যে রাতে ব্যাংকস ভর করেছিল গুনকে
ফুটবলের দর্শক হলে গর্ডন ব্যাংকসকে নিশ্চয়ই চেনেন? কিংবা নাম তো শুনেছেন। সেটাও যদি না হয় একবার সময় করে ইউটিউব ঘুরে আসতে পারেন। সেখানে নামটি সার্চ দিলে সবার আগে চলে আসবে ‘দ্য গ্রেটেস্ট সেভ এভার’। পরেরটি হয়তো ‘গর্ডন ব্যাংকস—ব্যাংকস অব ইংল্যান্ড।’ তারপর এমন আরও কিছু ভিডিও পাবেন। বেশির ভাগই একটি ম্যাচে বিশেষ একটি মুহূর্তের ফুটেজ। সেটিকে বলতে পারেন ‘ব্যাংকস মোমেন্ট’।
১৯৭০ বিশ্বকাপ গ্রুপ পর্বে ব্রাজিল-ইংল্যান্ড ম্যাচ। খেলা শুরুর ১০ মিনিট পর ডান প্রান্ত থেকে মাপা ক্রস করেন ব্রাজিল স্ট্রাইকার জেয়ারজিনহো। পোস্টের সামনে ভিড় করা ইংলিশ রক্ষণের ভেতর থেকে লাফ দিয়ে জোরালো হেড করেন পেলে। বলটি এবড়োখেবড়ো মাটিতে ড্রপ খায় গোললাইন থেকে প্রায় দুই গজ আগে।
ব্যাংকস ক্রসটি আসার সময় যে পজিশনে ছিলেন, পেলের হেডের সময় বিপদ টের পেয়ে সেখান থেকে সরে যান। কিন্তু ব্যাংকসের ডান দিকের পোস্ট ঘেঁষে পেলে হেডটি করায় ওই মুহূর্তে ডাইভ দিতেই হতো ইংল্যান্ড গোলকিপারকে। সেটি তিনি দিয়েছিলেনও, তবে বিশেষত্ব হলো সেই মুহূর্তে তিনি যে পজিশনে ছিলেন, সেখান থেকে নিজের শরীরের পেছন দিকে ডাইভ দেওয়া প্রায় অসম্ভব। অকল্পনীয় ক্ষিপ্রতায় ব্যাংকস ঠিক এই অসম্ভবকে সম্ভব করেই নিশ্চিত গোল রুখে দিয়েছিলেন। হেডের পরই উদ্যাপনে মেতে ওঠা পেলে পর্যন্ত ব্যাংকসের সেই সেভ দেখে হতভম্ব। গোটা বিশ্বও থমকে গিয়েছিল একমুহূর্তের জন্য। এটাও সম্ভব!
ফুটবলে অসাধারণ সেভ আছে অসংখ্য। নির্দিষ্ট কোনো সেভকে এককভাবে সেরা বলা যায় না। তবে ব্যাংকসের সেই সেভকে অনেকেই মনে করেন, তর্কযোগ্যভাবে সর্বকালের সেরা। ‘সেভ অব দ্য সেঞ্চুরি’ নামটা তো আর এমনিতেই বলা হয় না। কিন্তু এই লেখার মূল চরিত্র ২০১৯ সালে প্রয়াত হওয়া এবং ১৯৬৬ সাল থেকে টানা ছয়বার ফিফার বর্ষসেরা গোলকিপার হওয়া ব্যাংকস নন। ইউরোয় গতকাল রাতের পর থেকেই প্রসঙ্গক্রমে তিনি উঠে আসছেন। বিবিসি তো বলেই দিয়েছে ‘ব্যাংকস রেপ্লিকা’। পাশাপাশি এই প্রশ্নও উঠছে, ইউরোর ইতিহাসেই ওটা সেরা সেভ কি না?
