ক্যানসারকে হারিয়ে বিশ্বকাপে গোল করলেন ১৮ বছর বয়সী এই কলম্বিয়ান

গোলের পর লিন্ডা কাইসেদোছবি: এএফপি

১৮ বছর বয়সে বিশ্বকাপ অভিষেকেই গোল। যেকোনো ফুটবলারের জন্য এ এক অনন্য স্বপ্নপূরণ। তবে কলম্বিয়ান ফুটবলার লিন্ডা কাইসেদোর এটা শুধুই স্বপ্নপূরণের কোনো গল্প নয়। এটা একজন হার না মানা মানুষের ফিরে আসার গল্পও। মাঠের বাইরে লড়াই করে ক্যানসারকে হারিয়ে এসে মাঠেও জিতলেন কাইসেদো।

মেয়েদের বিশ্বকাপে গতকাল দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে ২-০ গোলে জিতেছে কলম্বিয়া। এই জয়ের পথে ম্যাচের ৩৯ মিনিটে দলের হয়ে দ্বিতীয় গোলটি করেন কাইসেদো। সিডনিতে ম্যাচের সেরা খেলোয়াড়ও হয়েছেন এই কলম্বিয়ান। পুরো ব্যাপারটাই যেন অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল তাঁর কাছে। পুরস্কার হাতে বলেছেন, ‘আমি কখনো ভাবিনি দলের সঙ্গে এভাবে লড়াই করতে পারব। সতীর্থরা আমাকে আত্মবিশ্বাস দিয়েছে। আর আমি মনে করি, নিজের সেরাটা দিয়ে আমি মাঠে তাদের সাহায্য করতে পারব। আমি এখনো অনেক তরুণ। এটা আমার প্রথম বিশ্বকাপ। আমি এটা উপভোগ করতে চাই।’

আরও পড়ুন

এদিন দলকে গোল এনে দেওয়ার পাশাপাশি নিজের গতি ও চোখধাঁধানো ড্রিবলিংয়ে সবার নজর কেড়েছেন কাইসেদো। নিজে ব্যক্তিগতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যালেক্স মরগান এবং স্পেনের অ্যালেক্সিস পুতেয়াসের ভক্ত হলেও সতীর্থরা তাঁকে তুলনা করেন ব্রাজিলিয়ান তারকা নেইমারের সঙ্গে। দুজনের খেলার ধরনেও আছে দারুণ কিছু মিল। কলম্বিয়ার সহকারী কোচ অ্যাঞ্জেলো মারসিগলিয়া কাইসেদো সম্পর্কে বলেছেন, ‘সে একজন অনন্যসাধারণ খেলোয়াড়। সে দারুণ পরিণত এবং মাঠে নেতৃত্ব দেওয়া খেলোয়াড়দের একজনও বটে। সে যেন ভিন গ্রহের কোনো খেলোয়াড়, একেবারেই স্বতন্ত্র।’

কলম্বিয়ার তৃতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ খেলার পথেও দারুণ অবদান আছে কাইসেদোর। এর আগে নারীদের কোপা আমেরিকায় দলকে ফাইনালেও তুলেছিলেন এই ফুটবলার। ট্রফি জিতে না পারলেও গোল্ডেন বল ঠিকই জিতে নিয়েছিলেন কাইসেদো। সেমিফাইনালে তাঁর গোলেই আর্জেন্টিনাকে হারিয়েছিল কলম্বিয়া। সে সময় দলকে ফাইনালে তোলার পর কাইসেদো বলেছিলেন, ‘আমি স্তব্ধ, বিশ্বাসই হচ্ছে না। আমার সময় ভালো যাচ্ছিল না। কিন্তু গোল করার সুযোগ পেয়ে কাজে লাগালাম। আমি এতটা আনন্দ আর কখনো পাইনি। এ রাত ভোলার মতো নয়। ফুটবলার হিসেবে এই মুহূর্তটা সব সময় থেকে যাবে।’

