রিচার্লিসন ‘যেন উড়ন্ত চিল...’: গোলের ভিডিও ভাইরাল
ঘরের চালে কিংবা গাছের মাথায় ধ্যানমগ্ন–ঋষির মতো বসে। দেখে মনে হয়, ভাজা মাছ উল্টে খেতে পারে না। আসলে সুযোগমতো শিকারকে ক্ষুরধার নখ দিয়ে ছোঁ মেরে তুলে নেওয়ার অপেক্ষায় সেই ‘ধ্যানমগ্ন–ঋষি’। এখনো বিশ্বাসটা আছে কি না জানা নেই, তবে একসময় এই বিশ্বাসটা ছিল যে ঘরের চালের ওপর তাদের বসাটা অমঙ্গল। ছোটরা দেখলেই ঢিল মেরে বলেছে, ‘যাহ, চিল যাহ!’
প্রতিকূল পরিবেশ ও খাদ্যের অভাবে পৃথিবীজুড়েই টিকে থাকার লড়াই করছে শিকারি পাখিটি। ফুটবলে যেমন স্ট্রাইকার—গত এক–দেড় দশকে খেলার কৌশল আমূল পাল্টে যাওয়ায় ফুটবলে এই স্ট্রাইকার প্রজাতিরা এখন চিলের মতোই টিকে থাকার লড়াই করছে।
টটেনহাম হটস্পার্সের ব্রাজিলিয়ান তারকা রিচার্লিসন যেমন—নামের পাশে লেখা ফরোয়ার্ড, কিন্তু জাতটা প্রথাগত স্ট্রাইকারের। মাঝেমধ্যে তাঁর ভেতরের সেই সত্তাটা বের হয়ে আসে। একইভাবে কোথাও কোনো উঁচুতে ঘাপটি মেরে বসে থাকা চিলকেও খেয়াল করে দেখবেন; ফরোয়ার্ডদের মতো কুড়িয়ে কিংবা কৌশল করে খাবার (গোল) খুঁজে বের করাটা হয়তো প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে, তবে সুযোগ পেলে চিলও কিন্তু ছোঁ মেরে শিকার তুলে নেয়—যেটা তাঁর মজ্জাগত কিংবা স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য।
ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে পরশু রাতে টটেনহাম হটস্পার্সের স্টেডিয়ামেও দেখা গেল এমন এক সাদা ‘চিল’ (টটেনহামের জার্সির রং–ও সাদা)। বার্নলির বিপক্ষে বক্সে তাঁর দাঁড়ানোটা যদি হয় ধ্যানমগ্নতার ভেক ধরে ওত পেতে থাকা, তাহলে অ্যাক্রোবেটিক শটটি নিঃসন্দেহে স্ট্রাইকার নামক জাতের প্রকাশ। বাতাসে ভেসে আসা বলটি ডান পায়ে নামিয়ে ফরোয়ার্ডদের মতো রিচার্লিসন পারতেন কোনো সতীর্থকে পাস দিয়ে বলটা যতক্ষণ সম্ভব প্রতিপক্ষের বক্সে ধরে রাখতে, কিন্তু কখনো কখনো এমন হয়, শত নিয়ম–শাসনের মাঝেও শরীর সেটাই করে মন যা চায়। রিচার্লিসনের তখন বুঝি ‘চিল’ হতে ইচ্ছে হয়েছিল!
গোলটি আরেকবার স্মরণ করা যাক। ম্যাচের তখন ৬০ মিনিট। টটেনহাম ১–০ গোলে এগিয়ে। ডান প্রান্তে বক্সের বাইরে থেকে ক্রস করেন স্বাগতিকদের রাইট উইঙ্গার মোহামেদ কুদুস। উদ্দেশ্য—বার্নলির বাঁ পাশের পোস্ট সোজা একটু দূরে ফাঁকায় দাঁড়ানো রিচার্লিসন। ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ড তখন গোলপোস্টের উল্টো দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে। বলটি ভেসে আসতেই শূন্যে লাফিয়ে নিলেন ‘সিজর্স কিক’—ব্যস, ডান পায়ে ঠিক জায়গায় লাগাতে পারায় বলটি বুলেট গতিতে বাঁ পাশের পোস্ট ঘেঁষে আশ্রয় নেয় জালে!
