স্বপ্নও হারিয়ে গেছে গোপীবাগে

ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাবের প্রবেশ দুয়ার l প্রথম আলো
ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাবের প্রবেশ দুয়ার l প্রথম আলো

১০ বছর ধরে চলছে বাংলাদেশ পেশাদার ফুটবল লিগ। এখনো যা নামেই পেশাদার। বলতে গেলে ক্লাবগুলোর একটিও পূরণ করেনি পেশাদার ফুটবলের শর্তগুলো। পেশাদার লিগের ১২টি ক্লাবের ভেতর-বাহির নিয়ে নতুন এই ধারাবাহিক

ব্রাদার্স ইউনিয়ন

চুয়াত্তরে দ্বিতীয় বিভাগে খেলার সময় এই বাড়িতেই প্রথম আবাসিক ক্যাম্প হয়েছিল ব্রাদার্স ইউনিয়নের। চারতলা ভবনটা ছিল প্রয়াত রাজনীতিবিদ ও ব্রাদার্সের অন্যতম উদ্যোক্তা সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিকদের। নিচতলায় দুটি ফ্ল্যাটে ব্রাদার্সের ক্যাম্প করেন মানিকের ছোট ভাই শহীদ উদ্দিন সেলিম। কোনো ভাড়া নিতেন না তাঁরা।

সেই ব্রাদার্স গলি থেকে দ্রুতই উঠে আসে রাজপথে। চুয়াত্তরে দ্বিতীয় বিভাগ চ্যাম্পিয়ন। পরের বছর লিগের প্রথম ম্যাচেই চ্যাম্পিয়ন আবাহনীকে ১-০ গোলে হারিয়ে দেওয়া। আটাত্তরে লিগ রানার্সআপ, একাশি সালে দেশের একমাত্র দল হিসেবে আগা খান গোল্ডকাপ জয়ের অনন্য গৌরব। পঁচাশিতে আবাহনীর কাছে ৩-২ গোলে হেরে লিগ শিরোপা থেকে বঞ্চিত। চির আকাঙ্ক্ষার সেই লিগ অবশেষে ২০০৩-০৪ মৌসুমে ব্রাদার্সের দিকে মুখ তুলে তাকায়। পরের বছরও চ্যাম্পিয়ন। সেই শেষ!

‘পেশাদার সময়ে’ ব্রাদার্স এখন উল্টো অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে জীবন-বাঁচানোর লড়াইয়ে মরিয়া। গত ২৯টি লিগ ম্যাচে জয় মাত্র ৮টি। কদিন আগেই লিগে নবাগত সাইফ স্পোর্টিংয়ের কাছে ৫-০ গোলের হারও আছে। কারণ, ব্রাদার্স মানে এখন অল্প টাকায় বাজার থেকে ‘পুঁটি মাছ’ কেনা দল। প্রতিবছরই দলটার ঘর খালি হয়ে যায়। তরুণ দল দাঁড় করাতেই অন্য দল ছোবল মারে। শীর্ষ স্তরে টিকে থাকাটাই বেশি মনে করেন কর্মকর্তারা! কিন্তু তাঁদের কে বলবে, ব্রাদার্স নামের চাঁদটা টিকে থাকার তৃপ্তি নিয়ে ঢাকার ফুটবল আকাশে ওঠেনি।

তবে মাঠে রং হারালেও ক্লাবের অফিসঘর হয়েছে, শীতাতপযন্ত্র এসেছে। আনুমানিক আড়াই বিঘা জমিতে ব্রাদার্স ক্লাব চত্বর। শুধু আঙিনা ধরলে ঢাকায় সবচেয়ে বড় ক্লাব। খেলোয়াড় লাউঞ্জের সামনে ফুলের বাগান। কিন্তু ভেতরে ‘সুন্দর পরিবেশ’ নেই। থাকার ব্যবস্থা উন্নত হয়নি। রুমগুলো বিবর্ণ, অপরিচ্ছন্ন। খাবার ঘর, রান্নাঘরে একবার ঢুকলে দ্বিতীয়বার আর কেউ যাবেন না।

দুঃখের বিষয়, আজও জায়গাটা ব্রাদার্সের নামে হয়নি। গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এর মালিক। ক্লাবটির প্রতীক হয়ে যাওয়া সাবেক ফুটবলার হাসানুজ্জামান বাবলু দুঃখ করেন, ‘এই জায়গাটা ধাপে ধাপে ব্রাদার্স নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। এটি দখলে নিতে ছিয়াত্তরে আমিসহ সাতজন জেল খেটেছিলাম।’ কিন্তু বাবলু, মহসীনসহ অনেক সাবেকের সঙ্গে ক্লাবটির সম্পর্কের সুতোটা আলগা হয়ে গেছে।

এই ক্লাবে খেলেই খন্দকার ওয়াসিম ইকবাল এক জরিপে আশির দশকের সেরা খেলোয়াড়ের স্বীকৃতি পেয়েছেন। সেটা সম্ভব হয়েছে মূলত নিজস্ব মাঠ থাকায়। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে ওই মাঠে নিয়ে আসেন ব্রাদার্সের অন্যতম প্রধান সংগঠক ঢাকার সাবেক মেয়র ও মন্ত্রী সাদেক হোসেন খোকা। জিয়া তখন মাঠে দাঁড়িয়ে বলেন, যার নামেই থাকুক, এটি হবে ব্রাদার্সের মাঠ। কোনো স্থাপনা নয়। মাঠের মালিক বাংলাদেশ ব্যাংক পরবর্তী সময়ে মাঠটা নিতে অনেক চেষ্টা করলেও নিতে পারেনি।

