ইয়ামাল যেভাবে ‘মেসি ২.০’

অপ্রতিরোধ্য ইয়ামালকে থামানোর চেষ্টায় বেতিসের খেলোয়াড়রাএএফপি

২০০৭ সালে ২০ পেরোনো লিওনেল মেসির দখলে তখন দুটি লা লিগা, একটি চ্যাম্পিয়নস লিগ ও একটি স্প্যানিশ সুপার কাপের শিরোপা। মেসি তখনো ‘দ্য মেসি’ হয়ে না উঠলেও তাঁর প্রতিভার ঝলকে মুগ্ধ হতে শুরু করেছে ফুটবল–দুনিয়া। বার্সেলোনা ও আর্জেন্টিনার গণ্ডি পেরিয়ে ফুটবলের বৈশ্বিক ক্যানভাসেও মেসি নামের রং ক্রমে ফুটে উঠছিল। বার্সেলোনায় মেসির এই ডানা মেলার সময়ে একই শহরে জন্ম নেয় এক শিশু।

মৌনির নাসরাউয়ি ও শেইলা ইবানা দম্পতির ঘর আলোকিত করা লামিনে ইয়ামালের জন্ম অবশ্য পরিবারটির বাইরে খুব একটা উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা ছিল না। তবে উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি ঘটল কদিন পর, বার্সেলোনার মাঠ ক্যাম্প ন্যুর ভিজিটরস লকার রুমে একটি ফটোশুটের অনুষ্ঠানে।

আরও পড়ুন

স্থানীয় সংবাদমাধ্যম ‘দারিও স্পোর্ত’ ও ইউনিসেফের পরিচালনায় বার্ষিক চ্যারিটির অংশ হিসেবে ক্যালেন্ডারের জন্য বার্সার খেলোয়াড়েরা বেশ কয়েকটি পরিবারের শিশুদের সঙ্গে ছবি তুলেছিলেন। সেদিন দৈব নির্দেশনাতেই যেন মেসি দাঁড়িয়েছিলেন ইয়ামাল ও তাঁর মায়ের পাশে। এরপর ইয়ামালকে মেসির কোলে নেওয়ার এবং গোসল করানোর কয়েকটি ছবিও তোলা হয়। কিন্তু কে জানত, ফটোশুটের আড়ালে সেটি ছিল অলৌকিক এক ‘ব্যাপ্টিজম (দীক্ষাদান)’!

মেসির হাত ধরে যাঁর দীক্ষা লাভ, তাঁর যাত্রা তো সূর্যের দিকেই হবে। ইয়ামালের পরের গল্পটাও তাই এগিয়েছে অনুমেয় চিত্রনাট্য মেনে। মেসির বেড়ে ওঠার আঁতুড়ঘর ‘লা মাসিয়া’ থেকে বল পায়ে ইয়ামালের শুরু। ফটোশুটের সময় মেসির স্পর্শ যেন ইয়ামালের শরীরে প্রভাব রেখেছে রূপকথার গল্পে ব্যবহৃত জাদুর কাঠির মতো। ফলে ইয়ামালের হাত-পাগুলো যখন শৈশবের সীমানা ছেড়ে কৈশোরের আকার নিচ্ছিল, তখন তাঁর নড়নচড়নও ছিল মেসির মতোই।

ইয়ামালের গোল উদ্‌যাপন
এক্স

ইয়ামালের এই শরীরী ভাষা সহজেই বুঝতে পেরেছিলেন বার্সার সাবেক কোচ ও মেসির সেরা সময়ের সতীর্থ জাভি হার্নান্দেজ। যার ফলাফল মাত্র ১৫ বছর ৯ মাস ১৬ দিন বয়সেই বার্সার মূল দলে অভিষেক ইয়ামালের। অভিষেকের পর এখন পর্যন্ত আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি ইয়ামালকে। পথচলার শুরু থেকে তাঁর সঙ্গে মেসির তুলনাকে ন্যায্যতা দিয়ে যাচ্ছেন এখনো কৈশোরের বৃত্ত না পেরোনো ছেলেটি।

মেসির মতো ইয়ামালও বাঁ পায়ের খেলোয়াড়, খেলেন ডান উইংয়ে। বক্সের ভেতরে ও বাইরে—দুই জায়গাতেই তাঁরা সমান কার্যকর। সর্বশেষ স্প্যানিশ সুপার কাপ ফাইনালে রিয়াল মাদ্রিদকে এবং কোপা দেল রেতে রিয়াল বেতিসকে উড়িয়ে দেওয়া ম্যাচের পর মেসির সঙ্গে ইয়ামালের তুলনা রীতিমতো তুঙ্গে উঠেছে।

রিয়ালের বিপক্ষে ম্যাচে ইয়ামালের পজিশনিং, পাসিং, সৃষ্টিশীল স্পর্শ, ড্রিবলিং ও গোল করার ধরন বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে মেসিকে।