বার্নলি গোলকিপার মার্টিন দুব্রাভাকা ততক্ষণে হতভম্ব। অবিশ্বাসে টটেনহামের মিডফিল্ডার লুকাস বেরগাভেলের মাথায় হাত। সম্ভবত কেউ–ই ভাবেননি, ওখান থেকে অমন চোখধাঁধানো অ্যাক্রোবেটিক শট নেবেন রিচার্লিসন। ধারাভাষ্যকারের কণ্ঠে তখন ভীষণ উত্তেজনা, ‘গোল অব দ্য সিজন কনটেন্ডার অলরেডি!’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও কেউ কেউ আগবাড়িয়ে লিখে ফেলেন, ‘এটা এরই মধ্যে মৌসুমের সেরা গোল।’ ভাইরাল হয়ে গেছে রিচার্লিসনের সেই গোলের ভিডিও।
অথচ ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের নতুন মৌসুমে এটা টটেনহামের প্রথম ম্যাচ। আর এ ম্যাচেই অবিশ্বাস্য গোলটি করে রিচার্লিসন ফিরিয়ে নিয়ে গেছেন তিন বছর আগের স্মৃতিতে। কাতারে অনুষ্ঠিত ২০২২ বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বে সার্বিয়ার বিপক্ষে প্রায় একইরকম গোল করেছিলেন রিচার্লিসন। সেটা বার্নলি ম্যাচে যে প্রান্ত থেকে গোল করেছেন তাঁর উল্টো দিকে—ডান দিকে। বাঁ প্রান্ত থেকে ভিনিসিয়ুসের ক্রস পেয়ে বাঁ পায়ের টাচে বলটা আগে ওপরে তুলেছেন। তাঁর মাথার ওপর দিয়ে বলটা সামনে পড়ার আগেই শরীরটা ঘুরিয়ে শূন্যে লাফিয়ে সিজর্স/বাইসাইকেল কিকে গোল করেন।
রিচার্লিসনের ওই গোলের পরপরই টিকটকে তাঁকে নিয়ে একটি গান ভাইরাল হয়েছিল, ‘রিচার্লিসন যেন উড়ন্ত চিল...।’
অনেক দিন পর টটেনহামের স্টেডিয়ামে যেন সেই ব্রাজিলিয়ান সোনালি ডানার চিলের মোড়কে টটেনহামের শ্বেত–শুভ্র ‘উড়ন্ত চিল’কে–ই দেখা গেল।
বার্নলির বিপক্ষে গোলটি আরেকটি কারণে বিশেষ হয়ে উঠেছে। সার্বিয়ার বিপক্ষে সেই ম্যাচে রিচার্লিসন গোলটি করার আগে তাঁর দলের সব খেলোয়াড় বল ‘টাচ’ করতে পারেননি। টটেনহামের হয়ে কিন্তু তা হয়েছে। শুনুন টটেনহাম কোচ টমাস ফ্রাঙ্কের মুখেই, ‘দ্বিতীয় গোলে ১৭টি পাস খেলা হয়েছে এবং দলের সবাই বলটা স্পর্শ করেছে। একটু খারাপ লাগছে যে এত দ্রুতই মৌসুমের সেরা গোলটি পেয়ে গেলাম।’
বার্নলির বিপক্ষে টটেনহামের ৩–০ গোলে জয়ের ম্যাচে রিচার্লিসন আরও একটি গোল পেয়েছেন। ৭১ মিনিটে মাঠ ছাড়ার সময় দর্শকেরা উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে সম্মান জানান। এটুকু তাঁর প্রাপ্যই ছিল। তিন বছর আগে ৬ কোটি পাউন্ডে এভারটন থেকে টটেনহামে আসার পর মোটেই সুবিধা করে উঠতে পারেননি। ২০২২–২৩ মৌসুমে ৩৫ ম্যাচে করেন ৩ গোল, ২০২৩–২৪ মৌসুমে ৩১ ম্যাচে ১৩ গোল আর গত মৌসুমে চোটের কারণে দীর্ঘ সময় ছিলেন মাঠের বাইরে। হ্যামস্ট্রিংয়ের চোটে ১৭ ম্যাচ খেলতে পারেননি। সেই চোট থেকে সেরে ওঠার এক মাসের কম সময়ের ব্যবধানে আবারও পায়ের চোটে মাঠে বাইরে থাকেন ১০ ম্যাচ।
গত মৌসুমে লিগে ১৫ ম্যাচে তাঁর গোল ৪টি, সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ২৪ ম্যাচে ৫টি। সেই রিচার্লিসন এবার লিগে প্রথম ম্যাচেই আদায় করলেন গত লিগ মৌসুমের অর্ধেক গোল!
