লেভারকুসেন: ফুটবল মাঠে অসম্ভবকে সম্ভব করেছে যারা

হফেনহেইমের বিপক্ষের শেষ মুহূর্তের গোলে জয়ের পর খেলোয়াড়দের সঙ্গে লেভারকুসেন কোচ জাবি আলোনসোর উদ্‌যাপনএএফপি

সে অনেক বছর আগের কথা, যখন ফুটবলকে মনে করা হতো পাগল-ছাগলের খেলা। খোদ রিভার প্লেটের মতো ক্লাবের সঙ্গেই জড়িয়ে ছিল ফুটবল নিয়ে এমন ধারণা। ফুটবল অবশ্য তখনো ছিল বিকাশের পর্যায়ে। নানা দিক থেকে এলোমেলো ঢেউ এসে বদলে দিচ্ছিল এর গতিপথ। ম্যানচেস্টারের কাপড় থেকে মুক্তবাণিজ্য অর্থনীতি—সবকিছুই খেলাটাকে নিজের মতো আকার দিতে শুরু করে।

যেমন বুয়েনস এইরেস এবং মন্তেভিদিওতে ফুটবলের আগমন নাকি জাহাজিদের পায়ে করে। অর্থাৎ নদী-নালা আর খাল-বিল দিয়ে ফুটবলের আগমন ঘটে এমন একটি অঞ্চলে, যারা ফুটবল খেলার মানেই বদলে দিয়েছে। তখন পর্যন্ত ফুটবল ছিল নিছকই একটি খেলা। আনন্দ দান এবং আনন্দ লাভই ছিল সেখানে শেষ কথা।

আরও পড়ুন

ফুটবল অবশ্য শেষ পর্যন্ত আনন্দ দেওয়া–নেওয়ার সরল সংজ্ঞায় আটকে থাকেনি। করপোরেট পুঁজির বিকাশের সঙ্গে ফুটবল কর্দমাক্ত মাঠ পেরিয়ে ঠাঁই নেয় হাইরাইজ বিল্ডিংয়ের ড্রেসিংরুমে। যাকে বলা হয়েছে, নন্দন থেকে বন্ধনের দিকে যাত্রা। এ যাত্রায় ফুটবল প্রতিনিয়িত নতুন নতুনভাবে শৃঙ্খলিত হয়েছে। নানা নিয়ম এবং শাসনের চোখরাঙানি ফুটবলকে একপর্যায়ে পরীক্ষাগারের গিনিপিগে পরিণত করে। এরপর মধ্যপ্রাচ্যের পেট্রো-ডলারের ঝনঝনানি ফুটবল নান্দনিকতার কফিনে ঠুকে দিয়েছে শেষ পেরেকটিও। গত কয়েক বছরে যা চূড়ান্ত রূপ ধারণ করেছে।

এর মধ্যে সবচেয়ে বড় যে ক্ষতিটা হয়েছে ফুটবলে আকস্মিক সৌন্দর্যের পথটুকু একরকম বন্ধই হয়ে গেল। বড়-ছোটর ব্যবধানটা এতই বেড়েছে যে ২০ বা ১৮ দলের লিগকে অর্থনৈতিক কাঠামোর ভেতর দিয়েই তিন বা চারভাগে ভাগ করে ফেলা যায়। তবে এ পার্থক্য শুধু অর্থনৈতিক নয়, সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক ব্যবধানটাও এখানে প্রকট। তাই এখানে প্রলেতারিয়ত বলতে সাংস্কৃতিকভাবে প্রান্তে নির্বাসিত দলও নাকি বোঝায়। এই দলগুলোর অনেকের হয়তো অর্থ আছে, কিন্তু জয়ের সংস্কৃতি বা সাফল্যের মানসিকতাটুকুই গড়ে উঠেনি। এখানে তথাকথিত ছোটরা বড়দের হুটহাট হারায় বটে, তবে শুধুই আরেকটি বড় ক্লাবকে সুবিধা করে দিতে। আসল লড়াইয়ে সে অংশ নিতে পারে কদাচিৎ।

