যে রাতে রাফিনিয়ায় ভর করেছিলেন নেইমার

অবিশ্বাস্য এক ম্যাচ শেষে জয় উদ্‌যাপন রাফিনিয়ারএএফপি

‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে...’—রবীন্দ্রসঙ্গীতের এই লাইনের সঙ্গে মিলেছিল গতকাল লিসবনে বার্সেলোনার বৃষ্টিস্নাত রাত। বেনফিকার মাঠে প্রথমার্ধ শেষে বার্সা ৩–১ গোলে পিছিয়ে। ৭৮ মিনিট পর্যন্তও পিছিয়ে দুই গোলের ব্যবধানে (৪-২)। পর্তুগিজ ক্লাবটির ঝড়ে বার্সার আশার দুয়ারগুলো যেন একে একে ভেঙে যাচ্ছিল। কিন্তু গোটা ম্যাচ বিচারে এই গানেরই পরের লাইনে আপনি টেনে আনতে পারেন নেইমার ও রাফিনিয়াকে।

আরও পড়ুন

‘জানি নাই তো তুমি এলে আমার ঘরে’—যিনি নেই তিনি নেইমার, অনেক দিনই নেই; আর যিনি এলেন তিনি রাফিনিয়া। ব্যাপারটাকে চাইলে আরও কল্পনার রং দেওয়া যায়। গানটির পরবর্তী তিন লাইন, ‘সব যে হয়ে গেল কালো/ নিবে গেল দীপের আলো/আকাশ-পানে হাত বাড়ালেম কাহার তরে।’

বার্সার ঘুরে দাঁড়ানোয় জোড়া গোল করেন রাফিনিয়া
এএফপি

ম্যাচের ৭৮ মিনিট পর্যন্ত দুই গোলের ব্যবধানে পিছিয়ে থাকায় বার্সার আশার প্রদীপের আলো নিভে সব কালোই হয়ে গিয়েছিল। তখন বার্সা কোচ হান্সি ফ্লিক কি আকাশে কারও সাহায্য পাওয়ার প্রার্থনায় হাত বাড়িয়েছিলেন! ক্যামেরায় তেমন কিছু ধরা পড়েনি। তবে মনের খবর তো আর ক্যামেরায় ধরা পড়ে না। আন্দাজ করে নিতে হয়। চেষ্টা ছাড়া যখন আর কিছুই করার থাকে না, তখন দৃঢ়সংকল্পে মানুষ চেষ্টার পাশাপাশি মনে মনে হয়তো প্রার্থনাও করে। আর হাল না ছাড়া এমন মানসিকতাই মানুষকে করে তোলে অনন্য, তখন আকাশ থেকে নেমে আসা অদৃশ্য সাহায্যেরই প্রতিফলন ঘটে মানুষের চেষ্টায়, এই রাতের জন্য সেই মানুষটা রাফিনিয়া।

আকাশ থেকে নেমে আসা সাহায্য—লাইনটিকে বাড়াবাড়ি ভাবলে আসলে কিছুই করার নেই। চ্যাম্পিয়নস লিগে প্রতিপক্ষের মাঠে ৭৫ মিনিট পর্যন্ত দুই গোল ব্যবধানে পিছিয়ে থেকে গতকাল রাতের আগ পর্যন্ত কোনো দলই জিততে পারেনি। বার্সার ৫–৪ গোলের জয় তাই রীতিমতো অবিশ্বাস্যও। সেই অবিশ্বাসের পটভূমিতে ফেরা যাক একবার।

প্রথমার্ধ শেষে ৩–১ ব্যবধানে পিছিয়ে মাঠ ছাড়ার সময় বার্সার কি নেইমারকে মনে পড়েছে?

আরও পড়ুন

পরের অর্ধে ঘুরে দাঁড়ানোর বিকল্প ছিল না। আর কে না জানে, গত কয়েক বছরে বার্সার ঘুরে দাঁড়ানোর প্রসঙ্গ উঠলে সবার আগে একটি ম্যাচই আলোচনায় উঠে এসেছে। ২০১৭ চ্যাম্পিয়নস লিগ শেষ ষোলোর ফিরতি লেগ। স্পেন ও ফ্রান্সে যা ‘লা রেমোনতাদা’—দ্য কামব্যাক নামে খ্যাতি পেয়েছে। প্রথম লেগে পিএসজির কাছে ৪–০ গোলে পর্যুদস্ত হওয়ার পর ফিরতি লেগে অসাধ্য সাধন করতে হতো বার্সাকে। সেটি তারা করেও ছিল। ফিরতি লেগ ৬–১ গোলে জিতে দুই লেগ মিলিয়ে ৬–৫ গোলে বার্সা উঠে গিয়েছিল পরের রাউন্ডে। রচিত হয়েছিল চ্যাম্পিয়নস লিগে সবচেয়ে বড় প্রত্যাবর্তনের ইতিহাস। নেইমার দুটি গোল করেছিলেন। একটি নির্ধারিত সময়ের (৮৮) মধ্যে, পরেরটি যোগ করা সময়ে (৯১)।

