দেশি হয়েও ‘ফরেন প্লেয়ার’ সানোয়ার  

বাংলাদেশের তরুণ ফুটবলার সানোয়ার হোসেন। অনেকেই তাঁকে আফ্রিকান বলে ভুল করে!ছবি: সংগৃহীত

১৯ বছরের ছেলেটিকে দেখলে বাংলাদেশি মনে হবে না আপনারও। বরং আফ্রিকান বলে ভুল হতে পারে। 

‘আমি যেখানেই যাই, সবাই বলে ‘‘ফরেন’’। অনেকে বলে, এই আফ্রিকান কই থেকে আসল। অনেক ভিড় হয় আমাকে ঘিরে। অনেকে বলে ফরেন খেলতেছে।’ বদলে যাওয়া আত্মপরিচয় নিয়ে মজা করে বলছিলেন তরুণ ফুটবলার সানোয়ার হোসেন। 

 বাংলাদেশ জাতীয় অনূর্ধ্ব-১৩, ১৪, ১৫, ১৬, ১৭ দলে খেলেছেন সানোয়ার। বর্তমানে বাফুফে আয়োজিত পেশাদার ফুটবল লিগের দ্বিতীয় স্তর চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে ঢাকা ওয়ান্ডারার্সে খেলছেন ডিফেন্ডার হিসেবে। সেখানেও তাঁর পরিচয় ‘ফরেন’। লিগের ভেন্যু কমলাপুর স্টেডিয়ামে বসে সানোয়ার সেটাই বলছিলেন, ‘সবখানেই ফরেন শব্দটা শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি এখন। আমার নামই যেন এখন ফরেন। দেখলেই লোকজন তাকিয়ে থাকে। মনে করে, আফ্রিকা থেকে এসেছি।’

২০১৭ সালে কাতারে বাংলাদেশের হয়ে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৭ টুর্নামেন্টে খেলতে যান সানোয়ার
ছবি: সংগৃহীত

টাঙ্গাইলের সখীপুরে তাঁর জন্ম। বাবা দেলোয়ার হোসেন সৌদি আরব থাকেন। বড় ভাই সামিউল ইসলাম গত বছর প্রথম বিভাগ ফুটবলে খেলেছেন। পরিবারে সানোয়ারের মতো আর কেউ নেই। তিনিই ব্যতিক্রম এবং ‘ফরেন’ পরিচয়টা উপভোগও করেন ছোট থেকেই। ফুটবলে অনুরক্ত সানোয়ার স্থানীয় ইউনিয়ন ফুটবল প্রতিযোগিতায় সেরা খেলোয়াড় হয়েছেন। ২০১৫ সালে বিকেএসপিতে ভর্তি হয়ে ২০২২ সালে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে এখন ফলাফলের অপেক্ষায়।

কেউ খেপের জন্য নিতে এলে আমি নিজে আফ্রিকানদের মতো বাংলা–ইংরেজি মিশিয়ে বলি, এই ভায়া, হাউ মাচ মানি ইউ গিভ মি। ইউ গিভ মি টেন থাউজেন্ড। মি বুক। ফাইভ থাউজেন্ড নো পসিবল। মাঠে খেলার সময়ও এভাবে বলি, এ ভায়া, গিভ মি বল (হা হা হা)
সানোয়ার হোসেন, ফুটবলার

এইটুকুন জীবনে ‘ফরেন’ হওয়ার বিস্তর সুবিধা পাচ্ছেন সানোয়ার। সেটার একটা বর্ণনাও দেন, ‘দেশি ফুটবলাররা ঢাকার বাইরে একটা খেপে ৫ হাজার টাকা পেলে ফরেনরা পায় ৮-১০ হাজার। আমিও ফরেনদের মতোই টাকা পাই।’ বিভিন্ন জেলায় ‘ফরেন’ পরিচয়ে খেলতে গিয়ে কৌশলে চুপচাপ থাকেন সানোয়ার, যেমন বিদেশিরা থাকেন। আফ্রিকানদের মতো ইংরেজি উচ্চারণে কথা বলেন। সেটা কেমন? সানোয়ার বলেন, ‘যেমন ধরুন, কেউ খেপের জন্য নিতে এলে আমি নিজে আফ্রিকানদের মতো বাংলা–ইংরেজি মিশিয়ে বলি, এই ভায়া, হাউ মাচ মানি ইউ গিভ মি। ইউ গিভ মি টেন থাউজেন্ড। মি বুক। ফাইভ থাউজেন্ড নো পসিবল। মাঠে খেলার সময়ও এভাবে বলি, এ ভায়া, গিভ মি বল (হা হা হা)।’ 

