আজ রাতে স্বাগতিক মরক্কো ও ক্যামেরুনের মধ্যকার ম্যাচ দিয়ে শুরু হতে যাচ্ছে আফিকা কাপ অব নেশনস। ফাইনাল ১৮ জানুয়ারি। প্রায় এক মাস ধরে আফ্রিকার শ্রেষ্ঠত্বের এই লড়াইয়ে দেখা যাবে তারার মেলা। মোহাম্মদ সালাহ–সাদিও মানে–আশরাফ হাকিমিদের মতো অভিজ্ঞদের পাশাপাশি আলো ছড়াতে প্রস্তুত থাকবেন কার্লোস বালেবা ও ইলিমান এনদিয়ায়ের মতো তরুণেরা। এবারের টুর্নামেন্টে এমন ১০ জন তারকাকে নিয়ে এই আয়োজন।
সর্বকালের সেরা আফ্রিকান ফুটবল তারকাদের একজন মোহাম্মদ সালাহ। এবারের আফ্রিকা কাপ অব নেশনসে মিসরকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেবেন তিনি। লক্ষ্য একটাই, রেকর্ড গড়ে মিসরকে আফ্রিকান শ্রেষ্ঠত্বের অষ্টম শিরোপা জেতানো। তবে ৩৩ বছর বয়সী সালাহর মাঠে সময়টা ভালো যাচ্ছে না। চলতি মৌসুমে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ২০ ম্যাচে করেছেন মাত্র ৫ গোল। লিভারপুল কোচ আর্নে স্লটের সঙ্গে তাঁর টানাপোড়েনও স্পষ্ট হয়েছিল। তবে এরপরও মিসরের ভালো বা খারাপ পারফরম্যান্সের অনেকটাই নির্ভর করছে সালাহর ওপর।
দুবার আফ্রিকার বর্ষসেরা ফুটবলার সালাহ এখনো মিসরের আক্রমণভাগে সবচেয়ে বড় ভরসা। বাছাইপর্বে তাঁর ৯ গোল ২০২৬ বিশ্বকাপে মিসরের জায়গা করে নেওয়ায় বড় ভূমিকা রেখেছে। এখন দুঃসময়কে জবাব দিতে সালাহর চোখ থাকবে নিজের ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো আফ্রিকার শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট জেতায়। এ পর্যন্ত মিসরের হয়ে দুবার রানার্সআপ হওয়াই এই টুর্নামেন্টে তাঁর সবচেয়ে বড় অর্জন।
এ বছর আফ্রিকার বর্ষসেরা ফুটবলারের ট্রফি জেতা আশরাফ হাকিমিই এবারের টুর্নামেন্টে মরক্কোর ‘পোস্টার বয়’। ২৭ বছর বয়সী হাকিমিকে বিশ্বের সেরা রাইটব্যাকদের একজন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পিএসজির ট্রেবলজয়ী মৌসুমে দারুণ অবদান রেখেছেন হাকিমি। এর আগে ২০২২ বিশ্বকাপে মরক্কোকে সেমিফাইনালে তোলার অন্যতম নায়কও ছিলেন। মরক্কোর অধিনায়ক হাকিমির কাঁধে এখন ফুটবলপাগল দেশের কোটি মানুষের প্রত্যাশা। তাঁকে ঘিরেই ৫০ বছর পর দ্বিতীয়বারের মতো আফ্রিকান শ্রেষ্ঠত্বের ট্রফি জয়ের স্বপ্ন দেখছে মরক্কো।
২০২৬ বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ হাতছাড়া হওয়ার হতাশা হয়তো এখনো তাড়া করে বেড়াচ্ছে ভিক্টর ওসিমেনকে। তবে সেই কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব করতে আফ্রিকা কাপ অব নেশনসকে নিশ্চয় পাখির চোখ করবেন ওসিমেন। গালাতাসারাইয়ের এই ফরোয়ার্ড চলতি মৌসুমে দুর্দান্ত ছন্দে আছেন। সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ১৬ ম্যাচে তাঁর গোল ১২টি, এর মধ্যে চ্যাম্পিয়নস লিগেই করেছেন ৬ গোল।
