কান্না থেকে ক্লাইম্যাক্স—অবশেষে ভাগ্য ফিরল অভাগাদের
অপেক্ষারও একদিন শেষ হয়।
পথ যতই দীর্ঘ হোক, যতটা নীরব হোক প্রহর, একসময় ঠিকই আসে সেই মুহূর্ত—যখন ক্লান্ত চোখের সামনে সত্যি হয়ে দাঁড়ায় বহুদিনের স্বপ্ন।
যে স্বপ্ন, যে গল্পগুলো বারবার থেমে গিয়েছিল মাঝপথে, প্রান্তে, প্রায় শেষে—মুখ থুবড়ে পড়েছিল সম্ভাবনার নিষ্ফল প্রতীক্ষা নিয়ে; সেই গল্পগুলোই এবার জেগে উঠেছে, লিখেছে নতুন ইতি। জয়ের শেষ বিন্দু ছুঁয়ে বলেছে, ‘আমরাও পারি। আমরাও এখন ইতিহাস।’
ফুটবল থেকে ক্রিকেট—ইংল্যান্ড, বেলজিয়াম থেকে শুরু করে অস্ট্রেলিয়া, ভারত—এই মৌসুমে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ট্রফি জয়ের আরাধ্যের মুহূর্তের দেখা পেয়েছে সেসব দল, যারা তৃষ্ণার্ত হয়ে ছিল দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। যা আবার কারও জন্য ছিল কখনোই না পাওয়ার দুঃখ। যাদের কণ্ঠস্বরে ছিল কেবল আক্ষেপ আর হাহাকারের শব্দ, তাদের গলায় এবার প্রতিধ্বনিত হয়েছে বিজয়ের জয়গান। ২০২৫ হয়ে উঠেছে সেই বছর, যখন না পাওয়ারা পেয়েছে, অপেক্ষারা ছুঁয়েছে পূরণের শিখর। আর অসমাপ্ত গল্পগুলো শেষ হয়েছে এক সোনালি পরিসমাপ্তিতে।
এমন পূর্ণতার অনুভূতি কী, বিরাট কোহলিকেই জিজ্ঞাসা করে দেখুন। ক্রিকেট দুনিয়ার সবচেয়ে বড় তারকা। ওয়ানডে বিশ্বকাপ, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, চ্যাম্পিয়নস ট্রফি—আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রায় সব জিতেছেন। কিন্তু আইপিএল ট্রফি ছিল না। ছিল না আসলে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুরই।
২০০৮ সালে আইপিএল শুরুর প্রথম দিন থেকেই একসঙ্গে পথচলা বেঙ্গালুরু ও কোহলির। ১৭ বছরের দীর্ঘ পথচলায় তিনবার ফাইনালে উঠলেও ট্রফি অধরাই ছিল। অথচ বছর চারেক আগে আইপিএলে নাম লেখানো দলেরও ট্রফি আছে।
অবশেষে দেড় যুগের প্রতীক্ষা শেষে বেঙ্গালুরু ও কোহলির সেই অধরা স্বপ্ন পূরণ হয়েছে এবার। ৩ জুন আহমেদাবাদের ফাইনালে পাঞ্জাব কিংসকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো আইপিএল চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বেঙ্গালুরু। কোহলি পেয়েছেন কাঙ্ক্ষিত সেই ট্রফির ছোঁয়া।