অনেক সময় সানোয়ারকে মেটাতে হয় অনেকের সঙ্গে ছবি তোলার আবদার
ছবি: সংগৃহীত

মাঠের বাইরেও তাঁকে নিয়ে পড়ে হুলুস্থুল। গাজীপুর খেলতে গেলে কয়েকটি মেয়ে ছবি তুলতে আসেন। পরে তাঁর আসল পরিচয় জেনে সবার নাকি হাসিতে গড়াগড়ি অবস্থা। নরসিংদীতে খেলতে গেলে এক দর্শক বলেছিলেন, ‘আমি ওই ছোট ফরেনটার সঙ্গে ছবি তুলব।’ গজারিয়ায় খেপ খেলতে গিয়ে গোল করে পড়েন ছবিশিকারিদের কবলে। ‘এক-দেড় শ দর্শকের সঙ্গে সেদিন ছবি তুলতে হয়েছে ম্যাচ শেষে। ওরা ভেবেছে আমি আফ্রিকান। কিন্তু কিছুতেই ছাড়ছিল না আমাকে। শেষে বিরক্ত হয়ে বলি, ভাই আমি দেশি প্লেয়ার। আমাকে ছাড়েন।’ 

এএফসি মনে করেছে, আমি বাংলাদেশি নই, আফ্রিকান। আমার জন্মসনদসহ সব দেখানোর পর ওরা বুঝতে পারছে আমি বাংলাদেশেরই।
সানোয়ার হোসেন, বাংলাদেশের তরুণ ফুটবলার

কদিন আগে এক চায়ের দোকানে গিয়ে সানোয়ার শোনেন, ‘হয়্যার ইউ আর ফ্রম, নাইজেরিয়া?’ সানোয়ার রহস্য না রেখে বলে দেন, ‘আমি বাংলাদেশি, ভাই।’

 শুধু কি তা-ই? কিছু কিনতে গেলেও নাটকীয়তার জন্ম হয়। সানোয়ার দোকানদারকে বলেন, ‘এ মামা, দিস ইজ হোয়াই ওয়ান থাউজেন্ড। নো পসিবল।’ শুনে অনেকে ইংরেজিতে উত্তর দেয়। সানোয়ারের ভাষায়, ‘এভাবে অনেক মানুষকে বোকা বানাই।’ 

একদিন বোকা বানান এক বাস কন্ডাক্টরকেও। কিশোরগঞ্জ খেলতে যেতে গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে সানোয়ার বাসে উঠে আফ্রিকানদের মতো করে বলেন, ‘হে ব্রাদার, হোয়াই নো সিট। নট গিভ সিট, মি নো গো।’ তাঁর সঙ্গী বন্ধু বাস কন্ডাক্টরকে মজা করে বলেন, ‘ভাই, ও খুব রেগে গেছে। ওকে সিট দিতে হবে।’ পরে সানোয়ারকে সিট দেওয়া হয় বাসে এবং আসনে বসে তিনি মুচকি হাসেন।

সানোয়ার হোসেন
ছবি: সংগৃহীত

তবে ‘ফরেন’ হওয়ার বিড়ম্বনাও আছে। ২০১৭ সালে কাতারে বাংলাদেশের হয়ে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৭ টুর্নামেন্টে খেলতে যান সানোয়ার। সেখানে এএফসি কর্তৃপক্ষ তাঁকে বিদেশি ভেবে আপত্তি তোলে। যা বলার সময় সানোয়ারের হাসি আর থামেই না, ‘এএফসি মনে করেছে, আমি বাংলাদেশি নই, আফ্রিকান। আমার জন্মসনদসহ সব দেখানোর পর ওরা বুঝতে পারছে আমি বাংলাদেশেরই।’

কদিন আগে ঢাকার কদমতলায় ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের সভা ছিল। সেখান থেকে ফেরার সময় পুলিশ সানোয়ারকে আফ্রিকান ভেবে পাসপোর্ট দেখতে চায়। কী আর করা, শেষমেশ বিকেএসপির ছাত্র পরিচয়ের কার্ড দেখিয়ে পরিত্রাণ মেলে।

সানোয়ার কখনো ভুলবেন না সেই ঘটনাটা। যতবারই বিদেশে খেলতে গেছেন, অন্য দলগুলো তাঁর দিকে আলাদাভাবে তাকাত। নিজেই বলেন, ‘সবাই মনে করে, আমি বাংলাদেশ টিমে কী করে এলাম।’

কদিন আগে ঢাকার কদমতলায় ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের সভা ছিল। সেখান থেকে ফেরার সময় পুলিশ সানোয়ারকে আফ্রিকান ভেবে পাসপোর্ট দেখতে চায়। কী আর করা, শেষমেশ বিকেএসপির ছাত্র পরিচয়ের কার্ড দেখিয়ে পরিত্রাণ মেলে। তবে বিড়ম্বনা সাময়িক, ‘ফরেন’ তকমাটা বেশির ভাগ সময়ই উপভোগ করেন সানোয়ার।