আলোনসোই বদলে দিয়েছেন লেভারকুসেনকে
রয়টার্স

গত এক দশকে ইউরোপে শীর্ষ ৫ লিগের রোল অব অনারের দিকে তাকালেই চিত্রটা অনেক বেশি স্পষ্ট হবে। এ সময়ে প্রিমিয়ার লিগে লেস্টারের রূপকথা এবং সিরি ‘আ’তে নাপোলির ফিরে আসা এবং লিগ ‘আঁ’তে লিলের একটি শিরোপা জয় ছাড়া তথাকথিত ছোট দলগুলোর বিশেষ কোনো চমকই ছিল না। তবে এর মধ্যে পরিস্থিতি, শক্তিমাত্রা এবং ইতিহাসের ধুলার কারণে আলাদাভাবে বলা যায় কেবল লেস্টারের কথা। আর এবার সেই একই চিত্র ফিরিয়ে এনেছে লেভারকুসেন

জাবি আলোনসোর এই দলটি ফুটবলকে যেন বড়লোকের ডাইনিং থেকে ধুলামাটির রাজ্যে ফিরিয়ে এনেছে। তবে অতীতে লেভারকুসেনের দৈন্য যতটা অর্থনৈতিক, তারচেয়ে বেশি সাংস্কৃতিক। এটি মূলত ওয়ার্ক টিম (ফ্যাক্টরি বা কোম্পানির মালিকানাধীন ক্লাব)। যাদের প্রতিপক্ষ সমর্থকেরা কটাক্ষ করে প্লাস্টিক টিম বলেও ডাকেন। মূলত ফুটবলীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যহীনতার কারণে এটি ডাকা হয়।

আরও পড়ুন

রাইন নদীর তীরে গড়ে ওঠা এ ক্লাবটিকে অবশ্য খোঁচা দিতে আরও একটি নামে ডাকা হয়— ‘নেভারকুসেন’। এর কারণ, শিরোপা জিততে না পারা। ক্লাবটির সর্বশেষ শিরোপা জয়ের স্মৃতি খুঁজতে হলে ফিরে যেতে হবে ১৯৯২-৯৩ সালে। সেবার জার্মান কাপের শিরোপা জিতেছিল দলটি। এ ছাড়া ১৯৮৭-৮৮ মৌসুমে উয়েফা কাপের (ইউরোপা লিগ) শিরোপা জেতা। বুন্দেসলিগায় ৫ বার রানার্সআপ হলেও কখনো শিরোপা জেতা হয়নি দলটির।

সেই ইতিহাসকেই এবার মাটিচাপা দিতে যাচ্ছে তারা। বায়ার্ন মিউনিখের ১১ বছরের রাজত্বে ধস নামিয়ে প্রথমবারের মতো লিগ শিরোপা জয়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে আলোনসোর জাদুর ছোঁয়ায় বদলে যাওয়া দলটি। তবে লেভারকুসেন শুধু জিতছেই না, রীতিমতো ফুটবলের ইতিহাসটাকেই যেন নতুন করে লিখছেন। সর্বশেষ গতকাল রাতে হফেনহেইমের বিপক্ষে শেষ মুহূর্তে ২–১ গোলের ঘুরে দাঁড়ানো জয়ে অপরাজেয় যাত্রাকে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ৩৯ ম্যাচে নিয়ে গেছে তারা। লিগে ২৭ ম্যাচ শেষে লেভারকুসেনের পয়েন্ট এখন ৭৩।

চলতি মৌসুমে এখন পর্যন্ত কোনো ম্যাচে হারেনি লেভারকুসেন
এএফপি

একই রাতে বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের কাছে বায়ার্নের হারের পর এখন শিরোপা জয় থেকে মাত্র ৯ পয়েন্ট দূরে অবস্থান করছে লেভারকুসেন। অর্থাৎ হাতে থাকা ৭ ম্যাচের মাত্র তিনটিতে জিতলেই ট্রফি উঠবে লেভারকুসেনের হাতে। যে আত্মবিশ্বাসকে সঙ্গী করে লেভারকুসেন ছুটছে, এটুকু পথ পাড়ি দিতে না পারাটা হবে অষ্টম আশ্চর্যের মতোই কিছু একটা। এমনকি বায়ার্ন কোচ টমাস টুখেলও শিরেপা রেস থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমার কাছে আর কোনো আশা নেই। আজকের ম্যাচের পর আমার কিছু না বললেও চলবে। এখন আমরা কত পয়েন্টে পিছিয়ে আছি? ১৩? অভিনন্দন লেভারকুসেন।’

