'কামব্যাক' এর রাজা লিভারপুল?

রূপকথার মতো আরেকটি `কামব্যাক` ঘটিয়ে এবার চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে জায়গা করে নিয়েছে লিভারপুল। ছবি : এএফপি
রূপকথার মতো আরেকটি `কামব্যাক` ঘটিয়ে এবার চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে জায়গা করে নিয়েছে লিভারপুল। ছবি : এএফপি
>

অনেকবারই খাদের কিনারা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর নজির গড়েছে লিভারপুল। গত পরশু ঠিক এমনই এক ম্যাচে বার্সেলোনাকে ৪-০ গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে তারা। অথচ, প্রথম লেগে ‘অলরেড’রা হেরেছিল ৩-০ গোলে। ইতিহাস বলছে, ফুটবলে রীতিমতো ‘কামব্যাক কিং’ এই লিভারপুল!

গতবার চ্যাম্পিয়নস লিগের কোয়ার্টার ফাইনালেও এমন হয়েছিল। নিজেদের মাঠে প্রথম লেগে ৪-১ গোলে জিতলেও পরে রোমার মাঠে গিয়ে ৩-০ গোলে হেরে যায় বার্সেলোনা। ফলে ‘অ্যাওয়ে গোল’ এর নিয়মে বিদায় ঘটে যায় তাদের। কিন্তু এবার ‘অ্যাওয়ে গোল’ এর বিড়ম্বনা ছিল না। সেমিফাইনালের প্রথম লেগে নিজেদের মাঠে লিভারপুলের বিপক্ষে ৩-০ গোলের জয়ই পেয়েছিল। অঙ্কের হিসেবেও ছিল দারুণ সুবিধাজনক জায়গায়। অ্যানফিল্ডে কেবল

সেমিফাইনালের প্রথম লেগে লিভারপুলের বিপক্ষে ৩-০ গোলের জয় পেয়েছিল বার্সেলোনা। তখন কি মেসিরা ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পেরেছিলেন আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠা লিভারপুলের কাছে দ্বিতীয় লেগে এক হালি গোল খেয়ে বাদ পড়তে হবে?

তারা যদি এটি না ভেবে থাকেন, তবে ভাবা উচিত ছিল। দলটা যে লিভারপুল! বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় ‘কামব্যাক’ করাটাকে যারা মোটামুটি শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। গত পরশুও সেটিই হয়েছে। ‘কামব্যাক’ এর দুর্দান্ত এক নাটক মঞ্চস্থ করে বার্সাকে হটিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে জায়গা করে নিয়েছে লিভারপুল। আর প্রথম লেগের শেষে খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে থেকেও পরের লেগে ফিরে এসে নিজেদের ‘কামব্যাক’ ইতিহাসে আরও একটি গৌরব যুক্ত করেছে লিভারপুল। কাঁদতে কাঁদতে বিদায় নিয়েছেন মেসি ও তাঁর বার্সেলোনা।

লিভারপুলের সামনে পড়ে অতীতে আর কারকার বার্সেলোনার দশা হয়েছিল, একবার দেখে নেওয়া যাক...

লিভারপুল বনাম এসি মিলান, চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল, ২০০৫
লিভারপুলের ইতিহাসের ‘শ্রেষ্ঠতম কামব্যাক’ মানা হয় এই ম্যাচটাকে। আর মানা হবে না-ই বা কেন? কাগজে-কলমে এই ম্যাচে লিভারপুল ছিল ‘আন্ডারডগ’। এসি মিলানের সেই দলের প্রত্যেক পজিশনে ছিলেন যুগ জয়ী সব খেলোয়াড়। পাওলো মালদিনি, আলেসান্দ্রো নেস্তা, ইয়াপ স্টাম, দিদা, কাকা, ক্ল্যারেন্স সিডর্ফ, আন্দ্রেয়া পিরলো, আন্দ্রেই শেভচেঙ্কো, হার্নান ক্রেসপো, জেনারো গাত্তুসো, রুই কস্তা। লিভারপুলের হয়ে যারা খেলতে নেমেছিলেন, স্টিভেন জেরার্ড, জাবি আলোনসো আর জেমি ক্যারাঘার ছাড়া বাকিরা খুব বেশি খ্যাতিমান ছিলেন না। ম্যাচের শুরুতেও সেই শক্তির ব্যবধানের বিষয়টা বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠল। প্রথম মিনিটেই হেডে গোল করে মিলানকে এগিয়ে দেন অধিনায়ক মালদিনি। ৩৯ আর ৪৪ মিনিটে দুই গোল করে লিভারপুলকে মোটামুটি ম্যাচ থেকে ছিটকে দেন আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকার ক্রেসপো। লিভারপুল তখন কাঁপছে। ম্যাচ জেতা দূরে থাক, চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে সবচেয়ে লজ্জাজনক পরাজয়ের রেকর্ডটাই হয়ে যায় কি না, সে নিয়ে চিন্তাই পেয়ে বসেছিল লিভারপুল সমর্থকদের। মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দলের কার্যকরী উইঙ্গার হ্যারি কিউয়েল চোটে পড়ে মাঠ থেকে বিদায় নেন।

