পেলে-রোনালদোদের মর্যাদার হলুদ জার্সি যেভাবে ‘কলঙ্কিত’

ব্রাজিলিয়ানদের কাছে হলুদ জার্সির গুরুত্ব অপরিসীম ।ছবি: রয়টার্স

হলুদ রংটা যেন ব্রাজিলের ফুটবলেরই প্রতীক। ব্রাজিলিয়ানদের আনন্দ-বেদনার অসংখ্য গল্প এই হলুদ রঙের জার্সির সঙ্গে মিশে আছে। ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন দেখা প্রতিটি ব্রাজিলিয়ান শিশু এই জার্সি জড়িয়ে ধরেই বেড়ে ওঠে। তাদের সবাই যে মর্যাদাপূর্ণ এই জার্সির ছোঁয়া পায়, তা নয়। তবে জার্সিটির ঘোর থেকে আর কখনোই বেরোতে পারে না। শুধু কি ফুটবলাররাই, বিশ্বজোড়া ব্রাজিল ভক্তরাও এটি নিয়ে ঘোরে থাকেন!

ব্রাজিলের ফুটবলারদের মতোই প্রিয় দলের খেলা দেখার সময় এ জার্সিটি পরে অন্য রকম একটা গর্ব অনুভব করেন ভক্ত–সমর্থকেরা। কিন্তু এবার কি সেই গর্বটা তাঁরা অনুভব করবেন? প্রশ্নটা এ কারণেই, এই জার্সি নিয়ে যে এখন খোদ ব্রাজিলিয়ানরাই অস্বস্তিতে আছেন।

অনেকে তো এই জার্সি বর্জনই করছেন। জার্সিটি যে ক্ষমতাসীন জইর বোলসোনারো দলের প্রতীকে পরিণত হয়েছে। ব্রাজিলের রাজনীতিতে যিনি ব্যাপকভাবে বিতর্কিত। যে কারণে এই জার্সি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন ব্রাজিলিয়ানদের একাংশ।

ব্রাজিলের হলুদ জার্সিতে কিংবদন্তি রোনালদো
ফাইল ছবি

গত আগস্টে ২০২২ সালের বিশ্বকাপ জার্সিটি যখন প্রকাশ করা হয়, জোয়াও ভেতর গঞ্জালেজ ডি অলিভিরা নামের এক ভক্তের সেটি কিনতে গিয়ে বিরূপ অভিজ্ঞতা হয়েছে। সেই ঘটনাটা ২০ বছর বয়সী জোয়াওর মুখেই শুনুন, ‘এই জার্সি কেনার কারণে দোকানি মনে করেছিল আমি বর্তমান সরকারের সমর্থক। এরপর সে বামপন্থী প্রার্থী লুলার (লুইস ইনাসিও লুলা দা সিলভা) বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করতে শুরু করে।’

জোয়াও বর্তমান সরকারের প্রধান বলসোনারোকে সমর্থন করেন না। তবে সে সময় তাঁকে বলসোনারো সমর্থক হওয়ার ভান করতে হয়েছিল। অথচ এই জার্সিকে মর্যাদা ও গৌরবের সৌরভ মিশিয়ে দিয়েছিলেন পেলে, গারিঞ্চা, জিকো, সক্রেটিস, রোমারিও ও রোনালদোরা। আর সেটিই কি না, এখন একটি জাতির বিভাজনের প্রতীকে পরিণত হয়েছে।

জার্সির এমন রাজনীতিকরণ নিয়ে ইউনিভার্সিটি অব ব্রাজিলিয়ার ইতিহাসের অধ্যাপক মাথেউস গাম্বা তোরেস বলেছেন, ‘২০১৪ সাল থেকে জার্সিটিতে রাজনীতির দাগ লেগে গেছে।’

হলুদ জার্সিতে পেলের ঐতিহাসিক উদ্‌যাপন
ছবি: টুইটার

আট বছর আগে তৎকালীন বামপন্থী প্রেসিডেন্ট দিলমা রুসেফের অভিশংসনের দাবিতে লাখ লাখ ব্রাজিলিয়ান জাতীয় দলের রঙে জামা পরে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। সেদিন ব্রাসিলিয়ার কয়েক কিলোমিটার রাস্তাজুড়ে হলুদ ও সবুজ রং ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়েনি।

