ম্যারাডোনাকে মনে করিয়ে দেওয়া ‘মাকড়সা’ আলভারেজের গোল

ম্যাচের ৩৯ মিনিটে যে গোলটা করলেন হুলিয়ান আলভারেজ, সেটা কি ডিয়েগো ম্যারাডোনাকে মনে করিয়ে দিল কিছুটা?

তুলনাটা বাড়াবাড়ি বলবেন অনেকেই। কোথায় অনেকের চোখে সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়ের পা থেকে আসা প্রায় সবার মতে সর্বকালের সেরা গোল, আর কোথায় ২২ বছরের এক তরুণের আজকের গোল!

হ্যাঁ, বাড়াবাড়িই। সেটা ম্যারাডোনা নামটার কারণে, ১৯৮৬ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বিখ্যাত ওই গোলের মাহাত্ম্যের কারণে এবং শেষ পর্যন্ত আর্জেন্টিনা ওই বিশ্বকাপটা জিতেছিল বলেই।

তবে একবার চোখ বন্ধ করে মঙ্গলবার লুসাইলের সেমিফাইনালে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে আর্জেন্টিনার দ্বিতীয় গোলটার কথা ভাবুন তো। কিংবা ইউটিউবে ঢুকে রিপ্লেও দেখে নিতে পারেন। দেখার পর সবার আগে কি আপনার ম্যারাডোনার করা সর্বকালের সেরা সেই গোলের কথাই মনে হচ্ছে না?

মাঝমাঠেরও নিচে নিজেদের সীমানায় পাওয়া বল নিয়ে দৌড় শুরু করেছিলেন আলভারেজ। পেছনে তিন ক্রোয়াট ডিফেন্ডার ছুটছিলেন ধাওয়া করে, সামনে আরও একজন। কাউকেই পাত্তা দিলেন না, একেবারে বক্সের ভেতর যাওয়ার পর এক ডিফেন্ডারের বাধায় বলের নিয়ন্ত্রন একটু ছুটে গিয়েছিল, সঙ্গে সঙ্গেই সেটা আবার পায়ে নিয়েছেন। তারপর আরেক ডিফেন্ডার বোরনা সোসাকে অবিশ্বাস্যভাবে কাটিয়ে গোলরক্ষকের মুখের সামনে দিয়ে শট জালে। এ রকম বাহাদুরি এই বিশ্বকাপে আর কে দেখিয়েছে! মনে রাখার মতো বেশ কিছু গোল দেখেছে এবারের বিশ্বকাপ। কিন্তু সেমিফাইনালের মঞ্চে ক্রোয়েশিয়ার মতো বলের দখল রাখা দলের বিপক্ষে মাঠের মাঝ দিয়ে একলা দৌড়ে এভাবে গোল দিয়ে আসা, এটাকে সেরা গোলের তালিকায় সবার উপরে না রাখলে অন্যায় ভাবতে পারেন অনেকেই।

গোলের পর আলভারেজের উদযাপন
রয়টার্স

অনেকদিন ধরেই আর্জেন্টিনা এমন একজন স্ট্রাইকারকে খুঁজছিল যিনি মেসি বা অন্য কারও বানিয়ে দেওয়া গোলগুলি ঠিকঠাক জালে পাঠাবেন। গঞ্জালো হিগুয়েইন হবেন না। এই বিশ্বকাপে সেই দায়িত্বটা প্রথমে পেয়েছিলেন লাওতারো মার্তিনেজ। কিন্তু সৌদি আরবের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে তিনি এত মিস করলেন, যে বোঝা গেল, লাওতারোকে দিয়ে হবে না। হুলিয়ান আলভারেজ মঞ্চে এলেন সেই সুযোগে।