ঘুরে দাঁড়ানোর জয়ের সঙ্গে কোচ আলোনসোর থেকে যাওয়ার ঘোষণা নিশ্চিতভাবে দলের মানসিকতাকে আরও ইস্পাতদৃঢ় করে তুলবে, যা ইউরোপা লিগ এবং জার্মান কাপের শিরোপা জয়ের পথেও দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করবে দলটিকে। এমনকি লিগে তো বটেই, সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ট্রেবল জিতে মৌসুমজুড়ে ‘ইনভিনসিবল’ থেকে যাওয়ার বিরল কীর্তি গড়ার সুযোগও এখন দলটির সামনে।

আরও পড়ুন

লেভারকুসেনের এমন বদলে যাওয়ার নৈপথ্যে নায়ক কিন্তু সেই আলোনসোই। কোচিংয়ে নামমাত্র অভিজ্ঞতা নিয়ে যিনি লেভারকুসেনের ডাগআউটে এসেছিলেন। অখ্যাত এবং স্বল্প পরিচিত কিছু খেলোয়াড়কে নিয়ে অবনমনের শঙ্কায় কাঁপতে থাকা একটি দলকে এগিয়ে নেওয়ার চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন। সেই লোকটিই এখন ফুটবল সংস্কৃতিতে প্রান্তে নির্বাসিত ক্লাবটিতে রীতিমতো বিপ্লব নিয়ে এসেছেন। আলোনসো এমন কিছু করছেন, যা হয়তো ক্লাবের অন্ধভক্তরাও ভাবতে পারেননি। আলোনসোর এই দল যা করছে বা করেছে, তা হয়তো রূপকথার গল্প লেখকের কাছেও আকাশ-কুসুম মনে হতে পারে। মৌসুমের শুরুতে কেউ যদি লেভারকুসেনের অপরাজিত শিরোপা জেতার সম্ভাবনার কথা বলত, তাঁকে নিয়ে নিশ্চয় তুমুল ট্রল করা হতো।

কিন্তু ফুটবল এমনই! এই খেলাটিতেই সম্ভব আকাশকুসুম স্বপ্নের বাস্তবায়ন। এ জন্যই বোধ হয় ফুটবলকে বলা হয়, ‘দ্য গ্রেট ইকুলাইজার’। সমস্ত তথ্য, উপাত্ত, সুপারকম্পিউটার এবং নিক্তি যখন ভিন্ন কিছুর ইশারা দিতে থাকে, তখন বিপরীতে দাঁড়িয়ে ভরকেন্দ্রের ভিত নাড়িয়ে দেওয়াই তার কাজ। তবে এমন মিরাকল প্রতি মৌসুমে ঘটে না। ফুটবল রোমান্টিকরা এমন মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করেন বছরের পর পর।

আরও পড়ুন

কোনো একদিন খুব ভোরে ঘুম ভাঙা গানের সঙ্গে ভাগ্যদেবী অর্ঘ্য নিয়ে হাজির হন অখ্যাত কোনো ক্লাবের দুয়ারে। রূপকথার আশ্চর্য এক আলাদিনকে তিনি দিয়ে যান পুরো একটি মৌসুমের জন্য। আর পরবর্তী ১০ মাসে লেখা হতে থাকে বহু বছর ধরে বুভুক্ষের মতো শিরোপা-স্বাদ পেতে লালায়িত থাকা দলটির নতুন একটি গল্প। যে গল্পের শেষ লাইনে গিয়ে অমর হয়ে যায় লেস্টার এবং লেভারকুসেনের মতো সারাজীবন মার খেতে থাকা এবং গ্লানি বয়ে বেড়ানো দলটি। হতে পারে এক মৌসুমের জন্য। কিন্তু সমস্ত প্রতিবন্ধকতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে যে দৃষ্টান্ত তারা রেখে যায়, তা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বহু বছর পর ফিনিক্সের মতো জেগে উঠবে আরও একটি অখ্যাত দল।