নেইমারকে ভালো হতে দিল না চোট
অনেকে আশায় বুক বাঁধলেও ঘুরেফিরে সেই পুরোনো গল্পই দানা বেঁধে উঠল। যে গল্পের শিরোনামও সবার জানা—চোটের কারণে খেলতে পারছেন না নেইমার।
সম্প্রতি শিরোনামটি ফিরে এসেছে ব্রাজিল জাতীয় দলের সূত্রে। চলতি মাসেই বিশ্বকাপ বাছাইয়ে কলম্বিয়া ও আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ম্যাচের জন্য নেইমারকে ফিরিয়ে স্কোয়াড ঘোষণা করেছিলেন ব্রাজিল কোচ দরিভাল জুনিয়র। এর মধ্য দিয়ে চোট কাটিয়ে ১৬ মাস পর আবারও ব্রাজিল দলে ফিরেছিলেন এই ফরোয়ার্ড। অপেক্ষা ছিল শুধু মাঠে নামার। কিন্তু গত ২ মার্চ ব্রাগান্তিনোর বিপক্ষে সান্তোসের ম্যাচে পায়ের পেশিতে পাওয়া চোট কাল হয়ে দাঁড়াল। এই চোট থেকে সেরে না ওঠায় নেইমারকে বিশ্বকাপ বাছাইয়ের স্কোয়াড থেকে বাদ দিতে বাধ্য হয়েছে ব্রাজিল।
নেইমার নিজেও কতটা আশাহত হয়েছেন, সেটা বোঝা যায় তাঁর প্রতিক্রিয়ায়। ইনস্টাগ্রাম স্টোরিতে লিখেছেন, ‘মনে হচ্ছিল, ফেরার খুব কাছাকাছি আছি। কিন্তু বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জার্সিটি আমি এই মুহূর্তে পরতে পারব না। আমাদের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে এবং সবাই জানে আমার ফেরার ইচ্ছা কতটা। কিন্তু আমরা ঝুঁকি না নিতে এবং সম্পূর্ণভাবে চোটমুক্ত (ফেরার বিষয়ে) বিষয়ে একমত হয়েছি।’
কিন্তু প্রশ্ন হলো, নেইমার কি কখনো সম্পূর্ণরূপে চোটমুক্ত হতে পারবেন?
২০২৩ সালের অক্টোবরে ব্রাজিলের হয়ে খেলার সময় বাঁ হাঁটুতে এসিএল ও মেনিসকাস চোটে পড়েন নেইমার। এসিএল বা অ্যান্টেরিয়র ক্রুসিয়েট লিগামেন্ট চোট এমনিতেই ভয়ংকর। একবার এ চোটে পড়লে দীর্ঘদিন মাঠের বাইরে থাকতেই হয়, পাশাপাশি আবারও চোটে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। এর আগে পিএসজিতে থাকতে দুই মৌসুমে দুবার ডান পায়ের মেটাটারসেল হাড় ভেঙেছিল নেইমারের। তখন বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছিলেন, একই হাড়ে বার বার ভাঙনের কারণে ভবিষ্যতেও তিনি এই চোটে পড়তে পারেন। এখনো তা থেকে মুক্ত থাকলেও ভবিষ্যতে কী হবে কেউ জানে না। এ ছাড়া নেইমারের পায়ে অস্ত্রোপচারও হয়েছে একাধিকবার। সম্পূর্ণরূপে চোটমুক্ত না হওয়ার শঙ্কাটা তাই থাকেই।
নেইমারের চোটের অতীত ইতিহাস কিন্তু ইতিবাচক ইঙ্গিত করছে না। ট্রান্সফারমার্কেট ওয়েবসাইটে নেইমারের ২০১৩ সালে বার্সেলোনায় যোগদান থেকে চোটের তথ্য লিপিবদ্ধ করা আছে। যদিও পেশাদার ক্যারিয়ারের প্রথম চার বছরেও (২০০৯ থেকে ২০১৩) ক্লাব ও জাতীয় দলে খেলতে গিয়ে চোটে পড়েছিলেন তিনি।
পেশাদার ক্যারিয়ারে নেইমার এ পর্যন্ত ৭২৬টি প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ খেলেছেন। ক্লাব ক্যারিয়ারে খেলেছেন ৫৯৮ ম্যাচ, জাতীয় দলে ১২৮। এর মধ্যে ২০১৩ সালে বার্সায় অভিষেকের আগপর্যন্ত সান্তোসে খেলেছেন ২২৫ ম্যাচ, ব্রাজিলের জার্সিতে ৪০। দুয়ে মিলিয়ে ২৬৫ ম্যাচ চোটের বিস্তারিত তথ্যের বাইরে আছে।
ট্রান্সফারমার্কেট জানাচ্ছে, ২০১৩ সালে বার্সায় যোগ দেওয়া পর সে বছরের ১৮ আগস্ট ক্লাবটির হয়ে অভিষেক থেকে এখন পর্যন্ত (২০২৪–২৫ মৌসুমে আজকের দিন) ক্লাব ও জাতীয় দলে মোট ৪৬১টি ম্যাচ খেলেছেন নেইমার। এই সময়ে চোট, অসুস্থতা ও বিশ্রামের কারণে খেলতে পারেননি ২৪২ ম্যাচ। যদি বিশ্রামজনিত কারণে ও করোনা মহামারির সময়ে তাঁর খেলতে না পারা ম্যাচের সংখ্যা (৪ ম্যাচ বিশ্রাম, ১ ম্যাচ করোনা) বিয়োজনও করা হয়, তবু সংখ্যাটি অবিশ্বাস্য—২৩৭!