রিয়ালের বিপক্ষে ম্যাচে ইয়ামালের পজিশনিং, পাসিং, সৃষ্টিশীল স্পর্শ, ড্রিবলিং ও গোল করার ধরন বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে মেসিকে। বিশেষ করে রিয়ালের বিপক্ষে পিছিয়ে পড়ার পর সমতা ফেরানো গোলটা মেসি-ইয়ামাল মিলের সর্বোচ্চ বিন্দু। রিয়ালের তিন খেলোয়াড়কে বোকা বানিয়ে যে শটে গোল করেছেন, সেটি ছিল মাখনের ওপর ছুরি চালানোর মতোই।

এই পজিশন থেকে বেশির ভাগ খেলোয়াড়ই চেষ্টা করবেন বুলেট শটে গোলরক্ষককে হার মানাতে। আর সে ক্ষেত্রে দূরের পোস্টই হবে তাঁর লক্ষ্য, যাতে গোলরক্ষক ঝাঁপিয়ে পড়েও বলের নাগাল না পান। রিয়ালের গোলকিপার থিবো কোর্তোয়াও হয়তো ইয়ামালের কাছ থেকে তেমন কিছুই প্রত্যাশাও করেছিলেন, সেভাবেই তিনি প্রস্তুত হয়ে ছিলেন। কিন্তু ইয়ামাল সেটি না করে কাছের পোস্টেই আলতো ছোঁয়ায় বল বাড়ালেন। চেষ্টা করেও আর গড়িয়ে যাওয়া বলটি আটকাতে পারেননি কোর্তোয়া।

আরও পড়ুন

অননুমেয় ভঙ্গিতে করা ইয়ামালের গোলটি স্বাভাবিকভাবেই মনে করিয়ে দিয়েছে মেসিকে। গোলরক্ষক ও ডিফেন্ডারদের পূর্বানুমানকে ভুল করে এভাবে প্রচুর গোল করেছেন মেসি। আর এখন নিয়মিত একই জাদু উপহার দিচ্ছেন ইয়ামালও। বুধবার রাতে বেতিসের বিপক্ষেও তাঁর খেলা বারবার মনে করিয়েছে সেরা সময়ের মেসিকে।

খেলার ধরন ও কার্যকারিতায় ইয়ামাল এখন ‘মেসি ২.০’ হলেও এখনো তাঁর সামনে পড়ে আছে লম্বা পথ। প্রতিভা ও পরিশ্রমের জোরে এই পথ পাড়ি দেওয়া অসম্ভব না হলেও কঠিন তো বটেই। অনেক প্রতিবন্ধকতা ও প্রতিরোধের রাস্তা পেরিয়েই ইয়ামালকে ছুঁতে হবে মেসি নামের শ্রেষ্ঠত্বের চূড়া। সেই লক্ষ্যে ইয়ামাল শেষ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবেন কি না, উত্তরটা ভবিষ্যতের হাতেই থাক। কিন্তু বয়সের হিসাবে অর্জনের দিক থেকে ইয়ামাল যেভাবে মেসিকে ছাড়িয়ে গেছেন, তা অবিশ্বাস্যই!

মেসির কোলে ছোট্ট ইয়ামাল
ছবি: এক্স

বার্সার হয়ে মেসির অভিষেক ১৭ বছর ৩ মাস বয়সে। অর্থাৎ ইয়ামালের ১৮ মাস পর মেসির অভিষেক। আর এই ১৮ মাসের মধ্যে বার্সা ও লা লিগার হয়ে একাধিক রেকর্ড ভেঙে দেন ইয়ামাল। যেখানে বার্সেলোনার হয়ে সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতা (১৬ বছর ৮৭ দিন) ও লা লিগায় সবচেয়ে কম বয়সী গোলদাতার (১৬ বছর ৮৭ দিন) রেকর্ডও আছে। এমনকি এর মধ্যে লা লিগার একটি শিরোপাও জেতা হয়ে গিয়েছিল ইয়ামালের। জাতীয় দলের অর্জনের বিবেচনায়ও মেসিকে পেছনে ফেলেছেন ইয়ামাল।

আরও পড়ুন

জাতীয় দলের জার্সিতে আর্জেন্টিনার হয়ে একটি শিরোপা জেতার জন্য তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করতে হয়েছে ‘এলএম টেন’কে। অবশেষে ২০২১ সালে অভিষেকের ১৬ বছর পর তাঁর হাতে উঠেছিল মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্ব কোপা আমেরিকার শিরোপা।

অথচ একই মর্যাদার ইউরোতে ইয়ামাল শিরোপা জিতেছেন ১৭ বছর বয়সে। হয়েছেন প্রতিযোগিতার সেরা তরুণ খেলোয়াড়ও। সব মিলিয়ে মেসিকে মনে করিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি প্রথম পর্বের অর্জনে তাঁকে ছাড়িয়েও গেলেন ইয়ামাল। কিন্তু শুরুর ছাড়িয়ে যাওয়াটাই নিশ্চয় শেষ কথা নয়। বরং ভোরের সূর্যটা দিনের পূর্বাভাসটা ঠিকঠাক দিতে পারল কি না, সেটাই দেখার অপেক্ষা।