নাইজেরিয়ার সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতার তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে থাকলেও বড় টুর্নামেন্টে ধারাবাহিকতা দেখাতে পারেননি ওসিমেন। ২০২৩ সালে আফ্রিকা কাপ অব নেশনসে ‘সুপার ঈগলস’দের ফাইনালে ওঠার পথে করেছিলেন মাত্র ১ গোল। এবারের আসর তাঁর সামনে সেই গল্প বদলে দেওয়ার বড় সুযোগ।
আফ্রিকান কাপ অব নেশনস শুরুর আগে দারুণ ছন্দে আছেন ব্রায়ান এমবেউমো। বিশ্বকাপ বাছাইয়ে ব্যর্থতার পর নতুন কোচের অধীনে নতুন যাত্রা শুরু করা ক্যামেরুনের অভিযানে তিনি হয়ে উঠতে পারেন বড় ভরসা। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে চলতি মৌসুমে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ৭ গোল করেছেন এমবেউমো। দলটির সঙ্গে দারুণভাবে মানিয়েও নিয়েছেন।
চোটের কারণে আগের আফ্রিকা কাপ অব নেশনসে খেলতে পারেননি এমবেউমো। তবে এবার ২৬ বছর বয়সী এই ফরোয়ার্ডের সামনে ক্যামেরুনের হয়ে প্রথম শিরোপা জয়ের দারুণ সুযোগ রয়েছে। কাজটা সহজ নয়। অভিজ্ঞ স্ট্রাইকার ভিনসেন্ট আবুবাকারকে চমকপ্রদভাবে স্কোয়াডে না রাখায় এমবেউমোর কাঁধে পড়েছে বাড়তি দায়িত্ব। একদিকে যেমন আক্রমণে নেতৃত্ব দিতে হবে, তেমনি সামলাতে হবে অধিনায়কত্বের ভারও।
মেজর লিগ সকারে (এমএলএস) শার্লটের হয়ে ধারে খেলে দারুণ পারফরম্যান্সের পুরস্কার পেয়েছেন উইলফ্রেইড জাহা। প্রায় দুই বছর পর হঠাৎ করেই আবার জাতীয় দলে ডাক পেয়েছেন তিনি।
৩৩ বছর বয়সী এই উইঙ্গার এর আগে ২০২৩ সালের আফ্রিকা কাপ অব নেশনসজয়ী আইভরি কোস্ট দলে জায়গা পাননি। তবে চলতি মৌসুমে ১০ গোলের পাশাপাশি ১০টি গোলে সহায়তা করে ছন্দে ফেরায় তাঁকে উপেক্ষা করা আর সম্ভব হয়নি। অভিজ্ঞতা, প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারদের ফাঁকি দেওয়ার দক্ষতা এবং ছন্দ—সব মিলিয়ে জাহার প্রত্যাবর্তন বর্তমান চ্যাম্পিয়নস আইভরি কোস্টকে শিরোপা ধরে রাখার স্বপ্ন দেখাচ্ছে।
লিভারপুলের হয়ে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স তারকাখ্যাতি এনে দিয়েছিল সাদিও মানেকে। এরপর বায়ার্ন মিউনিখে গিয়ে থিতু হতে না পারলেও আল নাসরে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর সতীর্থ হিসেবে দারুণ নৈপুণ্য দেখাচ্ছেন মানে। দলের জয়ে অবদান রাখছেন নিয়মিতই। ৩৩ বছর বয়সী এই তারকার ওপর চোখ থাকবে আফ্রিকান কাপ অব নেশনসেও।
আফ্রিকার সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়দের একজন মানে এবারের আসরে সেনেগালের প্রাণভোমরা হয়ে মাঠে নামবেন। বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে তার করা ৫ গোল ছিল যেকোনো সেনেগালিজ খেলোয়াড়ের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে ২০২১ সালে দলকে শিরোপা জেতানোর পথে টুর্নামেন্ট সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছিল মানে।
