মেসি–রোনালদোদের জাদু আগেই দেখিয়ে গেছেন পেলে

অনেকের কাছে ফুটবলেরই শেষ কথা ছিলেন পেলেরয়টার্স

টেবিলে মা যেভাবে আলতো করে খাবারের প্লেট বাড়িয়ে দেন, পেলের পাসটাও তেমনই ছিল। বাঁ পায়ে বলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ডান পায়ে বলটা ডান দিকে একটু ঠেলে দিলেন। কার্লোস আলবার্তো তখন যেন সেই ‘মায়েরই’ বুভুক্ষ শিশু!

ডান দিক থেকে রোলস রয়েসের মসৃণ গতিতে ছুটে আসছিলেন, ভীষণ ক্ষুধায় বাচ্চারা যেভাবে গোগ্রাসে গিলে নেয়—আলবার্তোর শটও যেন তারই প্রতিরূপ। এক শটে বল ইতালির গোলপোস্টের পেটে (জালে)!

পেলের সেই বাড়িয়ে দেওয়া ‘প্লেট’–এর ‘খাবার’টা তৈরি হয়েছিল মাঠের বাঁ প্রান্তে। ক্লদওয়ালদোর ড্রিবলিংয়ের আড়াই প্যাঁচের পর রিভেলিনো ও জর্জিনিওর নজরবন্দীতে বিবশ হয়ে পড়েছিল ইতালির রক্ষণ।

কেউ খেয়াল করেনি ইতালিয়ান রক্ষণের বাঁ পাশটা তখন গড়ের মাঠ! জনমানবহীন সেই সবুজ প্রান্তর ব্রাজিলিয়ান অ্যাটাকেরই তৈরি করা। যেখান থেকে ‘হুররে হুয়া ক্যায়া মজা’র অনুভূতিতে ছুটে এসেছেন কার্লোস আলবার্তো। পরে ফিফায় এক সাক্ষাৎকারে ১৯৭০ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের এই অধিনায়ক বলেছিলেন, সেই আক্রমণের ছকটা তাঁরা অনুশীলনেই কষেছেন। আর পেলে? তাঁর সেই পাসটা যেন সরল অঙ্কের হিসাব মিলিয়ে দেওয়ার শেষ রাশি। কার্লোস আলবার্তোর শট সেই হিসাবের যোগফল।

আরও পড়ুন

বিশেষজ্ঞরা বলেন, ১৯৭০ বিশ্বকাপ ফাইনালে ব্রাজিলের এই শেষ গোলটি ‘জোগো বনিতো’র চূড়ান্ত রূপ, তাতে পেলের ভূমিকা সামান্য একটা পাস মনে হলেও গোটা ছবিটাকে একসূত্রে গেঁথেছিল ওই পাসটাই।

কিংবা সে বিশ্বকাপেই উরুগুয়ের বিপক্ষে পেলের সেই মিস! টোস্টাওয়ের থ্রু ধরতে উরুগুয়ে গোলকিপারের সামনে চলে এসেছিলেন। পেলেকে ঠেকাতে গোলকিপারও বেশ এগিয়ে এসেছিলেন। দুজনেই মুখোমুখি অবস্থানে। পৃথিবীর প্রায় সব ফরোয়ার্ডই সেখান থেকে অন্তত এক শ উপায়ে গোল করতে পারবেন। কিন্তু সেটি করলে তো আর পেলে হওয়া যায় না! পেলে ভেবেছিলেন এক শ এক নম্বর উপায়টি।

একসঙ্গে মেসি ও পেলে।
ফাইল ছবি

যা কেউ কস্মিনকালেও ভাববে না, পেলে সেই ঝুঁকিটাই নিয়েছিলেন। বলটা ডামি করে গোলকিপারের পেছন দিক ঘুরে এসে ডান পায়ে শট নিলেন। গোল হয়নি কিন্তু পৃথিবী সেদিন দেখেছিল, একটা মিসও কী অপার্থিব প্রতিভার দ্যুতি ছড়ায়—বড় প্রেম যেমন শুধু কাছেই টানে না, দূরেও সরিয়ে দেয়, তেমনি পেলের সেই মিসও বুঝিয়ে দেয়, ব্যাখ্যাতীত প্রতিভা শুধু গোলই করে না, মিসও গোলের চেয়ে সুন্দর হয়।

