ক্লাব ফুটবলে একটি করে ম্যাচ যায় আর ফুটবলাররা যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন, একটুখানি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন! অথচ একজন ফুটবলারকে ক্লাবই তিলে তিলে গড়ে তোলে, তাঁকে তারকা বানায়। তাহলে হঠাৎ ক্লাবের হয়ে খেলতে নেমে ফুটবলারদের এত ভয় কেন?
কারণ একটাই—দুয়ারে কড়া নাড়ছে কাতার বিশ্বকাপ। দেশকে বিশ্ব মঞ্চে প্রতিনিধিত্ব করার চেয়ে বড় গৌরব, সম্মান ও প্রাপ্তি আর কিছু হতে পারে না। কিন্তু ক্লাবের হয়ে খেলার সময় চোটে পড়ে বিশ্বকাপ-স্বপ্ন শেষ হয়ে যাচ্ছে একের পর এক তারকা খেলোয়াড়ের।
এন’গোলো কান্তে, পল পগবা, দিয়োগো জোতা, টিমো ভেরনার, মার্কো রয়েস, জর্জিনিও ভাইনালডাম, রিস জেমস, ফিলিপে কুতিনিও, জিওভানি লো সেলসো—ক্লাবের হয়ে খেলতে গিয়ে তারকা ফুটবলারদের চোটে পড়ার তালিকাটা শুধু বড় হচ্ছে। সেই চোট বিশ্বকাপে তাঁদের দর্শক বানিয়ে দিচ্ছে।
বিশ্বকাপের আগমুহূর্তে ফুটবলারদের এই চোটের মিছিলে সর্বশেষ নাম সাদিও মানে। জার্মান বুন্দেসলিগায় মঙ্গলবার রাতে ভেরদার ব্রেমেনের বিপক্ষে ম্যাচের ১৫ মিনিটেই হাঁটুতে আঘাত পেয়ে মাঠ ছাড়েন বায়ার্ন মিউনিখ ফরোয়ার্ড।
প্রাণভোমরার চোটের খবর ছড়িয়ে পড়তেই সেনেগাল যেন এক শোকস্তব্ধ দেশে পরিণত হয়েছিল। এ ঘটনায় খোদ দেশটির প্রেসিডেন্ট ম্যাকাই সাল টুইটারে লিখেছিলেন, ‘সাদিও, একটা সিংহের হৃদয়! তোমার প্রতি আমার পূর্ণ সমর্থন আছে।’ চোট নিয়ে মানে মাঠ ছাড়ার পর আফ্রিকান ফুটবলের নিবিড় অনুসারী ঘানাইয়ান ক্রীড়া সাংবাদিক রহমান ওসমানের টুইট, ‘ডাকার (সেনেগালের রাজধানী) আজ রাতে ঘুমাতে পারবে না।’
একজন খেলোয়াড় কতটা গুরুত্বপূর্ণ হলে পুরো দেশ বিমূঢ় হতে পারে, মুহূর্তেই আবেগ ছড়িয়ে পড়তে পারে; মানে সেটার জ্বলন্ত উদাহরণ। টিবিয়ার (পায়ের হাড়) ওপরের অংশে পাওয়া চোটের সঙ্গে লড়াই করতে থাকলেও মানেকে রেখেই আজ বিকেলে বিশ্বকাপের দল ঘোষণা করেছেন সেনেগাল কোচ আলিউ সিসে।
তবে বিশ্বকাপের শুরু থেকে তাঁকে পাওয়া যাবে কি না, সেটা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে। টুর্নামেন্ট শুরুর দ্বিতীয় দিনেই (২১ নভেম্বর) যে সেনেগালের ম্যাচ! সাংবাদিক রহমান ওসমান বোধ হয় সেটা আঁচ করতে পেরে আবারও টুইট করেছেন, ‘যখন আপনি কাউকে ছাড়া বাঁচতে পারবেন না, তখন যেকোনো পরিস্থিতিতে তাকে নিজের সঙ্গে রাখতে চাইবেন।’ অথচ মে বা জুনে বিশ্বকাপ শুরু হলে পুরো ফিট হয়েই মাঠে নামতে পারতেন মানে। কিন্তু প্রথা ভেঙে এবারের আসর বসছে নভেম্বরে।
কাতারকে বিশ্বকাপ আয়োজনের সুযোগ দেওয়ার পর থেকেই সমালোচনার মুখে পড়েছে ফিফা। দুর্নীতির (বিপুল অর্থ দিয়ে আয়োজন স্বত্ব বাগিয়ে নেওয়া) অভিযোগ তো আছেই, আরও যত কারণে মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে ফুটবল মহাযজ্ঞ চাননি ক্রীড়া অনুরাগীরা, সেসবের একটি ‘অসময়ে আয়োজন’। সময়টা যে ক্লাব ফুটবলের সঙ্গে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক।
যুগের পর যুগ ধরে ক্লাব ফুটবলের মৌসুম শেষে শুরু হয়েছে বিশ্বকাপ। ‘চিরন্তন’ সেই রীতি ভেঙে এবার সেটা হচ্ছে মৌসুমের মাঝপথে। এ অবস্থায় ‘নাছোড়বান্দা’ ক্লাবগুলোও চটজলদি খেলোয়াড় ছাড়তে নারাজ। ২০ নভেম্বর শুরু কাতার বিশ্বকাপ। অথচ ১৩ নভেম্বর রাতেও রাখা হয়েছে ঘরোয়া লিগের ম্যাচ।