এরপর ২০১৮ সালে এই রংটিকে ব্যবহার করেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট বলসোনারো। সেবার ডানপন্থী এই রাষ্ট্রনায়কের র‍্যালিতে দেখা গিয়েছিল সবুজ, হলুদ এবং নীল রঙের দাপট। তোরেস আরও যোগ করে বলেছেন, ‘সবুজ ও হলুদ জার্সি এরপর বলসোনারো সরকারের প্রতীকে পরিণত হলো। যার অর্থ হচ্ছে এই রং দ্বারা এখন জনসংখ্যার উল্লেখযোগ্য একটি অংশকে আর চিহ্নিত করা যায় না।’

সেই দোকানির সঙ্গে জোয়াওয়ের এমন অভিজ্ঞতা অনেকগুলো বিষয় স্পষ্ট করে। কেন সেদিন রাজনৈতিক বিষয়ে বিরোধে গেলেন না জোয়াও? এর একটিই কারণ, ব্রাজিলে রাজনৈতিক বিরোধ এখন ভয়ংকর হয়ে উঠেছে।

ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারো
ছবি: এএফপি

গত জুলাইয়ে মার্সেলো আলোইজিও দা আরুদা নামের এক লোলা সমর্থককে তাঁরই জন্মদিনের অনুষ্ঠানে গুলি করে হত্যা করেন এক পুলিশ কর্মকর্তা। গুলি করার সময় জর্জ গুরানিও নামের সেই পুলিশ অফিসার বলসোনারোর সমর্থনে চিৎকারও দিয়ে ওঠেন।

তবে মৃত্যুর আগে ঠিকই প্রতিশোধ নিয়ে যান আরুদা। তিনি আক্রমণকারীর ওপর গুলি চালান। জেলে যাওয়ার আগে কিছু সময় হাসপাতালেও থাকতে হয়েছিল সেই পুলিশ কর্মকর্তাকে। এখন বিচারের অপেক্ষায় আছেন তিনি। সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে আরেক লুলা সমর্থককে কুড়াল দিয়ে আঘাত করে হত্যা করা হয়।

এসব ঘটনার পর জোয়াওর মতো অনেকেই এখন রাজনৈতিক আলাপ এড়িয়ে চলছেন, একইভাবে তাঁরা ব্রাজিলের ফুটবলের সঙ্গে মিশে থাকা হলুদ জার্সিটিও বর্জন করেছেন। ৪৩ বছর বয়সী টেক প্রোগ্রামার রুই আরাউহো সুজা জুনিয়র বলেছেন, তিনি এখন এই জার্সি শুধু ঘরেই পরেন।

বলসোনারো সমর্থকরা হলুদ জার্সিকে নিজেদের প্রতীকে পরিণত করেছে
ছবি: এএফপি

বলসোনারোর সমর্থক হিসেবে পরিচিত হওয়া এড়াতেই মূলত তাঁর এই সিদ্ধান্ত। তবে তাঁর আশা, যদি নির্বাচনে সাবেক প্রেসিডেন্ট লুলা জেতেন, জার্সিটি আবার আগের মর্যাদা ফিরে পাবে, ‘তখন এটি আমাদের আবার ঐক্যবদ্ধ করবে এবং দেশের প্রতি ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত হবে, কোনো রাজনৈতিক দলের নয়।’

বামপন্থী প্রার্থী লুলা অবশ্য এখন এই পতাকাটিকে পুনরুদ্ধারে মনোযোগ দিয়েছেন। তাঁর একাধিক সমর্থক যেমন সংগীতশিল্পী লুডমিলা, ব্রাজিলের প্রথম গ্র্যামিজয়ী তারকা আনিত্তা এবং র‍্যাপার ডিজংগা নিজেদের পারফরম্যান্সে এই জার্সি পরে দৃষ্টান্তও স্থাপন করেছেন।