কিন্তু বিরতির পরপরই খেলার ভোল পালটে গেল। ড্রেসিংরুমে দলের অধিনায়ক স্টিভেন জেরার্ডের প্রত্যয়ী এক ভাষণে জেগে ওঠে লিভারপুল। লড়াই না করে মিলানের হাতে চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপা তুলে দেবে না তারা, এ প্রতিজ্ঞাই করেছিলেন। দ্বিতীয়ার্ধে এক ভিন্ন লিভারপুলকে দেখা যায়। ৫৪ মিনিটে জেরার্ডের হেড ব্যবধান কমায়। তার ঠিক দুই মিনিট পরে কিউয়েলের পরিবর্তে মাঠে নামা চেক উইঙ্গার ভ্লাদিমির স্মিতসারের দূরপাল্লার এক শটে স্কোরলাইন ৩-২ হয়ে যায়। সমর্থকেরা তখন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। ৬০ মিনিটে মিলান বক্সের মধ্যে ফাউলের শিকার হন জেরার্ড। আলোনসোর পেনাল্টিটা দিদা আটকে দিলেও ফিরে আসা বলে পা ঠেকিয়ে গোল করে বসেন আলোনসো। ৩-৩! নির্ধারিত ৯০ মিনিট আর অতিরিক্ত ৩০ মিনিটে আর কোনো গোল না হলে টাইব্রেকারে গড়ায় ম্যাচ। সেখানে ৩-২ ব্যবধানে এগিয়ে থেকে শিরোপা জিতে নেয় লিভারপুল। শুরুতে ৩-০ গোলে পিছিয়ে থাকা লিভারপুল ম্যাচটা এভাবে জিতে যাবে, কে ভেবেছিল? 

নেস্তা-মালদিনিদের মিলানকে হারিয়ে সেই রাতে জেরার্ডদের শিরোপা নিয়ে উল্লাস। ছবি : এএফপি
নেস্তা-মালদিনিদের মিলানকে হারিয়ে সেই রাতে জেরার্ডদের শিরোপা নিয়ে উল্লাস। ছবি : এএফপি


লিভারপুল বনাম অলিম্পিয়াকোস, চ্যাম্পিয়নস লিগ প্রথম রাউন্ড, ২০০৫
২০০৫ সালে শুধু ফাইনালেই যে লিভারপুল ঘুরে দাঁড়ানো ইতিহাস গড়েছে, ব্যাপারটি এমন নয়। প্রথম রাউন্ডের শেষ ম্যাচের আগে গ্রুপ টেবিলে তিন নম্বরে ছিল লিভারপুল। দ্বিতীয় রাউন্ডে জায়গা পেতে ঘরের মাঠে গ্রুপের শীর্ষে থাকা অলিম্পিয়াকোসের সঙ্গে শেষ ম্যাচটি অন্তত দুই গোলের ব্যবধানে জিততে হতো। শুরুতেই ব্রাজিল কিংবদন্তি রিভালদোর গোলে পিছিয়ে পড়ে লিভারপুল। সমীকরণ হয়ে যায় আরও কঠিন। যেখানে দুই গোলের ব্যবধানে জেতার কথা, সেখানে গোল খাওয়ার পর লিভারপুলকে গোল করতে হবে তিনটি! বিরতির ঠিক পরপরই তরুণ ফরাসি স্ট্রাইকার ফ্লোরেন্ত সিনামা-পোঙ্গোলের গোলে সমতা ফেরায় লিভারপুল। ম্যাচ শেষ হওয়ার নয় মিনিট আগে লিভারপুলকে এগিয়ে দেন ইংলিশ স্ট্রাইকার নিল মেলর। ম্যাচের একদম শেষ মিনিটে দূরপাল্লার এক অসাধারণ শটে গোল করে দলকে দ্বিতীয় রাউন্ডে নিয়ে যান স্টিভেন জেরার্ড! 

