যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছেন ট্রাম্প, বিশ্বকাপের দুটি দেশের সমর্থকদের নিয়ে বিপাকে ফিফা

২০২৬ বিশ্বকাপে দুটি দেশের দর্শকদের মাঠে বসে খেলা দেখা নিয়ে বেকায়দায় ফিফারয়টার্স

২০২৬ ফিফা বিশ্বকাপের জন্য টিকিটের আবেদন গ্রহণ শুরু হয়েছে বৃহস্পতিবার। আগ্রহী যে কেউ নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটে গিয়ে বিশ্বকাপের ম্যাচ দেখার জন্য আবেদন করতে পারছেন।

তবে টিকিট কেনার সুযোগ পৃথিবীর সব প্রান্তের দর্শকের জন্য প্রযোজ্য হলেও খোদ বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করা দুটি দেশের মানুষই এ নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। ২০২৬ সালের জুন-জুলাইয়ে হতে যাওয়া বিশ্বকাপে আছে ইরান ও হাইতি। আর এই দুই দেশের জনসাধারণের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্রের ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন। অর্থাৎ, নিজেদের জাতীয় ফুটবল দল বিশ্বকাপ খেলতে নামলেও ইরান ও হাইতির দর্শকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের সুযোগ নেই।

এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বকাপের মূল কর্তৃপক্ষ ফিফা আছে বেকায়দায়। বিশ্বকাপের মাধ্যমে ‘বিশ্বকে একসুতোয় গাঁথা’ আর দর্শকের জন্য উপভোগ্য একটি আয়োজনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে চললেও অংশগ্রহণকারী দলের সমর্থকদেরই খেলা দেখার নিশ্চয়তা দিতে পারছে না সংস্থাটি।

যুক্তরাষ্ট্রেই সব ম্যাচ

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত ৪ জুন নির্বাহী আদেশে ১২টি দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেন। দেশগুলো হচ্ছে আফগানিস্তান, মিয়ানমার, চাদ, কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, ইকুয়েটোরিয়াল গিনি, ইরিত্রিয়া, হাইতি, ইরান, লিবিয়া, সোমালিয়া, সুদান ও ইয়েমেন।

এই দেশগুলোর মধ্যে এশিয়ান বাছাই থেকে ইরান গত ২৫ মার্চ এবং কনক্যাকাফ বাছাই থেকে হাইতি ১৯ নভেম্বর বিশ্বকাপে জায়গা নিশ্চিত করে। ইরান টানা চতুর্থ এবং সব মিলিয়ে সপ্তমবারের মতো বিশ্বকাপের টিকিট কেটেছে। তবে ১৯৭৪ সালের পর এবারই প্রথম বিশ্বকাপে জায়গা করতে পেরেছে ক্যারিবীয় অঞ্চলের দেশ হাইতি।

৫৪ বছর পর বিশ্বকাপে ফেরা হাইতি পড়েছে ‘সি’ গ্রুপে
এএফপি

এবারের ৪৮ দলের বিশ্বকাপে যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি কানাডা এবং মেক্সিকোও ম্যাচ আয়োজন করবে। ৫ ডিসেম্বর বিশ্বকাপের ড্র এবং ৬ ডিসেম্বর ম্যাচের লাইনআপ চূড়ান্ত হয়। এতে দেখা যায়, গ্রুপ পর্বে ইরান ও হাইতির সব ম্যাচই পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। মেক্সিকো ও কানাডায় কোনো ম্যাচ নেই।

‘সি’ গ্রুপে থাকা হাইতির ম্যাচ বোস্টন (১৩ জুন স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে), ফিলাডেলফিয়া (১৯ জুন ব্রাজিলের বিপক্ষে) এবং আটলান্টায় (২৪ জুন মরক্কোর বিপক্ষে)। আর ‘জি’ গ্রুপে থাকা ইরানের ম্যাচগুলো লস অ্যাঞ্জেলেস (১৫ জুন নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে, ২১ জুন বেলজিয়ামের বিপক্ষে) এবং সিয়াটলে (২৬ জুন মিসরের বিপক্ষে)।

আরও পড়ুন

দল খেলতে পারবে?

ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞায় থাকলেও ইরান ও হাইতি ফুটবল দলের যুক্তরাষ্ট্রে যেতে বাধা নেই। ট্রাম্পের সই করা নিষেধাজ্ঞার নির্বাহী আদেশে কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে আওতামুক্ত রাখা হয়েছে, যার মধ্যে ক্রীড়া দলও আছে। আদেশের ধারা-৪-এ বলা আছে, ‘কোচ, প্রয়োজনীয় সহায়ক ভূমিকা পালনকারী ব্যক্তিরা (যেমন টিম স্টাফ) এবং তাঁদের নিকটাত্মীয়রা’ নিষেধাজ্ঞার বাইরে থাকবেন।

তবে যেকোনো খেলায় গ্যালারিতে যাঁরা রং ছড়ান, সেই দর্শকের জন্য এই আদেশে কোনো শব্দ নেই। আর এখানেই মাঠে বসে বিশ্বকাপ দেখা নিয়ে অনিশ্চয়তায় ইরান ও হাইতির নাগরিকেরা।

যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে সক্রিয়!

টুর্নামেন্টের সফলতা-বিফলতার বড় মানদণ্ড ‘দর্শক-সমর্থকের যুক্ততা’। অভিবাসন প্রশ্নে রক্ষণশীল মানসিকতার ট্রাম্প সরকারও যেমন বিশ্বকাপে ৫০ থেকে ৭০ লাখ দর্শকের ভ্রমণ আশা করছে তাদের দেশে। আর তৃতীয় দেশের দর্শক-সমর্থক অনেক বেশি থাকলেও যেকোনো ফুটবল ম্যাচে সবচেয়ে বড় উন্মাদনা ও উৎসবের আবহ নিয়ে আসেন অংশগ্রহণকারী দেশের মানুষই। যে কারণে বিশ্বকাপে ইরান ও হাইতির দর্শককে টুর্নামেন্টের স্বার্থেই দরকার ফিফা ও যুক্তরাষ্ট্রের।

তবে বিশ্বকাপ শুরুর অর্ধবছর আগপর্যন্ত এ নিয়ে একধরনের চাপেই আছে ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা। ইরানের বিষয়ে ট্রাম্প সরকারের মনোভাব ‘শত্রুভাবাপন্ন’। জুনে পশ্চিম এশিয়ার দেশটিতে হামলাও চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এমনকি বিশ্বকাপের ড্রকে কেন্দ্র করেও ইরানের বিষয়ে কঠোর অবস্থানে ছিল ট্রাম্প সরকার।

৫ ডিসেম্বর ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠেয় বিশ্বকাপ ড্রয়ে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর প্রতিনিধিদের। তবে ইরানের ফুটবল ফেডারেশন জানায়, যুক্তরাষ্ট্র তাঁদের প্রতিনিধিদলের কয়েকজনকে ভিসা দেয়নি। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে বিশ্বকাপ ড্র বর্জনের ঘোষণা দেয় ইরান।

আরও পড়ুন

তবে ফিফার হস্তক্ষেপে শেষ পর্যন্ত ইরান ড্র বর্জন থেকে সরে আসে। ফিফা জানায়, ইরানের কোচ ড্র অনুষ্ঠানে থাকবেন। তবে এটি স্পষ্ট হয়নি যুক্তরাষ্ট্র শুরুতে যাঁদের ভিসা দেয়নি, তাঁদের সবাইকে পরে দেওয়া হয়েছে কি না।

