এল ক্লাসিকো: আজ কেমন হবে ফ্লিকের কৌশল, কোথায় বার্সেলোনার দুর্বলতা
কদিন ধরে বার্সেলোনা সমর্থকদের স্মৃতিতে হয়তো বারবার ফিরে আসছে ১৩ জানুয়ারি ও গত বছরের ২৭ অক্টোবরের জাদুকরি দুটি রাত। চলতি মৌসুমে বার্সেলোনার পারফরম্যান্সকে ব্যাখ্যা করতে এর চেয়ে মহিমান্বিত রাত আর কি হতে পারে!
প্রথমে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে এরপর জেদ্দায় মরুর বুকে ভক্তদের বার্সা উপহার দিয়েছে দীর্ঘদিন মনে রাখার মতো পারফরম্যান্স। যেখানে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদকে বার্সা দুটি ম্যাচে উড়িয়ে দিয়েছিল ৪-০ ও ৫-২ গোলে। আজ আবারও সেই রিয়ালের বিপক্ষে সেভিয়ায় নামার আগে সেই দুটি রাতের স্মৃতি ফিরে আসা খুবই স্বাভাবিক।
রিয়াল-বার্সার ম্যাচ এমনিতেই আগুনে। সবচেয়ে নীরস ম্যাচেও থাকে গল্প করার অনেক রসদ। আর ওই লড়াইয়ে কোনো দল যদি এমন দাপট দেখায়, তবে সে স্মৃতি হয়ে উঠে দারুণ প্রেরণাদায়কও।
তবে ফুটবলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বলে কিছু নেই। আগের দুই ম্যাচ একটা দল জিতেছে বলে পরের ম্যাচও জিতবে, এমন নাও হতে পারে। ফলে মুখোমুখি লড়াইয়ে আগের ম্যাচ দুটি বার্সার জন্য স্রেফ অনুপ্রেরণাই, ভবিষ্যৎ সাফল্যের নিশ্চয়তা নয়। আর প্রতিপক্ষ যদি হয় ‘রিয়াল মাদ্রিদ’ তাহলে তো কখনোই নয়।
এসব লড়াইয়ে ন্যূনতম ব্যবধানেই নির্ধারিত হতে পারে ফল। সামান্য ভুলে এলোমেলো হয়ে যেতে পারে সাজিয়ে–গুছিয়ে রাখা পরিকল্পনা। এসব কথা অবশ্য হান্সি ফ্লিক ও তাঁর শিষ্যদেরও অজানা নয়। ফলে ভক্তরা যতই ম্যাচের ক্লিপ শেয়ার করে যুদ্ধে মাতুন, এটা যে নতুন আরেকটা দিন এবং নতুন একটি ম্যাচ, সেটা জেনেই প্রস্তুত হচ্ছেন লামিনে ইয়ামাল-পেদ্রিরা।
রিয়ালই যখন বার্সেলোনার শেষ বাধা
চলতি মৌসুমে এখন পর্যন্ত অসাধারণ ফুটবল খেলেছে বার্সেলোনা। মৌসুমের শেষ ভাগে এসে ‘ট্রেবল’ জয়ের দারুণ সম্ভাবনাও আছে বার্সার। কিন্তু রিয়াল নামের বাধাও আছে। রিয়ালকে হারিয়েই অবশ্য গত জানুয়ারিতে স্প্যানিশ সুপার কাপের ফাইনাল জিতে উৎসবে মেতেছিল বার্সা। আজ আরেকটি ধাপ পেরোনোর ক্ষেত্রেও বাধা সেই রিয়ালই।
এমনকি পরের ধাপ অর্থাৎ লা লিগাতেও বাধার নাম রিয়াল। বার্সার চারপাশ এখন সব মিলিয়ে একরকম রিয়ালময়, রীতিমতো অক্টোপাসের মতোই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। তবে এই ফাঁদ কেটে যে বেরিয়ে আসা সম্ভব, সেটা এরই মধ্যে প্রমাণ করেছেন ফ্লিক। এখন ধারাবাহিকতাটুকু ধরে রাখার অপেক্ষা এবং অপেক্ষা প্রথম মৌসুমেই কাতালান ক্লাবটির হয়ে ত্রিমুকুট জিতে ফ্লিকের অমরত্ব লাভের।
ফ্লিকের মাস্টারক্লাস
