ক্লাবকে ভালোবাসার যে দৃষ্টান্ত হার মানাচ্ছে রূপকথাকেও

দেপোর্তিভো লা করুনিয়া ফরোয়ার্ড লুকাস পেরেজইনস্টাগ্রাম

রিয়াজোরে ম্যাচের তখন ৫৭ মিনিট। বক্সের বাইরে ফ্রি–কিক পেয়েছে দেপোর্তিভো লা করুনিয়া। উন্মত্ত ‘হারকুলেয়ানস’ সমর্থকেরা। গ্যালারি এমনিতেই নীল–সাদার সুমদ্র! স্টেডিয়ামের বাইরে সেটাই যেন মহাসাগর! প্রায় ৮০ হাজারের মতো জনতার ভিড়। জায়ান্ট স্ক্রিনে তাঁরাও দেখলেন সেই মুহূর্তটি। ফ্রি–কিক থেকে বাঁ পায়ের শটে গোল করলেন লুকাস পেরেজ। শেষ বাঁশি বাজার পর বোঝা গেল, ওটা আসলে শুধুই গোল ছিল না; স্প্যানিশ ফুটবলে এক ধাপ ওপরে ওঠার টিকিটও।

আরও পড়ুন

স্প্যানিশ ফুটবলে রোববার তৃতীয় বিভাগের বার্সা অ্যাথলেটিকের বিপক্ষে এই ম্যাচে ১–০ গোলে জিতে দ্বিতীয় বিভাগে ওঠার টিকিট পেয়েছে দেপোর্তিভো। ক্লাবটির সমর্থকদের কাছে সেদিন এর চেয়ে বড় উৎসবের উপলক্ষ ছিল না। কিন্তু সেই গোলদাতাও ছিলেন আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। গোলের পরের মুহূর্তে ফেরা যাক। উদ্‌যাপন করতে করতে মাঠের ডান প্রান্তে গিয়ে দাঁড়ান পেরেজ। করতালি ও স্লোগানে তখন কান ফাটার জোগাড়—পেরেজ চৌকস বুল ফাইটারের মতোই হাতটা ঘুরিয়ে দাঁড়ালেন, যেন অবাধ্য ‘ষাঁড়’কে এই মাত্র বশ মানালেন! করুনিয়ার জনতা জানত, এই মুহূর্ত কারও প্রাপ্য হয়ে থাকলে সেটা পেরেজেরই। ক্লাবের প্রতি এমন ভালোবাসার যে তুলনা হয় না!

ভালোবাসার সেই গল্পটা গোড়া থেকে বলা যাক।

ধরুন, আপনি ফুটবলার। ক্যারিয়ারটাও মন্দ নয়। ফুটবলার হতে খুব অল্প বয়সে ঘর ছেড়েছেন। বাবা জেলে, শৈশবে খুব বেশি বাবার সান্নিধ্য পাননি। বড় হয়েছেন দাদা–দাদির স্নেহে। এলাকার ফুটবল ক্লাবকে আপনি খুব ভালোবাসেন। কিন্তু এটাও জানেন, জায়গাটা এখানে নয়। ফুটবলে ভালো ক্যারিয়ার গড়তে যেতে হবে অন্য কোথাও।

পেরেজের শুরুটাও এমন। বয়সভিত্তিক এক ক্লাবে শহরে কিছুদিন কাটানোর পর চলে গেলেন বাস্ক প্রদেশে। সেখান থেকে আতলেতিকো মাদ্রিদের যুব দল হয়ে রায়ো ভায়োকানোর মূল দলেও জায়গা হলো। কিন্তু পেরেজের মন বলছিল, হেথায় না অন্য কোথাও! তাই চলে গেলেন ইউক্রেনে, সেখানকার ক্লাব কারপাতি আবিবে খেললেন কিছুদিন। কিন্তু সেখানেও থিতু হওয়া গেল না। ইউক্রেন থেকে গ্রিস এবং তারপর পথ চলতে চলতে একসময় প্রায় সবারই যে অনুভূতিটা জাগে, ঘরে ফিরতে হবে! পেরেজও তারপর ঘরে ফিরলেন।

গ্রিসের ক্লাব পিএওকে–তে থাকতে ২০১৪ সালে ধারে ফিরলেন শৈশবের ভালোবাসার ক্লাব দেপোর্তিভোয়। চোটের কারণে প্রথম মৌসুমে বেশি ম্যাচ খেলতে না পারলেও ক্যাম্প ন্যুতে তাঁর গোলে ঘুরে দাঁড়িয়ে ড্র করেছিল দেপোর্তিভো। অবনমনের চোখরাঙানিও দূরে সরে গিয়েছিল।

পরের মৌসুমে দেপোর্তিভোয় স্থায়ী হলেন, সে মৌসুমে ১৭ গোল করে হন ক্লাবের সর্বোচ্চ গোলদাতা, আবারও অবনমন এড়ায় ক্লাবও। এরপর ডাক এল আর্সেনাল থেকে। সেখান থেকে আবারও দেপোর্তিভোয় ধারে ফিরতে হয়, সে মৌসুমেই দ্বিতীয় বিভাগে নেমে যায় দেপোর্তিভোও। পেরেজ ওদিকে ওয়েস্ট হাম ঘুরে আবারও স্পেনে ফিরে আলাভেস ও এলচে হয়ে ২০২২ সালে যোগ দেন কাদিজে। এসবই নিজ নিজ দেশের শীর্ষ লিগে খেলা ক্লাব।

