বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলে বিদেশি ফুটবলাররাও যখন ‘দেশি‘

ঘরোয়া ফুটবলের নতুন মৌসুমের খেলোয়াড় নিবন্ধন শেষ হচ্ছে আজ। গতকাল পর্যন্ত সার্কভুক্ত দেশের ছয় ফুটবলারকে নিশ্চিত করেছে তিনটি ক্লাব।

নেপাল জাতীয় দলের গোলরক্ষক ও অধিনায়ক কিরণ চেমজংকে দলে টেনেছে বাংলাদেশ পুলিশ এফসিকিরণের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট

বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলে যুক্ত হলো নতুন এক অধ্যায়। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সার্কভুক্ত দেশগুলোর ফুটবলাররা ‘দেশি’ খেলোয়াড় কোটায় খেলতে পারবেন। অর্থাৎ, তাঁরা বিদেশি হিসেবে গণ্য হবেন না। তাতে একদিকে ক্লাবগুলোর শক্তি বাড়বে, অন্যদিকে ফুটবলারদের মধ্যেও তৈরি হবে নতুন প্রতিযোগিতা। তবে শেষ পর্যন্ত কতজন দক্ষিণ এশীয় ফুটবলার নাম লেখাবেন বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলে, তার হিসাব মিলবে আজ ফুটবলারদের নিবন্ধন শেষ হলে।

গতকাল পর্যন্ত এ মৌসুমের জন্য ছয়জন সার্কভুক্ত ফুটবলারের বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলে খেলা নিশ্চিত হয়েছে। আজ শেষ দিনে নাটকীয় কিছু না হলে সংখ্যাটা ছয়ই থাকার সম্ভাবনা বেশি। ছয়জনই সংশ্লিষ্ট দেশের জাতীয় দলের ফুটবলার, তাঁদের মধ্যে দুজন গোলকিপার। বাংলাদেশ পুলিশ এফসিতে নেপালের দুজন ও ভুটানের একজন, ফর্টিস এফসিতে শ্রীলঙ্কা ও নেপালের দুজন এবং রহমতগঞ্জ নেপালের একজনকে চূড়ান্ত করেছে।

ফকিরেরপুল ইয়ংমেনস কলকাতার এক গোলকিপারের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও শেষ পর্যন্ত তাঁকে আনার সম্ভাবনা কম। নবাগত পিডব্লিউডি নেপালের এক খেলোয়াড়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে, তবে ওই খেলোয়াড় তাঁর সংস্থা থেকে ছাড়পত্র পাননি। আরামবাগ চেষ্টা করছে ভারতে থেকে এক খেলোয়াড়কে আনতে, যদিও তাঁকে পাওয়া অনিশ্চিত।

শ্রীলঙ্কার গোলকিপার সুজান পেরেরা
ফেসবুক

সার্কভুক্ত দেশের খেলোয়াড় হিসেবে সবার আগে শ্রীলঙ্কা জাতীয় দলের অধিনায়ক ও অভিজ্ঞ গোলকিপার সুজান পেরেরাকে নিশ্চিত করেছে ফর্টিস এফসি। তার মানে তিন যুগ পর আবারও বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলে দেখা যাবে শ্রীলঙ্কান ফুটবলার। জাতীয় দলের হয়ে ৫৬ ম্যাচ খেলা ৩২ বছর বয়সী পেরেরা সর্বশেষ খেলেছেন মালদ্বীপের টিসি স্পোর্টস ক্লাবে। ফর্টিসের আরেকজন সার্কভুক্ত দেশের ‘দেশি’ খেলোয়াড় নেপাল জাতীয় দলের ডিফেন্ডার অনন্ত তামাং। দুজনেরই ২২ আগস্ট ঢাকায় আসার কথা।

আরও পড়ুন

বাংলাদেশের ফুটবলে একসময় নিয়মিত খেলতেন শ্রীলঙ্কানরা। লায়নেল পিরিচ, চন্দ্র সিঁড়ি ছিলেন আবাহনীর গোলপোস্টের নিচে। পাকির আলী, প্রেমলাল, মাহেন্দ্র পালা, অশোকা রবীন্দ্রদের মতো লঙ্কানরাও দর্শকদের মুগ্ধ করেছেন। সর্বশেষ শ্রীলঙ্কান হিসেবে পাকির আলী আবাহনীতে খেলেছেন ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত। দীর্ঘ বিরতির পর এবার আসছেন সুজান পেরেরা।

বাংলাদেশ আর সার্কভুক্ত দেশের ফুটবলের মানে তেমন পার্থক্য নেই, এর ফলে এত বেশি সার্কভুক্ত খেলোয়াড় আনা দেশের ফুটবলের জন্য ভালো ফল আনবে না।
ইমতিয়াজ সুলতান জনি, মোহামেডানের টেকনিক্যাল কমিটির আহ্বায়ক ও সাবেক ফুটবলার