এই মৌসুমে রিয়ালের বিপক্ষে বার্সার সাফল্যে বড় ভূমিকা রেখেছে ফ্লিকের ক্ষুরধার মস্তিষ্ক। আজ জিততে হলে আরও একবার ট্যাকটিক্যাল জিনিয়াস হিসেবে আবির্ভূত হতে হবে জার্মান কোচকে। চলতি মৌসুমে লা লিগায় প্রথম মুখোমুখিতে রিয়ালের বিপক্ষে বার্সা সাফল্য পেয়েছিল ফ্লিকের হাইলাইন ডিফেন্সের মাস্টারক্লাসে।
রিয়ালকে ১২ বার অফসাইড ফাঁদে ফেলেছিল বার্সা, এমবাপ্পে একাই অফসাইডের ফাঁদে পা দিয়েছিলেন আটবার।
ম্যাচটিতে রিয়ালকে ১২ বার অফসাইড ফাঁদে ফেলেছিল বার্সা, এমবাপ্পে একাই অফসাইডের ফাঁদে পা দিয়েছিলেন আটবার। সেদিন বার্সার ডিফেন্ডারদের কাছে নয়, ডিফেন্সিভ পজিশনের কারণে আত্মসমর্পণ করেছিল রিয়াল আক্রমণভাগ। পাশাপাশি বিল্ড আপেও বার্সা ছিল গতিময় ও নিখুঁত, যা আক্রমণগুলোকে সফলতা দিতেও বেশ কার্যকর ভূমিকা রেখেছিল।
রিয়ালের বিপক্ষে পরের ম্যাচে এই কৌশলে খেলেনি বার্সা। সে ম্যাচে অবশ্য রিয়ালের নখদন্তহীন রক্ষণই বার্সার কাজ সহজ করে দিয়েছিল। সেদিন বার্সার আক্রমণভাগ ও থিবো কোর্তায়ার মধ্যে যেকোনো রক্ষণদেয়াল ছিল না, সেটি ম্যাচের পাঁচ মিনিটের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে যায়। এমনকি প্রথম কয়েক মিনিটের মধ্যে দুটি অলৌকিক সেভ করতে হয় রিয়াল গোলরক্ষক কোর্তোয়াকে।
ম্যাচটিতে রিয়ালের দুর্দশা আঁচ করতে পেরে বার্সাও সর্ব শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এর ফলাফল ৫-২ গোলের জয়। আগের ম্যাচে হাইলাইন ডিফেন্সের ক্লাস নেওয়া ফ্লিক সেদিন নেন পজিশনিংয়ের ক্লাস। কাসাদোকে দিয়ে বেলিংহামকে নিষ্ক্রিয় করে রিয়ালের মিডফিল্ডকে রীতিমতো ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিলেন ফ্লিক।
একই কৌশলের পুনরাবৃত্তি আজ রাতের ম্যাচে হওয়ার সম্ভাবনা সামান্য। ফ্লিকের শক্তি মূলত এ জায়গায়। ট্যাকটিকালি বড় কোনো বদল না আনলেও ম্যাচের মেজাজ বুঝে কিছু জায়গা অদল–বদল করেন, যা বেশির ভাগ সময়ই ম্যাচের পার্থক্য গড়ে দেয় এবং ফল বার্সার পক্ষে নিয়ে আসে।
আজ কেমন হবে ফ্লিকের কৌশল
সেভিয়ার মাঠে আজকের কোপা দেল রে ফাইনালে রিয়ালের তারকাবহুল আক্রমণভাগকে থামাতে ডিফেন্সে কিছু তুকতাক দেখাতে পারেন ফ্লিক। রিয়ালের বিপক্ষে লা লিগার প্রথম ম্যাচের মতো না হলেও, অফসাইড ট্র্যাপ যে ফ্লিক রাখবেন, তা অনুমান করা যায়। চলতি মৌসুমে রিয়াল ছাড়াও অনেক প্রতিপক্ষকে এই ফাঁদে ফেলেছে ফ্লিকের শিষ্যরা।
চ্যাম্পিয়নস লিগে শেষ আটে বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের বিপক্ষে প্রথম লেগে ৪-০ গোলের জয়েও একই কৌশল কাজে লাগিয়েছিল বার্সা। সে ম্যাচে ডর্টমুন্ডকে ৪ বার অফসাইড ট্র্যাপে ফেলেছে বার্সা। এর সঙ্গে ‘লাইন ব্রেকিং’ পাসগুলো তো আছেই। রিয়ালের আক্রমণ নিষ্ক্রিয় করতেও এই কৌশলে খেলাতে পারেন ফ্লিক।