সমর্থকেরাও যেন প্রস্তুত ছিলেন এমন এক বিজয়ের বিস্ফোরণে ডুবে যেতে। বেঙ্গালুরুর জয়যাত্রা শহরে ফিরতেই হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে রাস্তায়। আবেগের উচ্ছ্বাসের মধ্যেই হুড়োহুড়িতে পদদলিত হয়ে ঝরে গেছে ১১ প্রাণ। এ ঘটনায় পরিকল্পনার ঘাটতি আর অব্যবস্থাপনা অবশ্যই ছিল। তবে এই বিপুল জনসমাগমের (কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রীর ভাষ্য ২-৩ লাখ) মূলে যে ছিল দীর্ঘ অপেক্ষার হাহাকার, তা তো সহজেই অনুমেয়।
বছরের হিসাব করলে অবশ্য আতলেতিকো প্লাতেনসের কাছে বেঙ্গালুরু কিছুই নয়। আর্জেন্টিনার এই ফুটবল ক্লাবের প্রতিষ্ঠা সেই ১৯০৫ সালে। এক শ বছরের বেশি পেরিয়ে গেলেও দলটি কখনো আর্জেন্টিনার শীর্ষ লিগ প্রিমেরা ডিভিশনে চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত তাদের ১২০ বছরের অপেক্ষা ঘুচেছে ১ জুন, ফাইনালে উরাকানকে ১-০ গোলে হারিয়ে।
দক্ষিণ আমেরিকা অঞ্চলে প্লাতেনসের নাম অনেকের কাছে নতুন মনে হতে পারে। তবে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের সুবাদে ক্রিস্টাল প্যালেস নামটা এ দেশে বেশ পরিচিতই। লন্ডনের এই ক্লাব নিজেদের ইতিহাসে প্রথম বড় শিরোপা জিতেছে গত ১৭ মে। ১৯০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত প্যালেস ওয়েম্বলিতে অনুষ্ঠিত এফএ কাপ ফাইনালে ম্যানচেস্টার সিটিকে হারিয়ে। এফএ কাপ সেই প্রতিযোগিতা, যেটা প্রিমিয়ার লিগের ‘বিগ সিক্স’-ই বেশি জেতে। ১৯৯৫ সালের পর শীর্ষ ছয় দলের বাইরে প্যালেস মাত্র চতুর্থ দল। আর অর্জনটা এসেছে কিনা ১১৯ বছর অপেক্ষার পর!
ইংল্যান্ডের যেমন এফএ কাপ, নেদারল্যান্ডসের ফুটবলে তা কেএনভিবি কাপ (ডাচ কাপ)। সেই ১৯৩৩ সালে, যখন নেদারল্যান্ডসে পুরোদমে জাতীয় পর্যায়ে লিগ শুরু হয়নি, তখন সর্বশেষ ট্রফি জিতেছিল গো অ্যাহেড ইগলস। ৯২ বছর পর ডেভেনটার শহরের ক্লাবটি এবার ডানা মেলেছে, প্রথমবারের মতো জিতেছে কেএনভিবি কাপ।
বেলজিয়ামের সেন্ট জিলোয়াসের অপেক্ষাও নয় দশকের। সেটি অবশ্য শীর্ষ লিগের শিরোপার জন্য। সেই ১৯৩৪-৩৫ সালের পর বেলজিয়ান প্রো লিগ জিততে পারছিল না ক্লাবটি। মাঝে নামতে নামতে চতুর্থ স্তরেও নেমে গিয়েছিল। পাঁচ বছর আগে শীর্ষ লিগে ফেরা দলটি এ বছর হয়েছে বেলজিয়ান প্রো লিগে চ্যাম্পিয়ন, ৯০ বছর পর!