সেই গোলের পর জেরার্ডের উচ্ছ্বাস। ছবি : টুইটার
সেই গোলের পর জেরার্ডের উচ্ছ্বাস। ছবি : টুইটার


লিভারপুল বনাম ওয়েস্ট হাম, এফএ কাপ ফাইনাল, ২০০৬
জেমি ক্যারাঘার আর পেপে রেইনার ভুলে প্রথম ৩০ মিনিটের মধ্যেই ২-০ গোলে পিছিয়ে পড়েছিল লিভারপুল। প্রথমার্ধের শেষ দিকে এক গোল শোধ করেন ফরাসি স্ট্রাইকার জিব্রিল সিসে। দ্বিতীয়ার্ধে স্টিভেন জেরার্ডের বুলেটগতির এক শটে সমতা ফেরায় লিভারপুল। ম্যাচের ৬৩ মিনিটে অদ্ভুতুড়ে এক গোল খেয়ে আবারও পিছিয়ে পড়ে লিভারপুল। ম্যাচের শেষ মিনিটে আবারও দলের ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হন সেই জেরার্ড। বক্সের বাইরে থেকে তাঁর ট্রেডমার্ক শটে গোল করে ম্যাচকে নিয়ে যান অতিরিক্ত সময়ে। অতিরিক্ত সময়ে গোল হয়নি কোনো। পেনাল্টিতে ৩-১ ব্যবধান এগিয়ে থেকে এফএ কাপ জেতে লিভারপুল। 

জেরার্ডে ভর করেই সেবার এফএ কাপ জেতে লিভারপুল। ছবি : এএফপি
জেরার্ডে ভর করেই সেবার এফএ কাপ জেতে লিভারপুল। ছবি : এএফপি


লিভারপুল বনাম আর্সেনাল, এফএ কাপ ফাইনাল, ২০০১
সুইডিশ উইঙ্গার ফ্রেডি লিউইংবার্গের গোলে ৭৩ মিনিটে ম্যাচে এগিয়ে গিয়েছিল আর্সেনাল। বাকি ১৭ মিনিট কোনোরকমে দাঁত কামড়ে পড়ে থাকলে ম্যাচ জেতা হয়ে যায় আর্সেনালের। কিন্তু মাইকেল ওয়েন সেটা মানতে যাবেন কেন? লিভারপুলের তরুণ এই স্ট্রাইকার ৮৩ আর ৮৮ মিনিটে দুটি দুর্দান্ত গোল করে এফএ কাপের শিরোপা নিয়ে আসেন লিভারপুলে। 

আর্সেনালের বুকে শূল বিঁধছেন ওয়েন। ছবি : টুইটার
আর্সেনালের বুকে শূল বিঁধছেন ওয়েন। ছবি : টুইটার


লিভারপুল বনাম ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, লিগ কাপ ফাইনাল, ১৯৮৩
আইরিশ উইঙ্গার নরম্যান হোয়াইটসাইড ১২ মিনিটে ম্যানচেস্টার ইউনাইটডকে এগিয়ে দেন। ৭৫ মিনিট পর্যন্ত একটা গোল পাওয়ার জন্য চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে লিভারপুল। লেফটব্যাক অ্যালান কেনেডির গোলে সমতায় ফেরে লিভারপুল। ম্যাচের একদম শেষ মুহূর্তে আইরিশ মিডফিল্ডার রনি হুইলানের গোলের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের ২-১ গোলে হারায় লিভারপুল।