গোলের পর কাইসেদো
ছবি: এএফপি

এখন বিশ্বকাপ গোলের পর কী বলবেন কাইসেদো! স্বপ্নের পরিধিটা নিশ্চয় এখন আরও বেড়ে গেছে। এত কিছুর পরও কাইসেদোর গল্পটা শুধুই অর্জনের নয়। ক্যারিয়ারের একপর্যায়ে থমকে যেতে বসেছিল সবকিছু।

২০০৫ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি জন্মানো এই ফুটবলার যাত্রাটা শুরু করেছিলেন পাঁচ বছর বয়স থেকে। তখন অনুশীলন করতেন ছেলেদের সঙ্গে। ছেলেদের সঙ্গে খেলার কারণে নিজেকে আরও ভালো গড়ে তুলতে পেরেছেন জানিয়ে কাইসেদো বলেছেন, ‘ছেলেদের সঙ্গে খেলা আমাকে এই প্রতিভা দিয়েছে। আমি বুঝতে পেরেছি যে তাদের সঙ্গে খেলা শারীরিক এবং মানসিকভাবে একেবারেই ভিন্ন। এ জন্য আমি কৃতজ্ঞ।’ ফুটবলের পথে সেই যাত্রা অব্যাহত রেখে মূল দলের হয়ে কাইসেদোর অভিষেক হয় ২০১৯ সালে। মাত্র ১৪ বছর বয়সে কাইসেদো কলম্বিয়ার ক্লাব আমেরিকা দ্য ক্যালির হয়ে খেলা শুরু করেন।

আরও পড়ুন

কিন্তু স্বপ্নের মতো সে জীবনে ঝড়টা আসে ২০২০ সালে। আক্রান্ত হন ডিম্বাশয়ের ক্যানসারে। সে সময়ের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল, তা জানিয়ে কাইসেদো বলেছেন, ‘আমি ভেবেছিলাম আর ফুটবলে ফিরতে পারব না।’ সে বছরের এপ্রিলের ১৫ তারিখ হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সরানো হয় টিউমারটি। এরপর শুরু হয় কেমোথেরাপি। চিকিৎসকদের প্রচেষ্টা এবং নিজের হার না মানা মানসিকতা অস্ত্রোপচারের পাঁচ মাসের মধ্যে তাঁকে ফিরিয়ে আনে অনুশীলনে। ফিরে আসা নিয়ে কাইসেদোর মন্তব্য, ‘এ সমস্যা কাটিয়েও যে ফিরে আসা যায়, আমি তার দৃষ্টান্ত।’

রিয়াল মাদ্রিদের জার্সিতে কাইসেদো
ছবি: টুইটার

পুরোপুরি সেরে উঠে ফের ফুটবল পায়ে জাদু দেখানো শুরু করেন কাইসেদো। ২০২১ সালে দ্বিতীয়বারের মতো জেতেন কলম্বিয়ান লিগ। এবার তাঁর দল ছিল দিপার্তিভো ক্যালি। এ ছাড়া প্যারাগুয়ে ও উরুগুয়েতে আয়োজিত কোপা লিবার্তাদোর্সে পেয়েছেন সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার। ২০২২ সাল ছিল তাঁর জন্য সবচেয়ে স্মরণীয়। বছরজুড়ে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের ফলস্বরূপ তাঁকে দলে টেনে নেয় রিয়াল মাদ্রিদ। এর মধ্যে রিয়ালের হয়ে ১০ ম্যাচ খেল করেছেন ২ গোল এবং আরও ৪ গোলে করেছেন সহায়তা। আর এবার বিশ্বকাপে পেলেন উড়ন্ত সূচনা।

আরও পড়ুন

মাত্র ১৮ বছর বয়সেই জীবনের উত্থান-পতনের সব চিত্র দেখা হয়ে গেছে কাইসেদোর। কিন্তু পথটা তো অনেক লম্বা। এখনো পাওয়ার আছে অনেক কিছু। যার শুরুটা হয়তো বিশ্বকাপ দিয়েই হলো। তাঁকে নিয়ে দলের ফরোয়ার্ড ল্যাডি আন্দ্রাদের কথা দিয়ে এই লেখা শেষ করা যাক, ‘লিন্ডা (কাইসেদো) একজন ফেনোমেনন। সে আমাদের ভবিষ্যৎ নয়, বরং বর্তমান।’