অর্থাৎ নেইমার গত সাড়ে ১১ বছরে যত ম্যাচ খেলেছেন, চোটের কারণে তার অর্ধেকেরও বেশি ম্যাচ মিস করেছেন! এ সময়ে তিনি মাঠের বাইরে ছিলেন ১৩৯১ দিন। এর মধ্যে বিশ্রাম ও করোনা মহামারির সময় মিলিয়ে মোট ২২ দিন ছিলেন মাঠের বাইরে, যেখানে কারণটা আসলে চোট নয়। তাহলে হিসাব দাঁড়ায় চোট এবং চোটজনিত ফিটনেস সমস্যার কারণে নেইমার এ সময়ে মাঠের বাইরে ছিলেন মোট ১৩৬৯ দিন। বছরের হিসাবে এই সাড়ে ১১ বছরের মধ্যে প্রায় ৩ বছর সাত মাসের বেশি সময় তিনি চোটের কারণে মাঠের বাইরে ছিলেন।
২০১৩–১৪ মৌসুম থেকে ২০২৪–২৫ মৌসুম পর্যন্ত এ সময়ে নেইমার সবচেয়ে বেশি ম্যাচ মিস করেছেন ২০২৩–২৪–এ। মাংশপেশি ও এসিএল মিলিয়ে গত মৌসুমে দুই দফায় চোটের কারণে মাঠের বাইরে ছিলেন ৩৭১ দিন। অর্থাৎ এক বছরের কিছু বেশি সময়। ক্লাব ও জাতীয় দল মিলিয়ে এ সময়ে মিস করেছেন ৫৩ ম্যাচ। সবচেয়ে বেশি চোটে পড়েন ২০১৮–১৯ মৌসুমে। পায়ের মেটাটারসেল, অ্যাঙ্কেল, অ্যাডাক্টর মিলিয়ে মোট ৭ বার চোটে পড়ে মাঠের বাইরে ছিলেন ১৭৭ দিন, ম্যাচ মিস করেছেন ৩৬টি।
নেইমার সর্বশেষ ১২ মৌসুমের মধ্যে ৬ মৌসুমে চোটের কারণে ন্যূনতম ১০০ দিন করে মাঠের বাইরে ছিলেন। ২০২৩–২৪ ও ২০১৮–১৯ মৌসুমের কথা তো বলাই হয়েছে। এর বাইরে বাকি চার মৌসুম হলো ২০২৪–২৫ (১২০ দিন, এর মধ্যে ফিটনেস সমস্যাতেই ৭৭ দিন, ৩ চোট, ১৯ ম্যাচ মিস— যেটা সামনে আরও বাড়বে), ২০২২–২৩ (১৪১ দিন, ২ চোট, ১৭ ম্যাচ মিস), ২০২১–২২ (১১৫ দিন, ৪ চোট, ২১ ম্যাচ মিস) ও ২০১৭–১৮ (১২০ দিন, ৫ চোট ২৪ ম্যাচ মিস)। ২০২০–২১ মৌসুমেও নেইমার ১০০ দিন মাঠের বাইরে ছিলেন। তবে সে মৌসুমে ১২ দিন কেটেছে বিশ্রাম ও করোনা মহামারির কারণে।
চোটের কারণে নেইমার সবচেয়ে কম ম্যাচ মিস করেছেন ২০১৪–১৫ ও ২০১৬–১৭ মৌসুমে। এ দুটি মৌসুমে দুবার করে চোটে পড়ে ৩টি করে ম্যাচ মিসের পাশাপাশি যথাক্রমে ৩৯ ও ১৬ দিন মাঠের বাইরে ছিলেন ব্রাজিল ফরোয়ার্ড। বার্সায় অভিষেক মৌসুমেই (২০১৩–১৪) অবশ্য নেইমারের ‘ট্রেডমার্ক’—মানে তাঁর চোটপ্রবণতা প্রকাশ পেয়ে গিয়েছিল। সে মৌসুমে দুবার চোটে পড়ে ৫৯ দিন মাঠের বাইরে থাকার পথে ১৭ ম্যাচ মিস করেন নেইমার।
গল্পটা তাই শুরু থেকে আসলে আর পাল্টায়নি।