারব্যাক ডি ইয়ংয়ের প্রথম গোলটায় তেমন কিছু করতে পারেননি।

দ্বিতীয়ার্ধে দুই দলই সাবধানী খেলা শুরু করে। কিন্তু শেষমেশ মুখে হাসি ফোটে সেই সেভিয়ারই। প্রথমে করা ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করেন কার্লোস, আর গোটা মৌসুমে দুর্দান্ত খেলা লুকাকুর মৌসুম শেষ হলো হতাশায়। ইন্টার ডি-বক্সে কার্লোসের ওভারহেড কিক লুকাকুর পায়ে লেগে দিক বদলে ঢুকে যায় জালে।

দ্বিতীয় হওয়ার পদক গলায় রাখায় আগ্রহ নেই ইন্টার কোচ কন্তের।
ছবি: রয়টার্স

ম্যাচের শেষদিকে ক্রিস্টিয়ান এরিকসেন, অ্যালেক্সিস সানচেজদের নামিয়ে ম্যাচে ফেরার চেষ্টা করেছিল ইন্টার। লাভ হয়নি। ম্যাচের ৮২ মিনিটে সানচেজ দলকে সমতা প্রায় এনেই দিয়েছিলেন। কিন্তু সেভিয়ার ফরাসি সেন্টারব্যাক জুলস কুন্দে গোললাইন থেকে ক্লিয়ার করলে গোল পাওয়া হয়নি নেরাজ্জুরিদের।

আর তাতেই কোচ হিসেবে নিজ নিজ দলের প্রথম মৌসুমে বিপরীতধর্মী ভাগ্যের দেখা মিলল দুই কোচের। হুলেন লোপেতেগি সেভিয়ায় প্রথম মৌসুম শেষ করলেন শিরোপায়। ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপের আগের দিন স্পেন দল থেকে বরখাস্ত হওয়ার পর রিয়াল মাদ্রিদে তিন মাসের দুঃস্বপ্ন অধ্যায় কাটানো লোপেতেগি সেভিয়ায় যেন ফিরে পেলেন নিজেকে। আর জুভেন্টাস-চেলসিতে অনেক শিরোপা জেতা আন্তোনিও কন্তে ফিরলেন খালি হাতে।