দেড় বছরের চুক্তিতে কাদিজে পেরেজ ভালোই করছিলেন। ২০২২–২৩ মৌসুমে ছিলেন ক্লাবের সর্বোচ্চ গোলদাতা। কিন্তু পেরেজ হঠাৎ করেই একদিন সিদ্ধান্ত নিলেন, ঘরে ফিরতে হবে! সে জন্য কি করতে হবে? নিজের রিলিজ ক্লজের টাকাটা দিতে হবে কাদিজকে। আর কাদিজ থেকে বের হয়ে যোগ দেবেন কোথায়, সেই দেপোর্তিভোতেই—যারা তখন স্পেনের তৃতীয় বিভাগে নেমে গেছে।

পেশাদার দৃষ্টিকোণ থেকে এটা কোনো সিদ্ধান্তই নয়। স্রেফ পাগলামি! পারিশ্রমিক কম পাবেন (কাদিজের তুলনায় প্রায় ৯০ হাজার ইউরো বেতন কম), সুযোগ–সুবিধাও অনেক কম হবে। কেউ কীভাবে নিজের পায়ে এমন কুড়াল মারে! কিন্তু সবাই তো পেরেজ নয়। সেটা চাইলেও সবাই হতে পারে না।

আরও পড়ুন

পেরেজ কী করলেন, (ইএসপিএনের মতে) রিলিজ ক্লজের অর্ধেক টাকা নিজের পকেট থেকে দিলেন। টাকার অঙ্কে সেটি ৪ লাখ ৯৩ হাজার ইউরো। বাংলাদেশি মুদ্রায় সাড়ে ৫ কোটি ইউরোর বেশি। দেপোর্তিভো তখন চার বছর হলো তৃতীয় বিভাগে নেমে গেছে। নব্বই দশকের শেষ ভাগ এবং বিংশ শতকের শুরুতে এই ক্লাবটাই কী দুর্দান্ত ছিল!

১৯৯৯–২০০০ মৌসুমে লিগ চ্যাম্পিয়ন হওয়া সে দলকে ‘সুপার ডেপোর’ বলতেন অনেকেই। তখন ক্লাবটিতে ব্রাজিলের মাউরো সিলভা, পর্তুগালের পলেতা ও নেদারল্যান্ডসের রয় ম্যাকের মতো খেলোয়াড়েরা ছিলেন। লা লিগায় ওই একবারই চ্যাম্পিয়ন হয় দেপোর্তিভো। ২০০৩–০৪ মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালেও উঠেছিল স্পেনের গ্যালিসিয়া অঞ্চলের ক্লাবটি। পেরেজ সেই দেপোর্তিভোকে দেখে বড় হয়েছেন। শৈশবে ভালোবেসেছিলেন সেই ‘সুপার ডেপোর’কে। কিন্তু ৩৪ বছর বয়সী পেরেজের দ্বিতীয়বার ফেরার লগ্নে ক্লাবটি আর তেমন ছিল না। তাতে কী, পেরেজ তত দিনে বাড়ি ফেরার পাঁজরছেঁড়া টান টের পেয়েছেন।

দেপোর্তিভোয় ফেরার কারণটাও (গত বছর জানুয়ারি) ক্লাবটিতে ফেরার পর বলেছিলেন পেরেজ, ‘চার বছর বয়সী একটা বাচ্চা এই করুনিয়ায় খেলত। তার একটা স্বপ্ন ছিল। এখন সেটা পূরণের সময়। আমি তারকা নই, আমি লুকাস। সেই আগের ছেলেটিই আছি। এখানে কাউকে বাঁচাতে আসিনি, সাহায্য করতে এসেছি।’ ভালো পারিশ্রমিক ছেড়ে তৃতীয় বিভাগের ক্লাবে যোগ দেওয়া প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘আমি টাকায় পরিচালিত হই না।’

আরও পড়ুন

পেরেজকে যা পরিচালিত করেছে, সেটি আসলে ভাষায় বোঝানো অসম্ভব। শুধু ‘ভালোবাসা’ তকমা দিয়ে এই অনুভূতির পুরোটা কি ধারণ করা সম্ভব? সেদিন ওই ফ্রি–কিক নেওয়ার সময় গুটি গুটি পায়ে পেরেজ যখন বলটি বসাচ্ছিলেন, তখন তাঁর মনের মধ্যে কী চলছিল? পেছনে ফেলে আসা সময় এবং সামনে হাতছানি দিয়ে ডাকা ফল? গোলটা করার পর রিয়াজোরের গ্যালারি এবং বাইরে যে উদ্‌যাপন হয়েছে—পেরেজের কাছে তার দাম নিশ্চয়ই অমূল্য। ওটাই ভালোবাসা!

চলতি মৌসুমে ৩০ ম্যাচে ১২ গোল ও ১৭টি গোল করানো এই ফরোয়ার্ড কেবল প্রথম ধাপটি পার হলেন। দেপোর্তিভোয় ফেরার আগে বলেছিলেন, ক্লাবটিকে শীর্ষ লিগে ফিরিয়ে নিতে চান। সে লক্ষ্যে এবার প্রথম ধাপটা পাড়ি দিলেন পেরেজ। আগামী মৌসুমে পেরেজ স্বপ্নপূরণ করতে পারেন কি না, সেটাই দেখার অপেক্ষা।