কোনটা? গতকাল রাতে ইউরো শেষ ষোলোয় অস্ট্রিয়া-তুরস্ক ম্যাচটি দেখে থাকলে প্রশ্নটি অবান্তর। তবু লাইপজিগের বৃষ্টিস্নাত মুহূর্তটি একবার মনে করিয়ে দেওয়া যায়। যোগ করা সময় মিলিয়ে ম্যাচের তখন ৯৫তম মিনিটের খেলা চলছিল। তুরস্ক ম্যাচে ২-১ গোলে এগিয়ে। বাঁ প্রান্ত থেকে বাতাসে ভেসে আসা বল তুর্কি বক্সের ভেতর থেকে দূরের পোস্টের দিকে হেড করেন অস্ট্রিয়ান মিডফিল্ডার ক্রিস্তফ বাউমগার্টনার। পেলের সেই হেডের মতো বাউমগার্টনারের হেডও গোললাইন থেকে প্রায় দুই গজ সামনে বাউন্স খেয়ে উঠেছিল। ওই অবস্থায় খুব কাছাকাছি দাঁড়ানো তুর্কি গোলকিপার মের্ত গুনক কীভাবে বলটি ঠেকালেন, সেটি কোটি টাকার প্রশ্ন।
চাইলে ইউটিউব কিংবা এক্স-এ একবার সেই মুহূর্তের ভিডিও রিপ্লে দেখতে পারেন। বাউমগার্টনার হেড করতে যখন লাফ দিয়েছিলেন, গুনক তখন বাঁ পোস্টের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে। স্বাভাবিকভাবেই দূরের পোস্টকে লক্ষ্য বানান অস্ট্রিয়ান মিডফিল্ডার। হেডের পর গুনক সেকেন্ডেরও কম সময়ের মধ্যে বিপদটা টের পেয়েছিলেন, হ্যাঁ ব্যাংকসের মতোই। দূরের পোস্ট এবং নিজের মাঝে ব্যবধান কমাতে ডাইভের বিকল্প ছিল না তাঁর কাছে। কিন্তু শুধু ডাইভ দিলেই হতো না, বলটি যেহেতু সামনে ড্রপ খেয়েছে তাই ডাইভের টাইমিংও নিখুঁত হতে হতো।
ভিডিও রিপ্লে দেখলে বোঝা যায়, বলটি ড্রপ খেয়ে বেশ উঠেছিল, ব্যাংকসের ক্ষেত্রে যেটা বেশ কম ছিল। ব্যাংকস চকিতে ডাইভে মাটির ওপরে পড়ার মুহূর্তে বলটা ঠেকিয়েছিলেন। গুনকও অবিশ্বাস্য রিফ্লেক্স দেখিয়ে ডাইভ দিলেও বলটা যেহেতু ড্রপ খেয়ে বেশ উঠেছিল তাই বেশ খানিকটা শূন্যে থাকতেই তাঁকে বলটি ঠেকাতে হয়েছে। অবিশ্বাস্য!