আরও পড়ুন

গ্রুপে পোল্যান্ডের বিপক্ষে যে ম্যাচে জয় ছাড়া অন্য কিছু ভাবার সুযোগ ছিল না আর্জেন্টিনার, ওই ম্যাচে প্রথম গোল পান আলভারেজ। শেষ ষোলোতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে পান দ্বিতীয়টা। প্রত্যাশা বেড়ে যায় এরপরই, হয়ে যান একাদশে স্ট্রাইকার হিসেবে আর্জেন্টিনার কোচ লিওনেল স্কালোনির প্রথম পছন্দ।

একটা সন্দেহ তারপরেও ছিল। বয়স মাত্র ২২, ইউরোপ চিনেছেন মাত্র কয়েকমাস হলো। এই বছর জুলাইয়ে রিভারপ্লেট থেকে ম্যানচেস্টার সিটিতে যোগ দেওয়ার পর খেলেছেন মাত্র ১২টি ম্যাচ, যেগুলোর বেশিরভাগই বদলি হিসেবে। বিশ্বকাপে খেলছেন এই প্রথমবার, এর আগে আর্জেন্টিনার হয়েও খুব বেশি খেলার অভিজ্ঞতা নেই। বদলি নেমে-টেমে সব মিলিয়ে ১২টা ম্যাচ খেলেছিলেন। এমন একটা ছেলের উপর এত বড় দায়িত্ব!

মেসি-আলভারেজের উদযাপন
টুইটার

কিন্তু আলভারেজ এসব সন্দেহ কী দারুণভাবেই না দূর করে দিলেন! তিনি যে হিগুয়েইন হতে আসেননি, সেটা বুঝিয়ে দিয়েছেন বিশ্বকাপের এই কয়টা ম্যাচেই। গোলের জন্য কখন কোথায় থাকতে হবে সেটা তো জানেনই, মেসির অবিশ্বাস্য পাস থেকে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে নিজের দ্বিতীয় গোলটা করে সেটার প্রমাণও দিয়েছেন। তবে তার আগে ‘ওয়ান ম্যান শো’র ওই প্রথম গোলে দেখিয়েছেন তিনি একাই যথেষ্ট যেকোনো রক্ষন উলট-পালট করে দিতে।

তার মতো বয়সে এ রকম গতি থাকবে এটাই স্বাভাবিক, তবে আলভারেজ গতির সঙ্গে আছে দারুণ ড্রিবলিংয়ের ক্ষমতাও। খুব ছোটবেলা থেকেই বলের সঙ্গে তাঁর পায়ের সখ্যতা। ছোটবেলায় খেলার সময় এত বেশি সময় বল পায়ে রাখতেন যে মনে হতো দুই পা নয়, মাকড়সার মতো আট পা দিয়ে খেলছেন আলভারেজ। রিভারপ্লেটের বয়সভিত্তিক দলে থাকতেই তাই তাঁর নাম হয়ে যায় ‘লা আরানা’ বা মাকড়সা। এখনো সেই নামটা আছে, জাতীয় দলের সতীর্থরা অনেকেই তাঁকে ওই নামে ডাকেন, ডাকে আর্জেন্টাইন সংবাদমাধ্যমও।

মেসি খুশি, আলভারেজ খুশি, খুশি আর্জেন্টিনাও
টুইটার

সেই মাকড়সার শরীরে সম্ভবত মঙ্গলবার রাতে ম্যারাডোনাই ভর করেছিলেন। হয়তো সে কারণেই ‘আর্জেন্টাইন ঈশ্বর’কে মনে করিয়ে দেওয়া ওই গোলটা এসেছে আলভারেজের পা থেকে। যে গোল আর্জেন্টিনাকে এগিয়ে দিয়েছে ৮ বছর পর আরও একটা বিশ্বকাপ ফাইনালের পথে।

১৮ ডিসেম্বরের ফাইনালেও আরও একবার আলভারেজের কাছে গোল চাইবে আর্জেন্টিনা। ম্যারাডোনার মতো এমন গোল না হোক, আর্জেন্টিনাকে জেতানোর মতো কোনো গোল হলেই হবে।

আরও পড়ুন