ডিয়ার কমরেড: প্রেম, ক্রিকেট, নিপীড়ন ও লড়াইয়ের গল্প

সিনেমাকে কখনো কখনো বাস্তবতার পুনর্নির্মাণ হিসেবে দেখা হয়। এই পুনর্নির্মাণ কখনো ব্যক্তিগত, কখনো সামাজিক বা রাজনৈতিক ঘটনার প্রতিফলন। তবে কিছু সিনেমা তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু—যেখানে ব্যক্তিগত আবেগের সঙ্গে মিশে থাকে গভীর সামাজিক বার্তা। ঠিক যেমনটি দেখা গেছে ‘ডিয়ার কমরেড’-এ।

তেলেগু ভাষার এই সিনেমা মুক্তি পায় ২০১৯ সালে। অভিনয়ে ছিলেন বিজয় দেবরাকোন্ডা ও রাশমিকা মান্দানা। মুক্তির পরপরই ছবিটি দর্শক ও সমালোচকের প্রশংসা কুড়ায়। কেউ দেখেছেন একে স্পোর্টস ড্রামা হিসেবে, কেউ আবার রোমান্টিক অ্যাকশন ড্রামা ঘরানাতেও ফেলেছেন। গল্পে প্রেম আছে, আছে সংগ্রামও—ক্রিকেটার লিলির নিপীড়ন ও লড়াইয়ের গল্প প্রেমের গল্পের সমান্তরালেই চলে।

সিনেমাটিকে দুই পর্বে ভাগ করা যায়। প্রথম পর্বে দেখা যায় কলেজের ‘অ্যাংরি ইয়াংম্যান’ ববিকে—প্রতিবাদী, উগ্র স্বভাবের এক তরুণ। নাটকীয়ভাবে লিলির সঙ্গে তার প্রেম হয়। লিলি তখন ক্রিকেটে নিজের জায়গা খুঁজে নিচ্ছে। কিন্তু কিছুদিন পর সম্পর্কটা ভেঙে যায়।

আরও পড়ুন

দ্বিতীয় পর্বে আসে অন্ধকার। ক্রিকেটে নিজের স্বপ্নপূরণের পথে বোর্ডের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার হাতে যৌন হেনস্তার শিকার হয় লিলি। সেই আঘাতে সে ক্রিকেট ছেড়ে দেয়, আড়ালে চলে যায়, মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। ঠিক তখনই ববি ফিরে আসে তার জীবনে। নানা বাধা পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত লিলি নিজেই নিজের জন্য লড়তে শুরু করে। অপরাধীর শাস্তির দাবি জানায়, আবার ফিরে যায় ক্রিকেট মাঠে।

‘ডিয়ার কমরেড’–এ বিজয় ও রাশমিকা
আইএমডিবি

‘ডিয়ার কমরেড’-এ ববি-লিলির প্রেমের পাশাপাশি লিলির পাশে ববির দাঁড়িয়ে থাকার বিষয়টি বিশেষভাবে ছুঁয়ে যায়। যেই লিলির জীবনে ক্রিকেট ছিল স্বপ্নের মতো প্রিয়, একজন নিপীড়কের কারণে সেটাই একসময় হারাতে হয় তাকে। জীবনের এমন কঠিন সময়েই দরকার হয় এক ‘কমরেড’—একজন সত্যিকারের বন্ধু। সেই বন্ধু হয়েই লিলির জন্য লড়াই করে ববি। তবে প্রেম কেবল গল্পের এক দিক। এর গভীরে আছে ক্ষমতাবান পুরুষের হাতে নারীর অসম্মানিত হওয়ার গল্প আর তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানানোর সাহসী কণ্ঠ।

‘ডিয়ার কমরেড’-এর সবচেয়ে বড় শক্তি এর গল্প—গভীর, বহুমাত্রিক, অথচ স্পর্শকাতরভাবে বাস্তব। প্রথমে হয়তো এটিকে প্রেমকাহিনি মনে হয়, কিন্তু ভেতরে লুকিয়ে আছে সমাজ, রাজনীতি, আত্মসংঘাত, নারীর স্বপ্নভঙ্গ ও প্রতিরোধের এক জটিল ছবি। গল্পে আবেগের বিস্ফোরণ আছে, আছে ভাঙচুরও—সবকিছু একসঙ্গে সামলানো সহজ ছিল না; কিন্তু পরিচালক ভারত কাম্মা সেটিই করে দেখিয়েছেন।

আরও পড়ুন

ভারত তাঁর গল্প বলার কৌশলে ছবিটিকে একঘেয়ে হতে দেননি। কখনো তীব্র রাগ, কখনো ভালোবাসার কোমলতা—এই ওঠানামা তিনি নিয়ন্ত্রণ করেছেন নিখুঁতভাবে। প্রেম, প্রতিবাদ, সংগ্রাম ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই—সব উপাদান তিনি এমনভাবে গেঁথেছেন যে প্রতিটি অংশই অন্যটির সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে মিশে গেছে। কোথাও বিচ্ছিন্ন লাগে না।

বিজয় দেবরাকোন্ডা ও রাশমিকা মান্দানার অভিনয় ছিল অনবদ্য। আবেগের টানাপোড়েনের মুহূর্তগুলোতে তাঁদের সংযত অথচ শক্তিশালী অভিনয় গল্পের প্রভাব আরও বাড়িয়েছে। পাশের চরিত্রগুলোও নিখুঁতভাবে ফুটে উঠেছে। সিনেমাটোগ্রাফি, গান, আবহসংগীত ও সম্পাদনার কাজও দারুণ মানসম্পন্ন।

ডিয়ার কমরেড ছবির পোস্টার
সংগৃহীত

সব মিলিয়ে, ‘ডিয়ার কমরেড’ শুধু প্রেমের গল্প নয়, এটি মানুষের ভেতরের লড়াই, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আর পরিণত হওয়ার গল্প। ভালোবাসা এখানে যেমন আছে, তেমনি আছে আত্মসম্মানের আগুনও। শেষ পর্যন্ত ছবিটি মনে করিয়ে দেয়—প্রেমের চেয়ে বড় হচ্ছে পাশে দাঁড়ানোর সাহস। আর সেটিই এক কমরেডের আসল পরিচয়।

ডিয়ার কমরেড (২০১৯)

পরিচালক: ভারত কাম্মা

অভিনয়: বিজয় দেবেরাকোন্ডা, রাশমিকা মান্দানা, শ্রুতি রামচন্দরন প্রমুখ

আইএমডিবি রেটিং: ৭.৩/১০

রানটাইম: ২ ঘণ্টা ৪৯ মিনিট