মেসির সঙ্গে আবার দেখা এবং হেগার্ডের ‘চক্রপূরণ’

ইন্টার মায়ামি ও শার্লট এফসির মধ্যকার ম্যাচ শেষে মেসির সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন ক্রিস হেগার্ডছবি: টুইটার

টুইটটি করেছে শার্লট এফসি। যুক্তরাষ্ট্রের মেজর লিগ সকারের (এমএলএস) এই ক্লাব পাশাপাশি দুটি ছবি পোস্ট করেছে গতকাল। একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, হলুদ জার্সি পরা কিছু শিশুর মাঝখানে বল নিয়ে দৌড়াচ্ছেন লিওনেল মেসি। কালো প্যান্ট ও শাদা টি-শার্ট পরা মেসিকে দেখে বোঝা যায়, খুদে ফুটবলপ্রেমীদের বিনোদন দিচ্ছেন। অন্য ছবিটিও ফুটবলের।

আরও পড়ুন

শনিবার লিগস কাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ৪-০ গোলে শার্লট এফসিকে হারায় ইন্টার মায়ামি। সে ম্যাচের পর শার্লটের খেলোয়াড় ক্রিস হেগার্ডের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছিলেন মেসি—এই ছবি পোস্ট করেছে শার্লট এফসি। দুটি ছবি পোস্ট করে শার্লট লিখেছে ‘চক্রপূরণ।’ শুধু শার্লট কেন, ইন্টার মায়ামির মুখোমুখি হওয়ার আগে ‘ফক্স ৫’–কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে হেগার্ডও বলেছিলেন, এ ম্যাচে মেসির সঙ্গে দেখা হওয়ার মধ্য দিয়ে তাঁর ‘চক্রপূরণ’ হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, কিসের চক্রপূরণ?

গল্পের গোড়ায় যাওয়ার আগে একটি তথ্য জানিয়ে রাখা যাক। মায়ামির বিপক্ষে মাঠে নামার সুযোগ পাননি ২১ বছর বয়সী ক্রিস হেগার্ড। শেষ বাঁশি বাজার পর বেঞ্চ থেকে উঠে এসে লিওনেল মেসির সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। ২০০২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সান ডিয়েগোয় জন্ম নেওয়া এ ফুটবলার ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় বিভাগের ক্লাব তাকোমা ডিফায়েন্সের হয়ে পেশাদার ক্যারিয়ার শুরু করেন। গত বছর যোগ দেন শার্লট এফসিতে।

এবার গল্পে ফেরা যাক। আট বছর বয়সে লিভার ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছিলেন ক্রিস হেগার্ড। লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এর মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের দাতব্য প্রতিষ্ঠান ‘মেক আ উইশ’ ফাউন্ডেশন তাঁর চিকিৎসায় এগিয়ে আসে। এই ফাউন্ডেশনের লক্ষ্য, আড়াই থেকে ১৮ বছর বয়সী জটিল রোগে আক্রান্ত বাচ্চাদের ইচ্ছা পূরণ করা। হেগার্ডের বয়স যখন ১১ বছর, তখন তাঁর একটি ইচ্ছা পূরণ করেছিল মেক আ উইশ ফাউন্ডেশন। আর সেটাই ছিল এই চক্রের শুরু।

আরও পড়ুন

২০১৩ সালে হেগার্ডসহ জটিল রোগে আক্রান্ত ১২ শিশুকে বার্সেলোনায় নিয়ে গিয়েছিল এই ফাউন্ডেশন। ইএসপিএনের মতে, সেসব শিশুর মধ্যে কেউ কেউ মৃত্যুপথযাত্রীও ছিল। মেসি ছিলেন তাদের অতিথি। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে শিশুরা মেসির সঙ্গে ড্রিবল করেছে, স্প্যানিশ ভাষায় দু-একজন কথাও বলেছে তাঁর সঙ্গে। কিন্তু একটি ছেলে চুপ করে ছিল।

সেখানে যত খুদে মানুষ ছিল, তাদের মধ্যে সেই ছেলে ফুটবলে সবচেয়ে ভালো ছিল। পায়ের কাজে দ্রুতই নজর কেড়ে নিয়েছিল মেসির। আর্জেন্টাইন তারকা জানতে চেয়েছিলেন, ছেলেটি কি রোগে ভুগছে? যে ছেলে ‘সিজর্স কিক’–এর মতো কঠিন শট নিতে পারে, সেই ছেলে কোনো রোগে ভুগছে, এটা বুঝি মেসির বিশ্বাস হচ্ছিল না! মেসি নিশ্চয়ই শুনেছিলেন যে ছেলেটির ক্যানসার। তবে গল্পের ভেতরও যেমন গল্প থাকে, হেগার্ডেরও তেমন একটা গল্প ছিল।