কিন্তু কোরবানির পশুর হাট বসলে মাঠ রূপ নেয় বিধ্বস্ত এক জনপদে। ২০১৬ কোরবানির ঈদের পর খানাখন্দে ভরে ওঠে মাঠ। তৎকালীন কোচ সৈয়দ নইমুদ্দিন বাধ্য হয়ে খেলোয়াড়দের অনুশীলন করান ক্লাবের দোতলার ছাদে। এবারও একই অবস্থা। একটা ‘পেশাদার লিগের ক্লাবের মাঠের এই হাল অকল্পনীয়, বেদনাদায়কও। কিন্তু কোরবানির হাট না বসিয়ে উপায় দেখে না ক্লাব নেতৃত্ব। ফুটবল দল গড়তে বছরের খরচের বড় একটা অংশ ৫০-৬০ লাখ টাকা নাকি আসে হাট থেকে।

গোপীবাগে দুই কাঠার ওপর বাজার আছে, মাসে লাখ টাকা আসে সেখান থেকে। এ দিয়ে চা-নাশতার টাকাও হয় না। পেশাদারি চর্চার জন্য বড় একটা আর্থিক ঝাঁকুনি চায় ব্রাদার্স। ক্লাবের জায়গাটা সরকার থেকে নিজেদের নামে পেলে বহুতল কিছু করা যেত বলে মনে করেন কর্মকর্তারা। সেটা আর কবে পাবে, কে জানে।

কোরবানির পশুর হাট বসায় ব্রাদার্স ইউনিয়নের মাঠের বেহাল দশা l প্রথম আলো
কোরবানির পশুর হাট বসায় ব্রাদার্স ইউনিয়নের মাঠের বেহাল দশা l প্রথম আলো

দলটির প্রয়াত কোচ গফুর বেলুচ বলেছিলেন, ব্রাদার্সের প্রতিটি ইটের কোনা থেকে খেলোয়াড় তৈরি হবে। মাঠই রাখবে বড় ভূমিকা। কিন্তু তা হলো কই! মাঝে মাঝে কিছু বয়সভিত্তিক প্রশিক্ষণ হলেও সেটা অধারাবাহিক। একটা জিমের অভাবে ব্রাদার্সের ফুটবলাররা জিম করতে পারেন না। ‘স্টিমবাথ’সহ অন্য প্রয়োজনগুলো তো পরের কথা। তবে এই সুবিধা নিতে নাকি এক-দুই মাস পর ওয়ারীতে যায় দলটি!

কোচিং স্টাফ দুর্বল। চলতি মৌসুমে দুজন বিদেশি কোচ বিদায় নিয়েছেন। তৃতীয়জনের বয়স মাত্র ২৭। ফিজিও থাকলেও ট্রেনার নেই। সমর্থক গোষ্ঠী হারিয়ে পড়ায় ক্লাব-সমর্থক বন্ধন অদৃশ্য। বিপণন লোক নেই। এত অপেশাদারি কেন? ম্যানেজার আমের খানের অকপট স্বীকারোক্তি, ‘ক্লাব পেশাদার হবে কীভাবে, ম্যানেজার হিসেবে আমি নিজেই তো পেশাদার নই। আমি স্বেচ্ছাশ্রম দিই। পেশাদার লোক থাকলে তবেই তো জবাবদিহি থাকবে।’

যেভাবে চলছে ব্রাদার্স, এটা কি সাংগঠনিক দুর্বলতা? ক্লাবটির ডিরেক্টর ইন চার্জ মহিউদ্দিন আহমেদ মহি বলেন, ‘শেখ জামাল, শেখ রাসেলকে পৃষ্ঠপোষণা দিচ্ছে বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। ব্রাদার্সকে তো দিচ্ছে না। কী করব বলুন। আমরা যতটা সম্ভব করছি।’

তাই আর স্বপ্নও দেখে না একসময়ের সাড়া-জাগানো গোপীবাগের সিংহরা!

আছে

নিজস্ব ক্লাব ভবন

নিজস্ব মাঠ

প্রধান কোচ

সহকারী ও গোলরক্ষক কোচ একজনই

ফিজিও

নেই

জিম

ট্রেনার

ডাক্তার

বিপণন কর্মকর্তা

যুবদল

যুব পরিকল্পনা

সমর্থক গোষ্ঠী

অনুজ্জ্বল উপস্থিতি

এখন পর্যন্ত সব কটি পেশাদার লিগে খেলা পাঁচ দলের একটি ব্রাদার্স। বাকি চার দল আবাহনী, মোহামেডান, শেখ রাসেল ও মুক্তিযোদ্ধা। তবে ব্রাদার্স সেরা তিনে থাকতে পারেনি কখনো। লিগে অবস্থা যথাক্রমে পঞ্চম, চতুর্থ, সপ্তম, পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম, পঞ্চম, পঞ্চম, চতুর্থ।

পেশাদার লিগে ১৯৯ ম্যাচ খেলে জয় ৬৭, ড্র ৬৪, হার ৬৮। গোল ২৬০, খেয়েছে ২৫৬ গোল।