ফুটবলকে বিদায় বলে দিলেন গ্যারেথ বেল

ফুটবল ছাড়লেন গ্যারেথ বেলছবি: এএফপি

শুধু জাতীয় দল ছাড়তে পারতেন। তাই বলে ফুটবল থেকেই অবসর নিতে হবে! ৩৩ বছর বয়স তো এমন আহামরি কিছু না। এই বয়সে অনেকেই জাতীয় দল ছেড়ে ক্লাব ফুটবলে খেলা চালিয়ে যান। কিন্তু গ্যারেথ বেল সে ধাতে গড়া মানুষ নন।

আজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্লাব ও আন্তর্জাতিক ফুটবল ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছেন ব্রিটিশ ফুটবলের ইতিহাসে অন্যতম সফল এই উইঙ্গার।

টুইটারে নিজের ভেরিফাইড অ্যাকাউন্টে অবসর ঘোষণায় বেল লিখেছেন, ‘অনেক ভেবেচিন্তে আমি ক্লাব ও আন্তর্জাতিক ফুটবল ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যে খেলাটাকে আমি ভালোবাসি সেটা খেলতে পেরে নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হয়। এটা সত্যি সত্যিই জীবনের সেরা কিছু মুহূর্ত উপহার দিয়েছে আমাকে। সামনে যাই থাক না কেন, সেই ১৭টি মৌসুমকে ফিরিয়ে আনা অসম্ভব।’

বেলের হাত ধরে ১৯৫৮ সালের পর ওয়েলশ এবারই প্রথম বিশ্বকাপে খেলেছে। খেলেছে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপেও (ইউরো)। ২০১৩ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত রিয়াল মাদ্রিদে পাঁচবার চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছেন বেল। ২০০৬ সালে ওয়েলশ জাতীয় দলে অভিষেক তাঁর। এই ১৬ বছরে ওয়েলশের হয়ে সর্বোচ্চ ম্যাচ (১১১) ও সর্বোচ্চ গোলের (৪১) রেকর্ড গড়েছেন।

ইউরোপের ফুটবলে বেলের হাত ধরেই মূলত ওয়েলশের পুনর্জন্ম ঘটেছে। তার সময়ে দুবার ইউরোয় খেলেছে ওয়েলশ, এর মধ্যে ২০১৬ সংস্করণের সেমিফাইনালেও উঠেছিল।

সাউদাম্পটনের বয়সভিত্তিক প্রকল্প থেকে উঠে আসা বেল ২০০৬ সালে ক্লাবটির মূল দলে অভিষিক্ত হন। পরের বছর টটেনহাম হটস্পারে যোগ দেওয়ার পর উইং চিরে বেলের দৌড় দেখেছে বিশ্ব। এরপর তো রিয়ালে যোগ দিলেন এবং তারপর ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ও করিম বেনজেমার সঙ্গে গড়লেন ‘বিবিসি’ জুটি।

রিয়ালে সেই দিনগুলোই বিশ্ব ফুটবলে বেলকে স্থায়ী ভিত পাইয়ে দিয়েছিল। সাধারণ লেফটব্যাক থেকে উইঙ্গার হয়ে বেল যেভাবে ফরোয়ার্ড হিসেবেও ত্রাস ছড়িয়েছেন প্রতিপক্ষের রক্ষণে—রিয়ালে সেই দিনগুলোই ছিল বেলের এই পরিবর্তনের শীর্ষবিন্দু। বেল সেই ‘বিন্দু’ ছুঁয়েছিলেন রেকর্ড গড়ে।

রিয়ালের হয়ে একাধিকবার চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছেন বেল
ছবি: এএফপি

২০১৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর রিয়াল মাদ্রিদ ঘোষণাটা দিয়েছিল। বেলের সঙ্গে ছয় বছরের চুক্তি করেছে ক্লাবটি, দলবদলের বিশ্বরেকর্ড গড়ে! ১০ কোটি ইউরো তখন দলবদলে সর্বোচ্চ দামের রেকর্ড। রিয়াল সভাপতি ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ তখন বলেছিলেন, ‘নেইমারকে পেলে বেলকে কিনতাম না।’ নেইমার সে বছরের মে মাসে যোগ দেন বার্সেলোনায়। তাঁকে না পেয়ে বেলকে কিনে ‘দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে’ চেয়েছিল রিয়াল। কিন্তু পেরেজ কী তখন জানতেন, ঘোল নয় কিছুদিনের মধ্যেই অমৃতের স্বাদ পাবেন!