পেলের মৃত্যুর আগে একটা তর্ক হতো। সেই যুগের খেলোয়াড়দের চেয়ে এই যুগের খেলোয়াড়দের দক্ষতা বেশি। এই তর্কের সমাধান হয়তো কখনোই হবে না। এক যুগের সঙ্গে আরেক যুগের তুলনা যে হয় না। আজ থেকে ৫০–৬০ বছর আগে যে খেলোয়াড়ের দক্ষতা সেই যুগের কোনো কিশোরের চোখে মায়াঞ্জন মেখে দিয়েছে, এত দিন পর সেই কিশোর যখন অস্তগামী সূর্যের মতো জীবনের অনেক কিছু দেখে ফেলে বুড়ো নাম ধারণ করেছেন—তখন তাঁর কাছে লিওনেল মেসি–ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর দক্ষতা অতটা ভালো না–ও লাগতে পারে।

আবার এর উল্টোটাও স্বাভাবিক। মেসি–রোনালদোদের মায়াঞ্জন মাখা কিশোর ইউটিউবে পেলে–ম্যারাডোনোর খেলা দেখে ভাবতেই পারে, নাহ! বড়রা যেমন বলে, আসলে তেমন না!

আরও পড়ুন

ম্যানচেস্টার সিটির ২২ বছর বয়সী তারকা আর্লিং হলান্ড কিশোর নন, তিনি এই পৃথিবীর তরুণ ফুটবলমোদীদের প্রতিনিধি। পেলের অনন্তযাত্রার পর তাঁর টুইট, ‘খেলোয়াড়দের এখন যা করতে দেখেন, পেলে সেসব করে রেখেছেন সবার আগে। শান্তিতে ঘুমোন।’

ফুটবলের ‘রাজা’ ঘুমিয়ে যাওয়ার পর ব্রাজিলের ‘সম্রাট’–এর কথা মনে পড়তে পারে। ২০০৪ কোপা আমেরিকা ফাইনালে আদ্রিয়ানোর সেই গোলটি! আর্জেন্টিনার বক্সের ঠিক মাথা থেকে বাঁ পায়ের গোলার মতো শটে গোল করেছিলেন ‘সম্রাট’খ্যাত আদ্রিয়ানো। শটটি খুব কঠিন ছিল। খুব কম জায়গার মধ্যে বুটের মাথা দিয়ে বলটা ঘুরিয়ে মারতে হয়েছিল।

ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ও পেলে।
ছবি: এএফপি

সান্তোসের জার্সিতে ঠিক একই রকম গোল আছে পেলের। ইউটিউব তা মিলিয়ে দেখার সুযোগ করে দিয়েছে। লা লিগায় দেপোর্তিভোর বিপক্ষে প্রতিপক্ষের বক্সে দুই পায়ের ভেতর বল নিয়ে প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারকে ‘জিগজ্যাগ’ ডজে জিনেদিন জিদান যে গোল করেছিলেন, ঠিকই একই রকম গোল আছে পেলেরও। পার্থক্য একটাই, পেলের ডজে ডিফেন্ডার পড়ে গিয়েছিলেন।

ডজের কথা উঠলে ব্রাজিলের ‘ফেনোমেন’–এর কথা উঠতে বাধ্য। চিতার গতিতে ‘নাটমেগ’ করতেন। ১৯৯৭ সালে ফ্রান্সের বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচে রোনালদো বল পায়ে ছুটছিলেন মাঝমাঠ দিয়ে। বাঁ পাশ দিয়ে এক ডিফেন্ডার ও ডান পাশ দিয়ে আরেক ডিফেন্ডার এসে তাঁর গতিপথ ছোট করতে চেয়েছিলেন। রোনালদো ডান পাশের ডিফেন্ডারকে ‘নাটমেগ’ (পান্না মুভ) করে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। অবিশ্বাস্য ব্যাপার, হুবহু ‘কার্বন কপি’ মুভ আছে পেলেরও। সেটাও সান্তোসের জার্সিতেই।

ফ্ল্যামেঙ্গোর হয়ে রোমারিওর দূরপাল্লার সেই গোল! বক্সের বেশ বাইরে থেকে ডান পায়ের শটে, একই রকম গোল করে গেছেন পেলেও। ১৯৭০ বিশ্বকাপে সাবেক চেকোশ্লোভাকিয়ার বিপক্ষে ব্রাজিলের প্রথম ম্যাচে নিজেদের অর্ধ থেকে শট নিয়েছিলেন পেলে। প্রতিপক্ষ গোলকিপার একটু এগিয়ে থাকায় সুযোগটা নেন। বল ভাসতে ভাসতে পোস্টের বাঁ পাশ দিয়ে অল্পের জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। ‘মার্কা’র মতে, অমন কিছু এর আগে কখনো দেখা যায়নি।

পরে ১৯৯৬ সালে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে ডেভিড বেকহাম নিজেদের অর্ধ থেকে একই রকম দূরপাল্লার শট নিয়েছিলেন উইম্বলডনের বিপক্ষে। সেটা গোল হয়েছিল বলেই কি লোকে পেলের সেই চেষ্টা ভুলে গেছে? কে জানে!