লিসবনে কাল রাতে বার্সার কাছে নেইমার ছিলেন না। আট বছর আগেই ক্যাম্প ন্যু ছেড়েছেন। কিন্তু রাফিনিয়া ছিলেন আর নেইমারই যেন ফিরে এলেন তাঁর মধ্যে! বার্সার প্রত্যাবর্তনে রাফিনিয়াও দুই গোল করেছেন, একটি নির্ধারিত সময়ে (৬৪), পরেরটি যোগ করা সময়ে (৯৬)। আপনি বলতে পারেন, মিল আছে আরও। দুজনই ব্রাজিলিয়ান, পজিশনেও ফরোয়ার্ড। তবে আসল মিল সম্ভবত অন্তরে। কিছুদিন আগেই রাফিনিয়া বলেছেন, ‘আবারও জন্ম নিলে কোন ফুটবলার হতে চাই? নেইমার।’

সংবাদমাধ্যম ব্লিচার রিপোর্ট ফুটবল সম্ভবত এ কারণেই কাল রাতের অবিশ্বাস্য কাণ্ড–কারখানার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ওই ছবি পোস্ট করেছে। রাফিনিয়া দাঁড়িয়ে একটি আয়নার সামনে, কিন্তু আয়নায় তাঁর প্রতিচ্ছবি নয়, বার্সার জার্সি গায়ে নেইমারের হাসিমুখের ছবি। চাইলে এবার রবীন্দ্রসঙ্গীতের ওই লাইনটি রাফিনিয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে একটু পাল্টানো যায়—‘যে রাতে মোর দুয়ারে (আয়নায়) নেইমার দাঁড়িয়ে।’ সহজ বাংলায় আসলে যে রাতে নেইমার ভর করেছিলেন রাফিনিয়ায়!

আরও পড়ুন

ব্লিচার রিপোর্টের সে পোস্টের ক্যাপশনে লেখা, ‘রাফিনিয়া এই মৌসুমে।’ অর্থাৎ বার্সায় এ মৌসুমে রাফিনিয়া যেন নেইমার। কাতালান ক্লাবটিতে এটি তৃতীয় মৌসুম তাঁর। এ মৌসুমে ৩০ ম্যাচে ২২ গোল করার পাশাপাশি ৯ গোল করিয়েছেন। রাফিনিয়ার ক্যারিয়ারে এখন পর্যন্ত এটাই সেরা মৌসুম। নেইমার বার্সায় তাঁর তৃতীয় মৌসুমে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ৪৯ ম্যাচে ৩১ গোল। অর্থাৎ, নেইমারকে ধরে ফেলার সুযোগ তো বটেই, ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও আছে।

খেলার ধরনে তেমন মিল না থাকলেও দুজনের স্বভাবে কিছুটা মিল তো আছেই। জবাব দিতে পারেন মুখের ওপরই। কাল রাতেও যেমন ম্যাচ শেষে দা লুজ স্টেডিয়ামের টানেলে ঢোকার সময় বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়ে দুই দল—রাফিনিয়া ছিলেন তার কেন্দ্রবিন্দুতে। রাফিনিয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে ঘটনাটা শুনুন তাঁর মুখেই, ‘আমি এমন কেউ, যে সবাইকে সম্মান করে। মাঠ ছাড়ার সময় লোকে আমাকে অপমান করেছে। অপমান ফিরিয়েও দিয়েছি। জানি, এটা করা উচিত হয়নি। বেনফিকার খেলোয়াড়দের সঙ্গে লেগে গিয়েছিল। ওরা আমাকে অপমান করেছে।’

পর্তুগিজ লিগে বেনফিকার প্রতিদ্বন্দ্বী স্পোর্টিং লিসবনে (২০১৮–১৯) একসময় খেলতেন রাফিনিয়া। সম্ভবত পুরোনো ‘শত্রুতা’ ও ৯৬ মিনিটে তাঁর করা গোলে বার্সা জয় ছিনিয়ে নেওয়াতেই বেনফিকার খেলোয়াড়েরা মেজাজ ধরে রাখতে পারেননি। যেমনটা নেইমার বার্সায় থাকতে রিয়াল মাদ্রিদের খেলোয়াড়দের সঙ্গেও তাঁর লেগেছে। নেইমার তখন যা করতেন, রাফিনিয়াও ঠিক সেই কাজটাই করেছেন, ‘ আমি এমন কেউ, যে কোনোকিছু মনে পুষে করে রাখে না। আমাকে সম্মান দিলে আমিও তাদের সম্মান করি। কিন্তু আমাকে অপমান করলে তো চুপ থাকব না।’ তবে রাফিনিয়া এটাও মেনে নিচ্ছেন, এমন এক ম্যাচে এমন শেষের পর এটাই স্বাভাবিক।

ও হ্যাঁ, আরেকটা মিলের কথা বলাই হয়নি। এই ম্যাচের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার পেয়েছেন রাফিনিয়া, যেমনটা আট বছর আগের ‘লা রেমোনতাদা’য় পেয়েছিলেন নেইমার।