দুই টুর্নামেন্টের মাঝে ব্যবধান এক সপ্তাহের কম। খেলোয়াড়েরা ক্লাব ছাড়বেন কখন, জাতীয় দলের সঙ্গে যোগ দেবেন কখন আর শিষ্যদের নিয়ে কোচরা রণকৌশলই বা সাজাবেন কখন? বিশ্বকাপ-পূর্ব ক্যাম্প তো দূরের কথা, দম ফেলারও ফুসরত নেই। এসবের মধ্যেই চোটের সঙ্গে লড়াই করে জেতা কি আদৌ সম্ভব? সে কারণেই ফুটবলারদের এখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা।
গত রাতে রিয়াল মাদ্রিদ-কাদিজ ম্যাচ দিয়ে বিশ্বকাপ বিরতিতে গেছে স্প্যানিশ লা লিগা। ২-১ ব্যবধানে জয়ের সুখস্মৃতি নিয়েই অবশ্য কাতারে যেতে পারছেন বিশ্বকাপ দলে থাকা রিয়ালের ফুটবলাররা। ওই ম্যাচ শেষে ফুটবলারদের মনে কতটা স্বস্তির বাতাস বইয়ে যাচ্ছে, তা ভিনিসিয়ুস জুনিয়রের এই টুইটেই অনুভব করা যায়, ‘সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ, চোট ছাড়াই আরেকটি ম্যাচ শেষ করতে পারলাম। শিগগিরই দেখা হবে, মাদ্রিদিস্তা!’ ম্যাচের একটা পর্যায়ে মনে হয়েছে খেলতে নয়; বরং রিয়াল খেলোয়াড়দের বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে দেওয়ার মিশনে নেমেছে কাদিজ। ব্রাজিলিয়ান তারকা ভিনিসিয়ুসকে নিজেদের লক্ষ্য বানিয়ে ফেলেছিলেন প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়েরা।
খেলোয়াড় হারানোর এই ‘ছোঁয়াচে রোগ’ পেপ গার্দিওলার মনেও উদ্রেক সৃষ্টি করেছে। ম্যানচেস্টার সিটির কোচ বলেছেন, ‘সামনে পাগলাটে এক বিশ্বকাপ; অথচ ছেলেরা বিশ্রাম নিতে পারছে না।’
ঘরের মাঠ ইতিহাদ স্টেডিয়ামে আগামীকাল সন্ধ্যায় ব্রেন্টফোর্ডের বিপক্ষে খেলবে সিটিজেনরা। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের এ ম্যাচ শেষে বিশ্বকাপ বিরতিতে যাবে শিরোপাধারী ক্লাবটি। কিন্তু গার্দিওলার মনে হচ্ছে শিষ্যদের দেহটা ক্লাবে থাকলেও মন পড়ে আছে কাতারে, ‘এই মুহূর্তে ব্রেন্টফোর্ড ম্যাচ নিয়ে ভাবার কথা। কিন্তু খেলোয়াড়ের নজর বিশ্বকাপে। ওরা ভাবছে, কী হবে যদি ব্রেন্টফোর্ড ম্যাচে চোটে পড়ি? নির্ঘাত বিশ্বকাপ মিস করতে যাচ্ছি। তাই প্রিমিয়ার লিগের শিরোপাও এখন ঠুনকো হয়ে গেছে। এ ম্যাচের ফল যা-ই হোক, কিচ্ছু আসে যায় না। ভেবে দেখুন, শনিবার ওরা আমার সঙ্গে থাকবে, রোববারেই জাতীয় দলের সঙ্গে।’
ক্লান্তি নিয়েই এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে যাচ্ছেন খেলোয়াড়েরা। এর আগে ৪২ দিনের ব্যবধানে ১৩ ম্যাচ খেলেছেন দলের অপরিহার্য সদস্যরা। চ্যাম্পিয়নস লিগ-ইউরোপা লিগে খেলা ক্লাবগুলোকে তো পুরো ইউরোপ চষে বেড়াতে হয়েছে।
ভ্রমণের সময়টুকুও হিসাব করলে আড়াই দিনের ব্যবধানে একটা করে ম্যাচ খেলতে হয়েছে ফুটবলারদের। সোমবার ‘পুঁচকে’ রায়ো ভায়েকানোর কাছে হারের পর রিয়াল কোচ কার্লো আনচেলত্তি তাই শিষ্যদের ধকল সইতে না পারার বিষয়টি সামনে এনেছেন, ‘আমরা বিরামহীনভাবে খেলেই চলেছি। খেলোয়াড়েরা সত্যিই ভীষণ ক্লান্ত।’
টটেনহামের সহকারী কোচ ক্রিস্টিয়ান স্টেলিনিও আনচেলত্তির সুরে সুর মিলিয়েছেন, ‘আমি বহু ম্যাচ দেখেছি। কিন্তু বিশেষ একটি মাসে এসে বেশির ভাগ দলকেই আকর্ষণীয় ফুটবল উপহার দিতে দেখিনি। আসলে আমরা অতিরিক্ত ম্যাচ খেলছি।’
কাতারের প্রতি বিরাগ থেকেই হয়তো ইউরোপীয় ক্লাবগুলো বিশ্বকাপ শুরুর এক সপ্তাহ আগেও খেলোয়াড়দের আটকে রেখেছে। উয়েফার ‘কাতার পরিপন্থী’ সিদ্ধান্তে সায় দিয়েছে। পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় ‘লাভের গুড়’ খাওয়ার বিষয় তো আছেই।
কিন্তু সবকিছুতেই হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে ফুটবলারদের। ফুটবল সংস্থাগুলো নিজেদের সুবিধার কথা ভাবতে গিয়ে ক্ষতি করছে খেলোয়াড়দের। তাঁদের শরীরে যে কশাঘাতগুলো পড়ছে, এর দায় নেবে কে?