ফ্লিক ‘লাইন ব্রেক’ করার জন্য এ ম্যাচে কাজে লাগাতে পারেন পেদ্রিকে। বার্সার তো বটেই সম্ভবত এই মুহূর্তে বিশ্বের অন্যতম সেরা মিডফিল্ডার পেদ্রি। তাঁকে দিয়েই বার্সা চেষ্টা করবে দ্রুত রিয়ালকে নড়বড়ে করে দিতে, যাতে ইয়ামাল–রাফিনিয়ারা জায়গা বের করে নিয়ে সহজেই আক্রমণে যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে বার্সা হয়তো পাস কম খেলে দ্রুত ওপরের ওঠার দিকে বেশি মনোযোগ দেবে। যাতে প্রতিপক্ষ থিতু হওয়ার খুব বেশি সুযোগ না পায়।
আক্রমণভাগে বার্সার তুরুপের তাস হবেন লামিনে ইয়ামাল ও রাফিনিয়া। রিয়াল যদি নিজেদের সেরা ফুটবল খেলে বার্সাকে চাপে ফেলে তবে সেই চাপ কাটাতে একক নৈপুণ্যের ওপর ভরসা রাখতে হতে পারে বার্সাকে। বড় ম্যাচে কখনো কখনো এমন মুহূর্ত আসে, যখন সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কেউ একজনকে নায়ক হতে হয়। ইয়ামাল-রাফিনিয়াদের মতো ব্যালন ডি’অর–প্রত্যাশীদের আজকের ম্যাচে সে ভূমিকাতে দেখতে চাইবেন বার্সা সমর্থকেরা। সেটি তাঁরা করতে পারলে বার্সার হয়ে নিজেদের স্মরণীয় মৌসুমটাকে আরও বেশি রাঙিয়ে দিতে পারবেন এ দুজন।
লেভার অভাব কতটা ভোগাবে
আগের দুই ম্যাচ বিবেচনায় নিলে রিয়ালের বিপক্ষে বার্সার দুর্বলতা খুঁজে পাওয়া কঠিনই হবে। তবে দুর্বলতার চেয়ে এই ম্যাচে বার্সাকে ভোগাতে পারে একজনের অভাব। আর সেই অভাব মেটাতেও বাড়তি দায়িত্ব নিতে হবে ইয়ামাল ও রাফিনিয়াকে। ওহ্, সেই নামটি তো বলাই হলো না— রবার্ট লেভানডফস্কি। হ্যামস্ট্রিংয়ের চোটের কারণে আজ খেলা হবে না লেভার, যা নিশ্চিতভাবেই দুশ্চিন্তায় রাখবে ফ্লিককে।
লেভার অভাব বার্সার জন্য কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে, একটা পরিসংখ্যানে সেটা বোঝা যাবে। মায়োর্কার বিপক্ষে ম্যাচে বার্সা ৪০টি শট নিয়ে গোল করেছিল মাত্র ১টি। একজন নাম্বার নাইনের অভাব সেদিন বার্সা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। একই দশায় পড়তে হতে পারে রিয়ালের বিপক্ষে ম্যাচেও। তারওপর রিয়ালের গোলপোস্টে থাকবেন কোর্তোয়ার মতো অবিশ্বাস্য ছন্দে থাকা গোলরক্ষক। লেভার না থাকার অভাব দূর করাই এখন বার্সার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের।
বড় ম্যাচে এ ধরনের নানা চ্যালেঞ্জ ও প্রতিকূলতা থাকবেই। ম্যাচটা যদি এল ক্লাসিকোর কোনো ফাইনাল হয়, তবে চ্যালেঞ্জ তো পাহাড়সম। পাশাপাশি এমন ম্যাচে অনেক সময় শক্তি, সামর্থ্য বা দুর্বলতাগুলোর আড়ালে বড় হয়ে ওঠে স্নায়ুচাপ সামলানোর বিষয়টিও। সেই স্নায়ুচাপও আজ প্রতিপক্ষ হয়ে উঠতে পারে বার্সার জন্য। এখন এসব ঝড় সামাল দিয়ে ট্রেবল জয়ের পথে বার্সা প্রথম ধাপটি পেরোতে পারে কি না, সেটাই দেখার অপেক্ষা।