প্রিমিয়ার লিগে ছয় গোলে সরাসরি অবদান রেখে চলতি মৌসুমে এভারটনের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য খেলোয়াড়দের একজন হয়ে উঠেছেন ইলিমান এনদিয়ায়ে। আফ্রিকান কাপ অব নেশনসে ২৫ বছর বয়সী এই ফুটবলারের কাছ থেকে এমন পারফরম্যান্সই দেখতে চাইবে সেনেগাল। সাদিও মানের সঙ্গে এনদিয়ায়ের বোঝাপড়ার ওপর নির্ভর করছে সেনেগালের সাফল্যের অনেকটাই।
ড্রিবলিং ও ফিনিশিংয়ে পারদর্শী এই মিডফিল্ডারের অল্প সময়ের মধ্যে নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ দিয়েছেন। ২০২৩ সালে ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় স্তরের লিগে খেললেও এখন তিনি এভারটনের গুরুত্বপূর্ণ মুখ। চলতি মৌসুমেও এভারটনের পারফরম্যান্সে দারুণ ভূমিকা তাঁর। গত তিন বছর ধরেই সেনেগাল দলে নিয়মিত খেলছেন এনদিয়ায়ে। এখন বড় আসরে জ্বলে উঠার অপেক্ষা।
টুর্নামেন্টের অনেক বড় তারকার মতো বড় মঞ্চের অভিজ্ঞতা না থাকলেও কার্লোস বালেবা এবারের আফ্রিকা কাপে সবচেয়ে উল্লেখ্যযোগ্য মুখগুলোর একটি। মাত্র ২১ বছর বয়সেই নজর কাড়তে শুরু করেছেন।
দারুণ প্রতিভাবান এই তরুণ এখন প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব ব্রাইটনে খেলেন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে। আফ্রিকান কাপ অব নেশনসের বাছাইপর্বেও ক্যামেরুনের জার্সিতে দারুণ অবদান রেখেছেন। স্ট্যামিনা, ড্রিবলিং ও লম্বা পাস দেওয়ার দক্ষতার জন্য পরিচিত বালেবাকে ঘিরে এখন ইউরোপের বড় বড় ক্লাবের আগ্রহ বাড়ছে। আফ্রিকান শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে ভালো কিছু করলে তাঁকে আগ্রহ পারদ আরও ওপরে উঠবে।
বরুসিয়া ডর্টমুন্ড ও আর্সেনালের হয়ে একসময় আলো ছড়িয়েছিলেন পিয়েরে-এমেরিক অবামেয়াং। এখন খেলছেন ফরাসি ক্লাব মার্সেইয়ে। এবারের আফ্রিকা কাপ অব নেশনসই গ্যাবনের হয়ে তাঁর বড় কিছু করার শেষ সুযোগ। ৩৬ বছর বয়সী এই ফুটবলারের কাঁধে এখন মধ্য আফ্রিকার ছোট দেশটির স্বপ্ন। এর আগে দলটি কখনোই কোয়ার্টার ফাইনালের গণ্ডি পেরোতে পারেনি। এবার অবা কি পারবেন নতুন করে ইতিহাস লিখতে?
আফ্রিকান নেশনস কাপে আলজেরিয়ার ভরসার নাম মোহাম্মদ আমৌরা। ২০২৬ বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে আফ্রিকার সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন তিনি। সব মিলিয়ে ১০ গোল করে পেছনে ফেলেন মিসরের মহাতারকা সালাহকে। ২৫ বছর বয়সী এ স্ট্রাইকার সেই ধারালো ছন্দ ধরে রেখেছেন ক্লাব ফুটবলেও। বুন্দেসলিগার ক্লাব ভলফসবুর্গের হয়ে ১৫ ম্যাচে করেছেন ৬ গোল, দুটি গোল বানিয়েছেন।
২০১৯ সালে আফ্রিকান কাপ অব নেশনস জিতলেও, পরের দুই আসরে আলজেরিয়াকে বিদায় নিতে হয় প্রথম রাউন্ড থেকে। তাই এবারের টুর্নামেন্ট তাদের জন্য সাম্প্রতিক হতাশার গল্প বদলে দেওয়ার সুযোগ। তৃতীয় শিরোপার লক্ষ্যে আলজেরিয়া কতদূর যাবে, তা অনেকটাই নির্ভর করবে আমৌরার পারফরম্যান্সের ওপর।