ইংল্যান্ডের নিউক্যাসলও ইউনাইটেডও ভেঙেছে পুরোনো ব্যর্থতার দেয়াল। বর্তমানে সৌদি আরবের মালিকানাধীন ক্লাবটি সর্বশেষ বড় কোনো ট্রফি তারা জিতেছিল ১৯৫৫ সালে। এবার সেই দীর্ঘশ্বাসের ইতি টেনেছে লিগ কাপের (কারাবাও কাপ নামে পরিচিত) ফাইনালে লিভারপুলকে ২-১ গোলে হারিয়ে।
উত্তর ইংল্যান্ডের ক্লাবটি এবার লিগ কাপ জেতার মাধ্যমে বড় ধরনের একটি ধারাও ভেঙেছে। ২০১৫ সালের পর থেকে এক দশক ধরে লিগ কাপে রাজত্ব করেছে লিভারপুল, ম্যানচেস্টার সিটি ও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডই।
ইতালির ক্লাব বোলোনিয়ার অর্জনও অনেকটা এমনই। ১৯৭৪ কোপা ইতালিয়ার পর আর আর কোনো ট্রফিরই দেখা পাচ্ছিল না ক্লাবটি। অবশেষে এবার অপেক্ষা ঘুচেছে কোপা ইতালিয়ার ফাইনালে এসি মিলানকে (১-০) হারিয়ে। বোলোনিয়ার আগে কোপা ইতালিয়ার সর্বশেষ ১৬টি ট্রফিই জিতেছিল ঘুরেফিরে চারটি ক্লাব।
জার্মানিতে এবার জার্মান কাপ জিতেছে স্টুটগার্ট। এখানেও আছে দীর্ঘ অপেক্ষার অবসানের গল্প। ২০০৭ সালে বুন্দেসলিগা জয়ের পর দেড় যুগ আর কোনো ট্রফিই জিততে পারেনি স্টুটগার্ট। এবার ফাইনালে তৃতীয় স্তরের ক্লাব আর্মিনিয়াকে হারিয়ে ট্রফি হাতে তুলেছে দলটি; যেন দীর্ঘ শুষ্ক মরু শেষে এসেছে এক উদার বর্ষা।
তবে ক্লাব ফুটবলের এই দীর্ঘ অপেক্ষার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত নাম দুটি টটেনহাম ও পিএসজি। লন্ডনের টটেনহাম ২০০৮ সালে লিগ কাপ জয়ের পর ১৭ বছর কোনো ট্রফি জিততে পারেনি। এই সময়ের মধ্যে ১১ বছর কাটিয়ে ট্রফি জেতার জন্য বায়ার্ন মিউনিখে চলে গেছেন হ্যারি কেইন। আরেক তারকা সন হিউন মিনও শূন্য হাতে কাটিয়ে দিয়েছেন ৯ মৌসুম। এবার ইউরোপা লিগ জিতে তাদের সেই অতৃপ্তি শেষ হয়েছে। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে হারিয়ে ১৯৮৪ উয়েফা কাপের পর প্রথম ইউরোপীয় ট্রফি ঘরে তুলেছে টটেনহাম।
আর পিএসজি? টটেনহামের চেয়েও ট্রফির জন্য বড় অপেক্ষা ছিল পিএসজির। এক যুগের বেশি সময় আগে কাতারি মালিকানায় যাওয়ার পর থেকে ট্রফির জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে প্যারিসের ক্লাবটি। নিয়মিত ঘরোয়া ট্রফি জিতলেও অধরা থেকে যাচ্ছিল ইউরোপীয় ট্রফি। এমনকি লিওনেল মেসি, নেইমার, কিলিয়ান এমবাপ্পেকে একসঙ্গে খেলিয়েও সেটা পাওয়া হয়নি। অবশেষে বড় তারকাবিহীন পিএসজি এ বছরই প্রথমবারের মতো উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছে। তাও ফাইনালে ইন্টার মিলানকে ৫-০ গোলে উড়িয়ে দিয়ে।
এসব অপেক্ষার অবসানের গল্পে এক টুকরো বাংলাদেশও আছে। ঠিক বাংলাদেশ নয়, মোহামেডান। দেশে পেশাদার লিগ চালু হওয়ার পর এ বছরই প্রথম বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ জিতেছে মোহামেডান। দীর্ঘদিনের অপেক্ষা ঘুচেছে তারা ২০২৫-এই।
ফুটবল ও ক্রিকেটের এত এত ট্রফি-খরা ঘোচানোর শুরুটা বলা যায় অস্ট্রেলিয়ায়। ১৪ বছরের বিগ ব্যাশ ক্রিকেট লিগ ইতিহাসে প্রথমবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে হোবার্ট হারিকেন্স। ২৭ জানুয়ারির সেই শিরোপা যেন ছিল অপেক্ষার প্রহর শেষে সূর্যোদয়ের প্রথম রশ্মি। এরপর একে একে জেগে উঠেছে প্রায় হারাতে বসা প্লাতেনসে, সেন্ট জিলোয়াস আর বছরের পর বছর উপহাসের শিকার হতে থাকা পিএসজি ও বেঙ্গালুরুর মতো দল।
দীর্ঘ প্রতীক্ষার শেষে ২০২৫ হয়ে উঠেছে সেই বছর, যে বছর বলেছে, অপেক্ষারও একদিন শেষ হয়।