তুরস্কের ডাগআউট তখনই যেন বুঝে গিয়েছিল, এই ম্যাচ থেকে কোয়ার্টার ফাইনালে টিকিট এনে দিলেন কে! শেষ বাঁশি বাজার সঙ্গে সঙ্গে তুর্কি ডাগআউট থেকে সবাই দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরেন গুনককে। বেসিকতাসের ৩৫ বছর বয়সী এই গোলকিপার এখন তুরস্কের জাতীয় বীর। স্বাভাবিকভাবেই ভেসে যাচ্ছেন প্রশংসায়। ম্যাচ শেষে অস্ট্রিয়ার কোচ রালফ রাংনিক যেমন বলেছেন, ‘সমতাসূচক গোলের সময়টা আমরা পেয়েছিলাম। কিন্তু গোলে গর্ডন ব্যাংকস থাকলে কাজটা কঠিন।’
শুধু রাংনিক নন, গুনকের এই সেভের সঙ্গে ৫৪ বছর আগে ব্যাংকসের সেই সেভের তুলনা টেনেছেন অনেকেই। বিবিসি রেডিও লাইভ ফাইভে ইংল্যান্ডের সাবেক ডিফেন্ডার ম্যাথু আপসন বলেন, ‘এটা তো গর্ডন ব্যাংকস! অবিশ্বাস্য। কী একটা মুহূর্ত! কিপার পোস্টের সামনে স্রেফ ঘুরে গেল! অসাধারণ।’ আপসন এখানেই থামেননি। পেলের মতো বাউমগার্টনারও ভেবেছিলেন ওটা গোল—তা বুঝিয়ে আপসন বলেছেন, ‘বাউমগার্টনার ভেবেছে বলটা জালে। সে কোনো ভুল করেনি...এটা আসলে গর্ডন ব্যাংকস। একই রকম।’
আইটিভিতে ইংল্যান্ডের সাবেক ডিফেন্ডার ও ফুটবল-পণ্ডিত লি ডিক্সন বলেছেন, ‘ফার্স্ট ক্লাস! মনে হচ্ছে গর্ডন ব্যাংকসের রেপ্লিকা।’ ডিক্সনের এই কথাকেই নিজেদের প্রতিবেদনে শিরোনাম করেছে বিবিসি। একই প্রতিবেদনে ইংল্যান্ডের সাবেক স্ট্রাইকার ক্রিস সাটনের মন্তব্য, ‘গুনকের এই সেভ ইউরোর ইতিহাসেই অন্যতম সেরা।’
তুরস্ক দলে গুনক সবচেয়ে বেশি বয়সী খেলোয়াড়। কিন্তু বয়সের ভারে ন্যূজ না হয়ে তাঁর অমন অবিশ্বাস্য রিফ্লেক্সে করা সেভে যে কারোরই মজার কথা। গুনকের সতীর্থ এবং অস্ট্রিয়ার বিপক্ষে জোড়া গোল করা—একটি ইউরো নকআউটের ইতিহাসে দ্রুততম গোল—ডিফেন্ডার মেরি ডেমিরাল বলেছেন, ‘নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারিনি—সম্ভবত আমার দেখা অন্যতম সেরা সেভগুলোর একটি। তার এটা প্রাপ্য।’
সংবাদমাধ্যম ‘দ্য অ্যাথলেটিক’-এর গোলকিপিং বিশ্লেষক ম্যাট পিজদ্রোফস্কি গুনকের সেভটি বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর মতে, এটি এবারের ‘ইউরোয় সেরা সেভ’। ‘দ্য অ্যাথলেটিক’-এ প্রকাশিত বিশ্লেষণে সাবেক এই গোলকিপার ও কোচের মন্তব্য, ‘এটা আমার দেখা অন্যতম সেরা সেভ বললে এতটুকু বাড়িয়ে বলা হবে না...সে যেভাবে বলটির দিকে ফিরেছে এবং ভেজা মাঠে বাউন্স করা বল সেভ করেছে, বিশেষ এক মুহূর্ত। সেনসেশনাল।’
এই সেভের পেছনে সম্ভাব্য কারণও ব্যাখ্যা করেছেন পিজদ্রোফস্কি, ‘গুনকের এই সেভে সহজাত সচেতনতার একটা ব্যাপার ছিল, যা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধারাবাহিক প্রস্তুতির মাধ্যমে তৈরি হয়। মুভমেন্টের মাধ্যমে বলের ওপর সে শরীরটাকে যেভাবে ফেলেছে, সেটা বিরামহীন অনুশীলনে তৈরি: ফলটা হলো একদম সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় সে বারবার নিজের শরীরটা ফেলতে পারবে। তাই ওই সেভটি হুট করেই হয়ে যায়নি।’
ম্যাচ শেষে অস্ট্রিয়া কোচ রাংনিকের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, গুনকের সেভটি দেখে তাঁর ১৯৭০ বিশ্বকাপে ব্যাংকসের সেই সেভ মনে পড়েছে কি না?
রাংনিক উত্তর দিয়েছেন এককথায়, ‘সত্য।’