নেইমার, আলিসন, এদেরসনদের ছাড়াই ব্রাজিল দলে শুরু হচ্ছে দরিভাল–যুগ

নতুন শুরু করতে পারবেন ভিনিসিয়ুসরাসিবিএফ

‘প্রতিটি দেশের অপূরণীয় জাতীয় বিপর্যয় আছে। এমন কিছু, যাকে আপনি তুলনা করতে পারেন হিরোশিমার সঙ্গে। আমাদের সেই বিপর্যয়, আমাদের সেই হিরোশিমা হচ্ছে ১৯৫০ বিশ্বকাপের ফাইনালে উরুগুয়ের বিপক্ষে হার।’ মারাকানা ট্র্যাজেডি ব্রাজিলিয়ানদের জীবনকে কতটা প্রভাবিত করেছিল, বিখ্যাত ব্রাজিলিয়ান সাহিত্যিক নেলসন রদ্রিগেজের এ কথাগুলোতেই সেটা স্পষ্ট।

একটা খেলাকে ঘিরে আবেগের মাত্রা কতটা লাগামছাড়া হলে ব্যর্থতাকে তুলনা করা হয় জাতীয় বিপর্যয়ের সঙ্গে। যেনতেন বিপর্যয় আবার নয়, রীতিমতো হিরোশিমার মতো ভয়ংকর কিছু। তবে দেশটা ব্রাজিল বলেই এ কথাগুলো অতিশয়োক্তি মনে হয় না। ফুটবল–সম্রাট বলে খ্যাত পেলে যেমনটা বলেছিলেন, ‘ব্রাজিলিয়ানরা ফুটবল খায়, ঘুমায় এবং পান করে।’

আরও পড়ুন

কিন্তু ফুটবল যাদের কাছে আবেগের অপর নাম, সেই দেশটিই এখন যেন ঐতিহ্যের কঙ্কাল। খুব বেশি গভীরে না গিয়েও বলা যায়, ব্রাজিলের ফুটবল সম্ভবত নিজেদের ইতিহাসের অন্যতম বাজে সময় পার করছে।

তবে মাঠের ব্যর্থতার চেয়েও ব্রাজিলের ফুটবলকে এ মুহূর্তে অশনী বার্তা দিচ্ছে বাইরের বিশৃঙ্খলা। ‘জোগো বনিতো’ বা সুন্দর ফুটবলের দেশটির ফুটবল–দুনিয়া এখন ভরে গেছে নানা অসুন্দরে। অনেক নাটকীয়তার পর এই ‘অসুন্দর’ সময়টাকে বদলানোর দায়িত্ব পড়েছে ব্রাজিলিয়ান কোচ দরিভাল জুনিয়রের ওপর। যিনি আজ রাতে ইংল্যান্ডের সঙ্গে প্রীতি ম্যাচ দিয়ে শুরু করবেন ব্রাজিলের ফুটবলের নতুন অধ্যায়।

ব্রাজিল কোচ দরিভাল
সিবিএফ

ব্রাজিলের ফুটবলে বিশৃঙ্খলার শুরুটা কাতার বিশ্বকাপের পর থেকে। বিশ্বকাপের অন্যতম ফেবারিট ব্রাজিল কোয়ার্টার ফাইনালে ক্রোয়েশিয়ার কাছে টাইব্রেকারে হেরে বিদায় নেয়। ব্যর্থতার দায় নিয়ে সরে দাঁড়ান কোচ তিতে। তারপর কোচ নিয়োগ নিয়ে মঞ্চস্থ হয় এক মহানাটক।

বিশ্বকাপের পরপর ব্রাজিলিয়ান ফুটবল কনফেডারেশনের (সিবিএফ) বিদেশি কোচ নিয়োগের ইচ্ছার কথা জানালে শুরু হয় তোলপাড়। ব্রাজিলের কিংবদন্তি ফুটবলাররাও দুই ভাগে ভাগ হয়ে যান। রোনালদো নাজারিওসহ কেউ কেউ বিদেশি কোচের পক্ষে মত দিলেও রিভালদোর মতো অনেকে ব্রাজিল দলে বিদেশি কোচকে ‘অপমান’ হিসেবে দেখার কথা বলেন।

আরও পড়ুন

বাদানুবাদের একপর্যায়ে রিয়াল মাদ্রিদের ইতালিয়ান কোচ কার্লো আনচেলত্তিকে নিয়োগের বিষয়টি নিশ্চিত করে সিবিএফ। রিয়ালের হয়ে চলতি মৌসুম শেষ করে কোপা আমেরিকার আগে আনচেলত্তির ব্রাজিলের কোচ হওয়ার কথাও জানিয়েছিল তারা। মাঝের সময়টাতে দল সামলানোর দায়িত্ব দেওয়া হয় ফার্নান্দো দিনিজকে। এর মধ্যে ডিসেম্বরের শুরুতে আদালতের নির্দেশে সিবিএফ সভাপতির পদ থেকে এদনালদো রদ্রিগেজ সরে দাঁড়ালে আনচেলত্তির ব্রাজিলের কোচ হওয়া নিয়ে শুরু হয় অনিশ্চয়তা।