আরও পড়ুন

কিংবা নেইমারের কথাই ধরুন, সতীর্থের পাস বুটের ডগা দিয়ে ওপরে তুলে শরীর ঘেঁষে থাকা ডিফেন্ডারের ওপাশে ফেলে দৌড় দিতে অভ্যস্ত পিএসজি তারকা। পেলে এমন হরহামেশাই করেছেন। ২০১৪ বিশ্বকাপে স্পেনের বিপক্ষে ‘ফ্লাইং ডাচম্যান’ হয়ে রবিন ফন পার্সির সেই হেডে করা গোল? পেলের তেমন গোলও আছে সান্তোসের জার্সিতে। ‘সাদা পেলে’খ্যাত ফ্লামেঙ্গোর কিংবদন্তি জিকোরও গোলকিপারকে ডামি করে করা গোল আছে।

পেলে ও এমবাপ্পে
ছবি: এএফপি

কিন্তু সেটি পেলের মতো অত ক্ষুরধার ছিল না। ফুটবলের ভাষায়, সময় পেয়েছিলেন প্রচুর। পেলে হয়তো এ জন্যই বলে গেছেন, ‘খেলার স্টাইলে জিকো আমার সবচেয়ে কাছাকাছি।’ কাতার বিশ্বকাপে রিচার্লিসনের মতো বাইসাইকেল কিকে গোল? সেটাও আছে পেলের। ইউটিউবে পেলের সেই গোলের ভিডিও খুবই জনপ্রিয়। আর মেসি?

তিল পরিমাণ জায়গায় ডিফেন্ডারদের দঙ্গলের মধ্যে সাপের মতো আঁকাবাঁকা ড্রিবলিংয়ে গোল করতে মেসির জুড়ি মেলা ভার। ভুল। পেলেই মেসির সেই জুড়ি। মেসির মতোই ইনসাইড–আউটসাইড ডজে সান্তোসে গোলের সংখ্যা তাঁর কম নেই। ইউটিউবে দেখে নিতে পারেন।

আর ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর হেডের দক্ষতা নিয়ে যে আলোচনা হয়, পেলে সেটাও করে দেখিয়েছেন ইতালির বিপক্ষে ১৯৭০ বিশ্বকাপ ফাইনালে। নিজের উচ্চতার চেয়ে কয়েক ইঞ্চি লম্বা ডিফেন্ডারের চেয়ে উঁচুতে উঠে হেডে গোল করেছিলেন।

আরও পড়ুন

রোনালদিনিওর ‘ইলাস্টিকো’, ডিয়েগো ম্যারাডোনোর শূন্যের ওপর বল নিয়ন্ত্রণ এবং পাস দেওয়া, রিভেলিনোর ‘ফ্লিপ–ফ্ল্যাপ’—এসবের সবই পেলের মধ্যে ছিল। স্টেপ ওভারেও কারও চেয়ে কম কিছু ছিলেন না।

বার্সায় রোনালদিনিওর পিঠের ব্যবহারে করা সেই বিখ্যাত পাসের মতো পাসও আছে পেলের। তাঁরই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ম্যারাডোনা সে জন্যই বুঝি বলেছিলেন, ‘পেলেকে নিয়ে আর কিছুই বলার নেই। সে পিঠ, বুক ও কাঁধ দিয়ে বল নিয়ন্ত্রণ করে গোল করে, করায়।’

গোল বাদ দিন। বল পায়ের পেলের দৌড়টাও কি তখন সমর্থকদের দুঃখ ভুলিয়ে দিত না? এখন মেসি দৌড়ালে, রোনালদো দৌড়ালে ঠিক যেভাবে মনের দুঃখ ভুলে যান সমর্থকেরা। সে সময় পেলেও বল পায়ে টান দিলে একই অনুভূতি হতো সমর্থকদের।

কিংবা সে সময়েরই কোনো দর্শক, যিনি এখন হয়তো জীবন সায়াহ্নেও খেলা দেখেন, তেমন কেউ মেসির বল পায়ে টান দেখে যদি কল্পনার আবিরে ভেবে নেন এই তো পেলে! সেই একই টান, স্বাদ আর প্রতিভার গন্ধে ম–ম করে!

তখন তুলনায় ডুববেন না ফুটবলের সৌন্দর্যে মজবেন—সেই সিদ্ধান্ত আপনার।