ব্রাজিলের বিশ্বকাপ কিটের আনুষ্ঠানিক প্রচারণায় অংশ নিয়ে ডিজংগা একটি কনসার্টে জনগণকে প্রতিবাদের অংশ হিসেবে জনসম্মুখে জার্সি পরার ডাক দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘তাঁরা (বলসোনারোরা) মনে করে সবকিছু তাঁদের। পরিবার, জাতীয় সংগীত—সবকিছুই তাঁদের জন্য। তবে সত্যিটা হচ্ছে—সবকিছু আমাদের, কোনো কিছুই তাঁদের নয়।’

আরও পড়ুন

শুধু বলসোনারোর প্রতিপক্ষরাই এই জার্সি পরা নিয়ে চিন্তিত নয়, তাঁর সমর্থকদের অনেকেও এই জার্সি পরা নিয়ে অস্বস্তিতে আছেন। ৪১ বছর বয়সী আলেসান্দ্রা পাসোস যেমন বলছিলেন, ‘আমি একজন দেশপ্রেমিক এবং ডানপন্থী। আমি সত্যিই চাই হলুদ জার্সি পরে ভোট দিতে যেতে। তবে ভোটের দিন এটা পরা নিয়ে আমি ভয়ে আছি।’

এমন পরিস্থিতিতে ফুটবলাররা কী ভাবছেন? তাঁরা কি মনে করেন এই জার্সি রাজনীতির প্রতীকে পরিণত হয়েছে? টটেনহামের ব্রাজিলিয়ান তারকা রিচার্লিসনের মতে, এসব ব্রাজিলিয়ানদের তাঁদের জার্সি ও পতাকা থেকে বিচ্ছিন্ন করে। দেশের একটি অংশের পরিচয়কে কেড়ে নেয়। তিনি বলেছেন, ‘একজন ভক্ত, খেলোয়াড় এবং ব্রাজিলিয়ান হিসেবে এই পরিচিতিকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি।’

নিজেদের বিজ্ঞাপনী প্রচারণাতেও নাইকি চেষ্টা করছে বিভিন্ন রাজনৈতিক পরিচয়ের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে। তারা ঐক্যের ওপর বেশি জোর দিচ্ছে। নাইকি বলেছে, ‘একতা, এটা ২১ কোটি  ব্রাজিলিয়ানের প্রতিনিধিত্ব করে। এটা আমাদের।’

জার্সিতে চুমু খাচ্ছেন রিচার্লিসন
টুইটার

নাইকি এই জার্সিকে রাজনৈতিক বা ধর্মীয় কোনো কাজে ব্যবহার করতে না করে দিয়েছে। অনেক ব্রাজিলিয়ান এখন ফুটবল দলকে সমর্থন করতে বিকল্প হিসেবে নীল রঙের অ্যাওয়ে জার্সিটি বেছে নিচ্ছেন। যা কিনা বাজারে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বিক্রি হয়ে গেছে।

ফুটসাল কোচ মাথেউস রোচা বলেছেন, তাঁরা এই বছর নীল জার্সি পরার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি হলুদ জার্সি পরার কোনো তাড়না বোধ করি না। হলুদ জার্সি শান্তিতে ঘুমাক। আমি আশা করি, জনগণের জন্য নীল জার্সিতে ব্রাজিল ষষ্ঠ বিশ্বকাপ জিতবে।’ তবে ‘গ্রিন অ্যান্ড ইয়েলো’ নামের একটি সমর্থক গোষ্ঠী মনে করছে, বিশ্বকাপ ব্রাজিলিয়ানদের আবার হলুদ জার্সির কাছে ফিরিয়ে আনবে।

বিশ্বকাপ ও নির্বাচন কাছাকাছি সময়ে হওয়ায় হলদু জার্সি নিয়ে উন্মাদনা সামনের দিনগুলোতে আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে অধ্যাপক গাম্বা তোরেস মনে করেন, জার্সিকে রাজনীতি থেকে আলাদা করা প্রয়োজন। তিনি বলেছেন, ‘একটি জার্সি শুধু জার্সি। অবশ্যই এর অর্থ আছে। তবে এটি শেষ পর্যন্ত কোনো নির্দিষ্ট সরকারের প্রতিনিধিত্ব করে না। সরকার আসবে, সরকার যাবে। তবে আমাদের দেশ এবং দল সব সময় থেকে যাবে।’