অবহেলার অভিযোগে ম্যারাডোনার সাত চিকিৎসকের বিচার শুরু
মহামারি চলছিল তখন পৃথিবীতে। করোনার ভয়াল থাবায় এমনিতেই ঘরে আটকে পড়েছিল মানুষ। যাঁদের ঘরে কেউ নেই, তাঁরা হয়ে পড়েছিলেন আরও নিঃসঙ্গ।
নিঃসঙ্গ ছিলেন ডিয়েগো ম্যারাডোনাও। সবে মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বাঁধার কারণে অস্ত্রোপচার করিয়ে এসেছেন। বুয়েনস এইরেসে যে বাড়িতে থাকতেন ৬০ বছর বয়সী আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি, সেখানে তাঁকে দেখভাল করার কয়েকটা লোক ছাড়া কাছের আর কেউ ছিলেন না। তাঁর চিকিৎসকেরা স্বাস্থ্যজনিত বিষয়গুলো দেখতেন নিয়মিত। এ রকম এক সময়ে ২০২০ সালের ২৫ নভেম্বর হঠাৎ ম্যারাডোনার মৃত্যুর খবর নাড়িয়ে দেয় সারা বিশ্বকে।
অসুস্থতার কারণে স্বাভাবিক মৃত্যু, নাকি অবহেলা ছিল তাঁর চিকিৎসকদের, এমন প্রশ্ন ওঠে এরপর। যে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে অবশেষে যেতে হয়েছে আদালত পর্যন্ত। শেষ দিনগুলোতে তাঁর চিকিৎসায় নিয়োজিত ছিলেন যে আটজন চিকিৎসক, তাঁদের মধ্যে সাতজনের বিরুদ্ধে চিকিৎসায় অবহেলাজনিত অপরাধের অভিযোগে বিচার শুরু হয়েছে আজ। অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাঁদের ৮ থেকে ২৫ বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে।
অভিযোগ উঠেছে, তাঁরা ম্যারাডোনার চিকিৎসাকালে এমন একটি পদক্ষেপ অনুসরণ করার জন্য দায়ী, যা তাঁর মৃত্যুর কারণ হতে পারে বলে তাঁরা অবগত ছিলেন। সূচনা বক্তব্যে ম্যারাডোনার পক্ষের কৌঁসুলি বলেছেন, তাঁরা এমন শক্ত প্রমাণ জমা দিতে চান, যাতে বোঝা যাবে, ম্যারাডোনা মৃত্যুশয়্যায় থাকাকালে চিকিৎসক দলের কেউই যা করা উচিত ছিল, তা করেননি। বুয়েনস এইরেসের সান ইসিদ্রোতে শুরু হওয়া চার মাসব্যাপী এই বিচারিক কার্যক্রমে ম্যারাডোনার পরিবার, চিকিৎসকসহ ১০০ জনের বেশি সাক্ষ্য দেবেন বলে জানা গেছে।
ম্যারাডোনার মৃত্যু মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচারের সপ্তাহ দুয়েক পর। বুয়েনস এইরেসের এক অভিজাত এলাকায় একটা ভাড়া করা বাড়িতে থাকতেন আর্জেন্টিনার ১৯৮৬ বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক ও সর্বকালের অন্যতম সেরা এই ফুটবলার। মৃত্যু হয়েছিল হার্ট অ্যাটাকে। তাঁর দেখভালের দায়িত্বে থাকা রাতের নার্স পরে বলেছেন, তিনি হার্ট অ্যাটাকের আগে ম্যারাডোনার মধ্যে কিছু ‘শঙ্কাজনক লক্ষণ’ দেখতে পেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁকে বলা হয়েছিল, ম্যারাডোনাকে যেন ‘না জাগানো’ হয়।
এই মামলায় অভিযুক্তদের একজন নিউরোসার্জন, একজন মনোরোগবিশেষজ্ঞ, একজন মনোবিজ্ঞানী, একজন মেডিকেল কো–অর্ডিনেটর, একজন নার্স কো–অর্ডিনেটর, একজন চিকিৎসক এবং রাতের পালার নার্স। দিনের বেলায় ম্যারাডোনাকে দেখভাল করতেন যে নার্স, তাঁর বিচার করা হবে আলাদাভাবে। সরকারি কৌঁসুলিরা দাবি করছেন, এই চিকিৎসক দল ম্যারাডোনাকে বাড়িতে চিকিৎসাসেবা নেওয়ার জন্য চাপ দিয়েছেন, যা ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’ এবং ‘সম্পূর্ণ অবিবেচনাপ্রসূত’ সিদ্ধান্ত। তাঁরা অভিযোগ করেছেন, মৃত্যুর আগে কিংবদন্তি এই ফুটবলারকে ‘দীর্ঘ যন্ত্রণাদায়ক সময়ের’ জন্য ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল।
২০২১ সালে আর্জেন্টিনার সরকারি কৌঁসুলিদের অনুরোধে গঠিত ২০ জন চিকিৎসকের একটি বিশেষজ্ঞ প্যানেল এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে উপযুক্ত চিকিৎসাকেন্দ্রে সুচিকিৎসা পেলে ম্যারাডোনার ‘বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেশি থাকত’। প্যানেল এটাও বলে, অস্ত্রোপচারের পর ম্যারাডোনা যে বাড়িতে ছিলেন, সেখানে হৃদ্রোগীর চিকিৎসার উল্লেখযোগ্য কোনো সুবিধা ছিল না।
ম্যারাডোনার ছেলে দিয়েগুইতোর আইনজীবী মারিও বাউড্রি বলেছেন, চিকিৎসকদের মধ্যে কথোপকথনের ফাঁস হওয়া অডিও এবং খুদে বার্তাগুলোতেই ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে তাঁরা জানতেন, ম্যারাডোনা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছেন। চিকিৎসক দলের কৌশল ছিল ম্যারাডোনার মেয়েদের এই চিকিৎসায় হস্তক্ষেপ করতে না দেওয়া; কারণ, তাঁরা (ম্যারাডোনার মেয়েরা) যদি হস্তক্ষেপ করেন, তাহলে তারা (চিকিৎসক দল) টাকা পাবে না।
অভিযুক্ত চিকিৎসকেরা সবাই অবশ্য ম্যারাডোনার মৃত্যুর দায় অস্বীকার করেছেন। মনোরোগবিশেষজ্ঞ আগুস্টিনা কোসাচভের আইনজীবী ভাদিম মিসচানচুক বলেছেন, তিনি তাঁর মক্কেলের নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার ব্যাপারে খুব আশাবাদী। মিসচানচুকের যুক্তি, তাঁর মক্কেল ম্যারাডোনার শারীরিক স্বাস্থ্যের নয়, মানসিক স্বাস্থ্যের দায়িত্বে ছিলেন।
কে দোষী আর কে নির্দোষ, সেটা অবশ্য আদালতেই প্রমাণিত হবে। তবে ম্যারাডোনাপ্রেমীরা সঠিক বিচার চান। সে রকমই একজন ম্যারাডোনাপ্রেমী হিলদা পেরেইরা বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেছেন, ‘সবার জানা উচিত...আসলে কী ঘটেছিল, কে তাকে ছেড়ে চলে গেছে...এবং যে দায়ী, এর সাজা পেতেই হবে। ম্যারাডোনার এমন নিঃসঙ্গ মৃত্যু প্রাপ্য ছিল না।’