বাংলাদেশ পুলিশ এফসি নিয়েছে নেপাল জাতীয় দলের গোলরক্ষক ও অধিনায়ক কিরণ চেমজংকে, যিনি ভারতের সুপার লিগের অভিজ্ঞতা নিয়ে আসছেন। পুলিশে আরও নাম লিখিয়েছেন নেপাল জাতীয় দলের তরুণ ফরোয়ার্ড আয়ুশ ঘালান ও ভুটান জাতীয় দলের মিডফিল্ডার ওয়াংচুক শেরিং। ভুটান জাতীয় দলে ১০ নম্বর নিয়ে খেলেন এই মিডফিল্ডার। তিনজনই চলে এসেছেন ঢাকায়। রহমতগঞ্জ মুসলিম ফ্রেন্ডস সোসাইটি দলে ভিড়িয়েছে নেপাল জাতীয় দলের ডিফেন্ডার অভিষেক লিম্বুকে। তাঁর ঢাকায় আসার কথা ১০ সেপ্টেম্বর।

একটি ক্লাব সার্কভুক্ত দেশের খেলোয়াড় নিবন্ধন করতে পারবে সর্বোচ্চ পাঁচজন এবং এক ম্যাচে খেলাতেও পারবে পাঁচজনকেই। সার্কের বাইরে বিদেশি নেওয়া যাবে পাঁচজন, তবে মাঠে একসঙ্গে তিনজনের বেশি খেলতে পারবেন না। সব মিলিয়ে এক ম্যাচে সার্ক ও সার্কের বাইরের দেশের ফুটবলার খেলানো যাবে আটজন। অর্থাৎ, কোনো দল যদি একাদশে এভাবে আটজনই বিদেশি ফুটবলার খেলায়, তাহলে ওই দলের একাদশে স্থানীয় ফুটবলার খেলতে পারবেন মাত্র তিনজন।

সার্কভুক্ত দেশের খেলোয়াড় নেওয়ার বড় কারণ কম পারিশ্রমিক। এক হিসাবে স্থানীয় শীর্ষ ফুটবলারদের মাসিক পারিশ্রমিক যেখানে পড়ে যায় পাঁচ–ছয় লাখ টাকা বা তার বেশি, সেখানে নেপাল বা ভুটানের জাতীয় দলের খেলোয়াড় মিলছে এক–দেড়–দুই লাখ টাকায়।

সার্কভুক্ত দেশের খেলোয়াড়দের ‘দেশি’ হিসেবে খেলার সুযোগ দেওয়া নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। মোহামেডানের টেকনিক্যাল কমিটির আহ্বায়ক জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার ইমতিয়াজ সুলতান জনি বলেন, ‘বাংলাদেশ আর সার্কভুক্ত দেশের ফুটবলের মানে তেমন পার্থক্য নেই, এর ফলে এত বেশি সার্কভুক্ত খেলোয়াড় আনা দেশের ফুটবলের জন্য ভালো ফল আনবে না।’

আরও পড়ুন

ফর্টিস এফসির ম্যানেজার সাবেক ফুটবলার রাশেদুল ইসলামও বলেন একই কথা, ‘আটজন বিদেশি খেলানোর সুযোগ রাখা যুক্তিসংগত নয়, এতে জাতীয় দল ভুগতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘একটি দল সার্ক ও সার্কের বাইরের পুরো কোটা পূরণ করলে সেই দলের একাদশে বাংলাদেশের খেলোয়াড় থাকতে পারবেন মাত্র তিনজন। এভাবে ভাবলে এটা ভয়াবহ ব্যাপার। জাতীয় দলের পাইপলাইনে থাকা খেলোয়াড়েরা খেলার সুযোগ কম পাবেন।’

নেপাল জাতীয় দলের ডিফেন্ডার অনন্ত তামাং খেলবেন ফর্টিস এফসিতে
অনন্ত তামাংয়ের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট

তবে পুলিশের কোচ এস আসিফুজ্জামান বিষয়টিকে দেখছেন ভিন্নভাবে, ‘স্থানীয়দের সুযোগ কমছে ঠিকই, কিন্তু বৃহত্তর দিক থেকে এটা ভালো। নেপাল-ভুটানের ফুটবলাররা খেললে লিগের মান বাড়বে। শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটানের প্রচুর দর্শক বাংলাদেশের লিগ দেখবে। এরই মধ্যে ওদের পত্রিকায় আমাদের লিগের খবর ছাপা শুরু হয়েছে, যেটা ইতিবাচক।’

সার্কভুক্ত দেশের খেলোয়াড় নেওয়ার বড় কারণ কম পারিশ্রমিক। এক হিসাবে স্থানীয় শীর্ষ ফুটবলারদের মাসিক পারিশ্রমিক যেখানে পড়ে যায় পাঁচ–ছয় লাখ টাকা বা তার বেশি, সেখানে নেপাল বা ভুটানের জাতীয় দলের খেলোয়াড় মিলছে এক–দেড়–দুই লাখ টাকায়। রহমতগঞ্জের সভাপতি টিপু সুলতানের মতে, পারিশ্রমিক কম হলেও মানে তাঁরা বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের চেয়ে কোনো অংশে পিছিয়ে নেই।

এবার মৌসুম শুরু হবে ১২ সেপ্টেম্বর চ্যালেঞ্জ কাপের ফাইনাল দিয়ে, লিগ মাঠে গড়াবে ১৯ সেপ্টেম্বর।