লিভারপুল বনাম টটেনহাম, লিগ কাপ ফাইনাল, ১৯৮২
ইউনাইটেডের বিপক্ষে লিগ কাপে কামব্যাক করার ঠিক এক বছর আগে একই নাটকের মঞ্চায়ন ঘটায় লিভারপুল। ম্যাচের ১১ মিনিটে ইংলিশ স্ট্রাইকার স্টিভ আর্কিবল্ড এগিয়ে দেন টটেনহামকে। ৮৭ মিনিটে রনি হুইলানের গোলে লিভারপুলের সমর্থকেরা হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। অতিরিক্ত সময়ের দুই গোল গোল করে লিভারপুলকে শিরোপা জিতিয়ে দেন দলের তারকা স্ট্রাইকার ইয়ান রাশ।

লিভারপুল বনাম এভারটন, এফএ কাপ ফাইনাল, ১৯৮৬
প্রথমার্ধের একটু আগে কিংবদন্তি ইংলিশ স্ট্রাইকার গ্যারি লিনেকার গোল করে এভারটনকে এগিয়ে দেন। দ্বিতীয়ার্ধের দশ মিনিটের মধ্যে গোল করে লিভারপুলকে সমতায় ফেরান দলের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম স্ট্রাইকার ইয়ান রাশ। এর কিছুক্ষণ পর দক্ষিণ আফ্রিকান মিডফিল্ডার ক্রেইগ জনস্টন গোল করেন। ম্যাচের শেষদিকে রাশ আরেকটা গোল করে জয় নিশ্চিত করেন।

লিভারপুল বনাম বরুশিয়া ডর্টমুন্ড, ইউরোপা লিগ কোয়ার্টার ফাইনাল, ২০১৬
প্রথম লেগে মূল্যবান একটি অ্যাওয়ে গোলের সাহায্যে ১-১ গোলের ড্র নিয়ে ফিরেছিল লিভারপুল। তবে এই অ্যাওয়ে গোলের সুখ বেশিক্ষণ উপভোগ করতে পারেনি তারা। অ্যানফিল্ডে দ্বিতীয় লেগে নয় মিনিটের মধ্যেই ডর্টমুন্ডকে দুই গোলে এগিয়ে দেন আরমেনিয়ার মিডফিল্ডার হেনরিখ মিখিতারিয়ান ও গ্যাবনের স্ট্রাইকার পিয়েরে-এমেরিক অবামেয়াং। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে বেলজিয়ান স্ট্রাইকার ডিভক অরিগি গোল করে ব্যবধান কমালেও ডর্টমুন্ডের মার্কো রয়েস আরেকটি গোল করে লিভারপুলের সামনে পাহাড়সম বাধা এনে দেন। সেমিতে উঠতে চাইলে তখন ৩৩ মিনিটের মধ্যে লিভারপুলকে তিন গোল করা লাগবেই, আর নিশ্চিত করতে হবে ডর্টমুন্ড যেন গোল না করতে পারে। এই অবস্থায় শুরু হয় লিভারপুলের কামব্যাক-কাব্য। ৬৬ মিনিটে গোল করেন ব্রাজিল তারকা ফিলিপ কুতিনহো। ৭৮ মিনিটে ফরাসি ডিফেন্ডার মামাদু সাখোর গোলে ব্যবধান আরেকটু কমায় লিভারপুল। ম্যাচের একদম শেষ মিনিটে লিভারপুলকে পরম আরাধ্য গোল এনে দেন দলের ক্রোয়েশিয়ান সেন্টারব্যাক দেয়ান লভরেন। লিভারপুল উঠে যায় সেমিতে। 

শেষ মুহূর্তের সেই গোল করে লভরেনদের ভোঁ দৌড়! ছবি : টুইটার
শেষ মুহূর্তের সেই গোল করে লভরেনদের ভোঁ দৌড়! ছবি : টুইটার

এগুলো তো গেল শুধুমাত্র গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে লিভারপুলের ফিরে আসার আখ্যান। ছোট ম্যাচগুলো ধরলে উদাহরণ আরও ভূরি ভূরি পাওয়া যাবে। এখন আপনিই বলুন, যে দল এভাবে যখন-তখন কামব্যাক করে বসে, তাদের 'কামব্যাকের রাজা' বলবেন না তো কী বলবেন?