আনচেলত্তির কোচ হওয়ার বিষয়টির দেখভাল করছিলেন রদ্রিগেজই। তাঁকে সরানোর পর আনচেলত্তি ব্রাজিলে যাওয়ার বদলে রিয়ালের সঙ্গে চুক্তি নবায়নের সিদ্ধান্ত নেন। নাটক নতুন মোড় নেয় সুপ্রিম কোর্ট রদ্রিগেজকে আবার সভাপতির পদ ফিরিয়ে দিলে। দায়িত্ব ফিরে পেয়ে বিদেশি কোচের ভাবনা বাদ দিয়ে সাও পাওলোর কোচ দরিভালকেই নিয়োগ দেন রদ্রিগেজ। যিনি আজ আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রাজিল দলের হয়ে নতুন যাত্রা শুরু করবেন।

চোট নিয়ে মাঠের বাইরে নেইমার
ইনস্টাগ্রাম

এবার আসা যাক মাঠের পারফরম্যান্সে। দরিভালের ব্রাজিল আজ ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মাঠে নামার আগে গত দুই বছরের পারফরম্যান্সের দিকে ফিরে তাকালে, হতাশা ছাড়া কিছুই মিলবে না। একের পর এক ব্যর্থতা ব্রাজিলকে নিয়ে গেছে তলানিতে। বিশ্বকাপ বাছাইয়ের কথাই ধরা যাক।

৬ ম্যাচে ২ জয়ের বিপরীতে ৩ হার এবং এক ড্রয়ে ৭ পয়েন্ট নিয়ে ব্রাজিলের অবস্থান এখন ৬ নম্বরে। শীর্ষে থাকা আর্জেন্টিনার সঙ্গে পয়েন্টের পার্থক্য ৮। এমনকি মারাকানায় মারামারি ও সংঘাতের ম্যাচে আর্জেন্টিনার কাছে ১–০ গোল হারে ব্রাজিল। বিশ্বকাপ বাছাইয়ের ইতিহাসে সেটিই ছিল নিজেদের মাঠে ব্রাজিলের প্রথম হার। প্রশ্ন হচ্ছে, দরিভাল কি এমন হতশ্রী ব্রাজিলকে বদলাতে পারবেন?

আরও পড়ুন

এখনই অবশ্য আশাবাদী হওয়ার মতো রসদ নেই। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মাঠে নামার আগে চোটজর্জর এক দলকে পাচ্ছেন দরিভাল। দলের অন্যতম সেরা তারকা নেইমার গত অক্টোবর থেকে মাঠের বাইরে। কোপা আমেরিকায়ও তাঁর না থাকা নিশ্চিত। দলে নেই প্রধান দুই গোলরক্ষক আলিসন ও এদেরসনও। এ ছাড়া কাসেমিরো, এদের মিলিতাওসহ বেশ কজন তারকা খেলোয়াড়কে পাচ্ছেন না দরিভাল। এমনিতে বাজে পারফরম্যান্সের কারণে তলানিতে নেমেছে আত্মবিশ্বাস, তার ওপর সেরা খেলোয়াড়দের না পাওয়া আরও চাপ বাড়াবে দলটির ওপর। সেই চ্যালেঞ্জ দরিভাল কীভাবে মোকাবিলা করবেন, সেটিই দেখার অপেক্ষা।

আরও পড়ুন

জয়–পরাজয়ের চেয়ে এই মুহূর্তে দরিভালের মূল কাজ দলে শৃঙ্খলা ফেরানো। পাশাপাশি হারানো আত্মবিশ্বাস এবং জয়–ক্ষুধাটাও ফিরিয়ে আনাও দরিভালের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। তবে গুরুত্বপূর্ণ এই কাজগুলো করার জন্য দরিভালের হাতে সময় খুব অল্প। আগামী জুনেই কোপা আমেরিকার কঠিন পরীক্ষা অপেক্ষা করছে দরিভালের সামনে। অবশ্য পিঠ যখন দেয়ালে ঠেকে যায়, পাল্টা আক্রমণই তো শেষ কথা। এমনিতে ফুটবল তো ব্রাজিলিয়ানদের শিরা–উপশিরায়। দরিভালকে শুধু সেই শিরা–উপশিরাগুলোকে ফুটবল স্রোত বয়ে যাওয়ার জন্য সুগম রাখতে হবে, যেখান থেকে শুরু হবে ব্রাজিলের ফুটবলের নতুন দিন ধারা!