রিয়ালে নিজের প্রথম মৌসুমে বেলের শুরুটা ভালো ছিল না। ভিয়ারিয়ালের বিপক্ষে অভিষেকে গোল পেলেও ফিটনেসের সমস্যা ছিল। স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যম ‘মার্কা’ লিখেছিল, ‘বেল ফুটবল খেলতে জানেন না।’ কিন্তু ওই মৌসুম শেষে দেখা গেল বেলই রিয়ালের ‘নায়ক’—সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ৪৪ ম্যাচে ২২ গোল করেছিলেন। কিন্তু বেলের মাহাত্ম্য এসব সংখ্যায় বোঝা যায় না।

সে মৌসুমে সেভিয়ার বিপক্ষে রিয়ালের ৭-৩ গোলের জয়ে বেলের জোড়া গোল দেখে স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যম তাঁকে আখ্যা দিয়েছিল ‘ক্যানন।’ কিংবা চ্যাম্পিয়নস লিগে গ্যালাতসারের বিপক্ষে ২৫ গজি ফ্রি-কিক থেকে করা গোল, কিংবা রিয়াল ভায়োদোলিদের বিপক্ষে সেই ‘পারফেক্ট হ্যাটট্রিক’ ; দুই পা ও হেডেও গোল!

এসবও ভুলে গেলে, বেলের সে মৌসুমে কোপা ডেল রে ফাইনালে বার্সেলোনার বিপক্ষে করা গোলটি নিশ্চয়ই মনে আছে? নিজেদের অর্ধে বল পেয়ে বাঁ প্রান্ত দিয়ে দৌড় শুরু করলেন। বার্সা ডিফেন্ডার মার্ক বাত্রা তাঁকে ঠেকাতে এলেও বেলের আগুনে দৌড়ের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারেননি। বাত্রাকে ‘অতীত’ বানিয়ে (পেছনে ফেলে) বেলের করা সেই গোলটি তাঁর ক্যারিয়ারেরই অন্যতম সেরা ধরা হয়।

আসলে ‘বিবিসি’ আক্রমণভাগের হয়ে বেলের কাটানো সময়টা তাঁর ক্যারিয়ারেরই সেরা। রোনালদো ২০১৮ সালে রিয়াল ছাড়ার পর ভেঙে যায় সেই ‘ত্রিফলা’ জুটি। পাঁচ বছর একসঙ্গে খেলে এই ত্রয়ী তারকা জিতেছেন চারটি চ্যাম্পিয়নস লিগ, একটি লা লিগা। বার্সেলোনায় তখন ছিল মেসি-সুয়ারেজ-নেইমারকে নিয়ে গড়া ‘এমএসএন’ জুটি। ‘এল ক্ল্যাসিকোয়’য় তখন রিয়াল-বার্সার মুখোমুখি হওয়া মানে এ দুটি ‘ত্রিফলা’ জুটিরও মুখোমুখি হওয়া। স্প্যানিশ ফুটবলে সে এক অন্যরকম দিন ছিল! বেল রিয়ালের সেসব দিনেরই প্রতিনিধি, যখন ‘বিবিসি’ আক্রমণভাগ থেকে ৬৫৮ ম্যাচে ৪৪২ গোলের দেখা পেয়েছে রিয়াল, যখন রোনালদোকে সামনে রেখে বেল ও বেনজেমার পেছনে দাঁড়ানোর ছক দেখলে প্রতিপক্ষ গোলকিপারের ঘুম হারাম হতো।

রিয়ালে বেলের শেষ দিনগুলো ভালো কাটেনি। ব্রাত্য ছিলেন অনেক দিন। টটেনহামে ধারে ফিরেছিলেন। গত বছর জুনে লস অ্যাঞ্জেলস এফসিতে যোগ দেন। মেজর লিগ সকারের এই ক্লাবের হয়ে বিশ্বকাপের পর আর মাঠে নামেননি বেল। গত ২৯ নভেম্বর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বিশ্বকাপ গ্রুপপর্বে সেই ম্যাচটাই হয়ে রইল বেলের ক্যারিয়ারে শেষ প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ম্যাচ। ক্লাব ক্যারিয়ারে ৫৫৪ ম্যাচে ১৮৬ গোল দিয়ে বেলকে বোঝা অসম্ভব। রিয়ালের হয়ে তাঁর ১০৬ গোলও স্রেফ সংখ্যা। বেলকে সবাই মনে রাখবেন তাঁর উইং চিরে আগুনে দৌড়ের জন্য, বাইসাইকেল কিকে সেই গোলের জন্য...।

বিদায়বেলায় বেলেরও আক্ষেপ নেই, ‘সাউদাম্পটনে বলে প্রথম টাচের পর থেকে লস অ্যাঞ্জেলস পর্যন্ত এমন এক ক্যারিয়ার গড়তে পেরেছি, যা নিয়ে আমি ভীষণ গর্বিত।’