রিচার্লিসনের হারানো এই রূপ দেখে উচ্ছ্বসিত প্রিমিয়ার লিগে রেকর্ড গোলদাতা অ্যালান শিয়ারারও। বিবিসি স্পোর্টকে শিয়ারার ভেঙে বলেছেন, কৌশলগত কারণে গোলটি করা কেন খুব কঠিন ছিল, ‘গোলের উল্টো দিকে (মুখ করে) ছিলেন রিচার্লিসন। (তখন) বলের স্পর্শ পেতে শরীরের প্রায় সব অংশই পুনবির্ন্যাস করতে হয়। এটা খুবই কঠিন কৌশল।’
ব্রাজিলের হয়ে ৫০ ম্যাচে ২০ গোল করা রিচার্লিসন গত বছর জাতীয় দলের হয়ে খেলার সুযোগ পাননি। তবে এ বছর সময়টা একদম খারাপ যাচ্ছে না। গত মে মাসে প্রথমবারের মতো বাবা হন। এর ছয় দিন পর সঙ্গী হন ইতিহাসের। টটেনহামের হয়ে ৪১ বছর পর জেতেন ইউরোপিয়ান ট্রফি (ইউরোপা লিগ)। পাঁচ দিন পর বিশ্বকাপ বাছাইয়ে রিচার্লিসনকে ব্রাজিলের স্কোয়াডে রেখে সবাইকে চমকে দেন কোচ কার্লো আনচেলত্তি।
সেপ্টেম্বরে চিলি ও বলিভিয়ার বিপক্ষে বাছাইপর্বে নিজেদের শেষ দুটি ম্যাচ খেলবে ব্রাজিল। রিচার্লিসন এ দুটি ম্যাচে ডাক পাওয়ার অপেক্ষায়, ‘আমি সব সময় সেলেসাওদের জন্য। এটা আজ থেকে বলছি না যে সেলেসাও আমার জীবন, এটা আমার স্বপ্ন।’
২০২৬ বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্নে তা দিতে দিতে গতকাল নিজের ইনস্টাগ্রাম হ্যান্ডলে মজার এক ছবিও পোস্ট করেন রিচার্লিসন। ২০০২ বিশ্বকাপে রোনালদো নাজারিওর জার্সি এবং চুলের ছাঁট রেখে শুধু নিজের মুখটা সেখানে বসিয়েছেন। ক্যাপশনে লেখা, ‘বিশ্বকাপ শুরু হতে এক বছরের কম সময় বাকি।’
রিচার্লিসনকে এই অল্প সময়ের মধ্যেই প্রস্তুতি নিতে হবে। সে জন্য তাঁকে মাঝেমধ্যেই চিলের মতো ছোঁ মেরে গোল আদায় করতে হবে। তা না হলে ব্রাজিলিয়ান না হোক, বাংলাদেশের ব্রাজিল ভক্তরা জীবনানন্দের লাইনগুলো আওড়াতে পারেন—
‘হায় চিল, সোনালি ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে
তুমি আর কেঁদোনাকো উড়ে-উড়ে ধানসিড়ি নদীটির পাশে!’