এর মধ্যেই ৩ ডিসেম্বর বিশ্বকাপ–সম্পর্কিত হোয়াইট হাউস টাস্কফোর্সের নির্বাহী পরিচালক অ্যান্ড্রু জিউলিয়ানির একটি মন্তব্য ইরান ও হাইতির দর্শকদের উদ্বেগ আরও বাড়িয়েছে। তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্র এ–সংক্রান্ত প্রতিটি সিদ্ধান্ত নিচ্ছে জাতীয় নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে। ‘সম্ভাব্য হুমকি’ মনে করা প্রত্যেকের ভিসা আবেদনই দেশটি প্রত্যাখ্যান করবে বলে জানান জিউলিয়ানি।

বিশ্বকাপের মতো অন্তর্ভুক্তিমূলক বৈশ্বিক আয়োজনকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের এমন নীতির তীব্র সমালোচনা করেছেন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল স্পেনের ক্রীড়া ও মানবাধিকারবিষয়ক প্রধান কার্লোস দে লাস হেরাস। তিনি বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের নির্যাতনমূলক অভিবাসন নীতি, যার মধ্যে রয়েছে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা, আটক বাড়ানো এবং ভিসা অ্যাকসেসে সীমাবদ্ধতা—বিশ্বকাপের অন্তর্ভুক্তিমূলক চরিত্রের জন্য হুমকি। হাজার হাজার ভক্তকে যখন প্রবেশাধিকার দেওয়া হচ্ছে না, তখন এই টুর্নামেন্ট ফুটবলের উৎসব হতে পারে না।’

বিশ্বকাপ ট্রফি। আগামী বছর জুনে শুরু হবে বিশ্বকাপ
রয়টার্স

ফিফার অবস্থান কী

ইরান ও হাইতির দর্শকদের বিষয়ে ফিফা এখন পর্যন্ত সুস্পষ্ট কোনো অবস্থান জানায়নি। এ বিষয়ে জানার জন্য ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে প্রশ্ন পাঠিয়েছিল স্প্যানিশ দৈনিক দিয়ারিও এএস। জিজ্ঞেস করা হয়েছিল ট্রাম্প প্রশাসন ও ফিফা ইরান ও হাইতি থেকে দর্শকদের তাদের দলের খেলা দেখার সুযোগ করে দিতে কোনো ব্যবস্থা নেবে কি না। কিন্তু ফিফা কোনো জবাব দেয়নি।

ফিফা পাসে কি সমাধান

ট্রাম্প প্রশাসন জানিয়েছে, যেসব দর্শক টিকিট কিনবেন, তাঁদের ভিসা প্রক্রিয়া সহজতর করার জন্য ফিফা পাসের ব্যবস্থা করা হবে। ফিফা পাস হচ্ছে ‘প্রায়োরিটি অ্যাপয়েন্টমেন্ট শিডিউলিং সিস্টেম’।

টিকিট ক্রেতা সুনির্দিষ্ট ফর্মে আবেদন করলে ভিসা আবেদনগুলো আলাদাভাবে প্রক্রিয়া করা হবে। এই আবেদনকারীদের ভিসার বিষয়টি ৬০ দিনের কম সময়ে সম্পন্ন করা হবে, যা সচরাচর দীর্ঘ সময় লাগে। বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে কনস্যুলেটে ৪৫০ জন অতিরিক্ত স্টাফ নিয়োগ দেওয়ার কথাও জানিয়েছেন জিউলিয়ানি।

এতে স্পষ্ট, টিকিটধারী ভিসা আবেদনকারীদের বিষয়টি আলাদাভাবে দেখবে যুক্তরাষ্ট্র। ইরান ও হাইতির দর্শকদের জন্য বিশ্বকাপের ক্ষেত্রে শিথিলতা দেখানো হলে এই প্রক্রিয়াই অনুসরণ করা হতে পারে বলে অনেকের ধারণা।

কিন্তু এ বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা, এখন পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। সবচেয়ে বড় বিড়ম্বনা, বিশ্বকাপের আয়োজক কর্তৃপক্ষ ফিফাই এখন পর্যন্ত জানে না দুই দেশের দর্শকদের নিয়ে তারা শেষ পর্যন্ত কী করবে।

আরও পড়ুন