ইএসপিএন ২০১৩ সালের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, সাত বছর বয়সী হেগার্ডকে বিবেচনা করা হতো যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবলে সেরা উঠতি প্রতিভা। ওই বয়সেই নাকি সে ১৮ বছর বয়সীদের মতো বুদ্ধিদীপ্ত ফুটবল খেলতে পারত। একসঙ্গে তিনটি পাস ভেবে রাখার মতো মানসিক পরিপক্বতা সে ওই বয়সেই অর্জন করেছিল। হেগার্ডের ভাই জ্যারেড এবং দুই বোন ম্যাটি ও অদ্রেও খেলাধুলার সঙ্গে জড়িত ছিল। হেগার্ডের প্রতিভা দেখে তার মা–বাবা তাকে আট বছর বয়সীদের লিগে ভর্তি করিয়ে দেন।

ফুটবলপাগল হেগার্ড সেই বয়সে ম্যাচের আগের দিন জার্সি পরে ঘুমাতে যেত, মা–বাবার কাছ থেকে দুটি পয়সা পেলে খেলার সরঞ্জাম কেনার জন্য জমিয়ে রাখত। আর ফুটবল খেলতে সারা বাড়িতে। সে জন্য বকুনিও শুনতে হয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়ান ট্যালেন্ট স্কাউট ব্রানডন জ্যান্টজ তখন বলেছিলেন, ক্রিস ‘সম্ভবত ইউরোপিয়ান। সে আসলে একটি শিশুর শরীরের ভেতর লুকায়িত পূর্ণবয়স্ক মানুষ’।

আরও পড়ুন

কিন্তু শুধু প্রতিভা থাকলেই হয় না, ভাগ্যের পরশও লাগে। ২০০৯ সালের ৫ ডিসেম্বর স্থানীয় এক টুর্নামেন্টে ফলব্রুক ফিউরির হয়ে খেলার সময় পেটে বলের আঘাতে মাঠেই পড়ে যায় ক্রিস হেগার্ড। প্রায় ৬০ সেকেন্ড পর উঠে দাঁড়িয়ে ম্যাচের বাকি ১০ মিনিট শেষ করে বমি করতে শুরু করেছিল ক্রিস। তার এক সতীর্থের চিকিৎসক বাবা সে সময় মাঠেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কিছু ধরতে পারেননি।

পরে চিকিৎসকের কাছে ভালো করে দেখানোর পর ধরা পড়ে, ক্রিস হেগার্ডের লিভার টিউমার আছে। বলের আঘাতে সেটি ফেটে ভেতরে রক্তপাত হচ্ছে। পরে ক্রিসের মা কিম বলেছিলেন, বলটাই আসলে তাঁর ছেলেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। বলটি পেটে আঘাত না করলে তাঁরা সময়মতো জানতে পারতেন না যে ছেলে ক্যানসারে ভুগছে!

পরে জানলেও অনেক দেরি হয়ে যেত। কারণ, ক্যানসার তত দিনে হেগার্ডের লিভারের এক-তৃতীয়াংশ স্থানে ছড়িয়ে পড়েছিল। সে যা–ই হোক, লস অ্যাঞ্জেলেসের এক হাসপাতালে প্রথম দফায় কেমোথেরাপি নিয়ে ক্রিস কিছুটা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছিল বড়দিনের উৎসবের দিনে। সেদিন তাদের বাসায় ‘ক্রিসমাস ট্রি’র নিচে তার জন্য একটি উপহার রেখে দিয়েছিলেন মা–বাবা। একটি ফুটবল ও লিওনেল মেসির জার্সি!

আরও পড়ুন

পরের ধাপটা ছিল সবচেয়ে কঠিন। ক্রিস হেগার্ডের লিভার প্রতিস্থাপন করতে হতো। তাঁর বাবা রন নিজের লিভারের অংশ দিতে চেয়েছিলেন। চিকিৎসকেরাও রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু অস্ত্রোপচারের দিন জানা যায়, কম বয়সী এক ছেলে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা গেছে, যার লিভার ক্রিসের জন্য উপযোগী। চিকিৎসকেরা সিদ্ধান্ত পাল্টে সেই ছেলের লিভারের অংশ ক্রিসের শরীরে প্রতিস্থাপন করেন এবং ১০ দিন পর তাকে হাসপাতাল থেকে ছাড়েন। ২০১০ সালের জুনে কেমোথেরাপির পর্বও শেষ করার পর চিকিৎসকেরা ক্রিস হেগার্ডকে ফুটবল খেলার ছাড়পত্র দেন।

এরপর ক্রিসকে আরও অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। কিন্তু সেই অসুস্থতার কারণে প্রত্যাশার প্রতিদান এখনো দিয়ে উঠতে পারেননি। যদিও তাঁর ক্যারিয়ারের কেবল শুরু। সেদিন মেসির সঙ্গে ক্রিস হাত মেলানোর পর শার্লটের টুইটেই এর তাৎপর্যটা বোঝা যায়, ‘১০ বছর পর মেসির সঙ্গে তার আবার দেখা হলো। এবার পেশাদার ফুটবলার হিসেবে মাঠে’।

ক্রিসের কেমন লেগেছে, সেটি তাঁর কথায়ই পরিষ্কার। মেসির মুখোমুখি হওয়ার আগেই বলেছিলেন, ‘ছোটবেলায় কখনো ভাবিনি যে ১১ বছর পর তাঁর সঙ্গে আবার দেখা হবে। জীবন আমাদের কখন, কীভাবে কার সঙ্গে দেখা করিয়ে দেবে, তা কেউ জানে না।’