কেপ ভার্দে কবে থেকে ফুটবল খেলে, কীভাবে জায়গা পেল বিশ্বকাপে
কেপ ভার্দের জাতীয় স্টেডিয়াম থেকে বেরিয়ে আসা সমর্থকদের উল্লাসে তখন কান পাতা দায়। হর্নের শব্দ, আতশবাজির ঝলকানি আর নাচ-গানেই কেটেছে কেপ ভার্দিয়ানদের পরশু রাতটা। এমন হয়তো কাটবে সামনে আরও অনেকগুলো রাত। উপলক্ষটাই যে বিশাল—ইসোয়াতিনিকে পরশু রাতে ৩–০ গোলে হারিয়ে ২০২৬ বিশ্বকাপে জায়গা করে নিয়েছে কেপ ভার্দে, ভালোবেসে সমর্থকেরা যে দলটাকে ডাকে ‘ব্লু শার্কস’ নামে।
যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও মেক্সিকোয় হতে যাওয়া বিশ্বকাপে নিজেদের উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়ার পর স্টেডিয়ামের বাইরে কেপ ভার্দিয়ান সমর্থকদের কেউ নেচেছেন রেগে সুরে, কেউবা মেতে ছিলেন স্থানীয় ফুনানা গানে। ‘অবিশ্বাস্য এক মুহূর্ত’—বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেছেন ৩৭ বছর বয়সী সমর্থক জর্জ জুনিয়র লিভ্রামেন্তো। তাঁর চোখেমুখে তখনো উচ্ছ্বাস, ‘কী বলব বুঝতে পারছি না। আমি মাঠে ছিলাম, দলকে নিঃশর্ত সমর্থন দিয়েছি।’
ফিফা সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনো কেপ ভার্দেকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছেন, ‘এই ঐতিহাসিক অর্জন নতুন প্রজন্মকে ফুটবলের প্রেমে পড়তে অনুপ্রাণিত করবে।’
বিশ্বকাপে জায়গা পাওয়া দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম দেশ
আটলান্টিক মহাসাগরের ১০টি দ্বীপ নিয়ে গড়া দেশ কেপ ভার্দে। ১৯৭৫ সালে পর্তুগালের কাছ থেকে স্বাধীনতা পায় তারা। জনসংখ্যা ৫ লাখ ২৫ হাজারের কম (বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী)। জনসংখ্যার হিসাবে কেপ ভার্দে বিশ্বকাপের মূল পর্বে খেলার সুযোগ পাওয়া দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম দেশ। এর আগে ২০১৮ সালে রাশিয়া বিশ্বকাপে খেলা আইসল্যান্ডের জনসংখ্যা সেই সময় ছিল ৩ লাখ ৫০ হাজারের মতো।
কেপ ভার্দের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ
জাতীয় দল প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে ১৯৭৮ সালের ২৯ মে, গিনির বিপক্ষে। সেই ম্যাচে ১–০ গোলে হেরে যায় তারা। ১৯৮২ সালে গঠিত হয় কেপ ভার্দে ফুটবল ফেডারেশন, ১৯৮৬ সালে যোগ দেয় ফিফায়।
খেলোয়াড়েরা কোথায় খেলেন
মজার ব্যাপার দেশটিতে এখন যত মানুষ থাকেন, এর চেয়ে দেশের বাইরে থাকা কেপ ভার্দিয়ানদের সংখ্যা বেশি। দলের বেশির ভাগ খেলোয়াড়ই থাকেন বিদেশে। অনেকের জন্মও দেশের বাইরে। মাত্র ১২ দলের ঘরোয়া লিগ নিয়ে গঠিত দেশটির জাতীয় দল তাই বিদেশে খেলা খেলোয়াড়দের ওপরই নির্ভরশীল। বেশির ভাগই খেলেন ইউরোপ বা এশিয়ার ক্লাবে।
তবে ইউরোপে শীর্ষ পাঁচ লিগে খেলা কোনো খেলোয়াড় নেই দলটিতে। লিবিয়া ও ইসোয়াতিনির বিপক্ষে বাছাইপর্বে সর্বশেষ যে দুটি ম্যাচ খেলেছে কেপ ভার্দে, সেখানে স্কোয়াডে থাকা ২৬ জনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৬ জন পর্তুগালের বিভিন্ন পর্যায়ের লিগের খেলোয়াড়। ৩ জন করে ইসরায়েল ও তুরস্কের। আছেন নেদারল্যান্ডস, বুলগেরিয়া, সাইপ্রাস, আয়ারল্যান্ড, হাঙ্গেরি, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিভিন্ন পর্যায়ের লিগে খেলা খেলোয়াড়ও।
আইরিশ ক্লাব শার্মক রোভার্সের ডিফেন্ডার রবার্তো লোপেজকে যেমন জাতীয় দলে ডাকা হয়েছিল লিংকডইনের মাধ্যমে খুঁজে পেয়ে। লোপেজ বলেছেন, ‘আমার বাবা সাও নিকোলাও দ্বীপের মানুষ। ১৬ বছর বয়সে তিনি দেশ ছেড়ে চলে যান। কাজ আর ফুটবলের সুযোগের খোঁজে অনেকে দেশ ছাড়ে। আমরা আসলে সারা পৃথিবীতেই ছড়িয়ে আছি। একসঙ্গে থাকলে আমরা কী করতে পারি, সেটাই এখন সবাই দেখছে।’
আন্তর্জাতিক ফুটবলে পথচলা
১৯৯২ সালে প্রথম আফ্রিকান নেশনস কাপ বাছাইয়ে খেলে কেপ ভার্দে। ২০০৩ সালে প্রথমবার বিশ্বকাপ বাছাইয়ে অংশ নেয়। ২০১৩ সালে আফ্রিকান নেশনস কাপে অভিষেকেই পৌঁছে যায় কোয়ার্টার ফাইনালে। একই কীর্তি গড়েছে ২০২৩ সালেও। বর্তমানে ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে তাদের অবস্থান ৭০তম।
২০২৬ বিশ্বকাপে আফ্রিকা অঞ্চলের বাছাইপর্বে সবাইকে চমকে দিয়ে গ্রুপ ডি থেকে ২৩ পয়েন্ট নিয়ে শীর্ষে থেকে বিশ্বকাপ নিশ্চিত করেছে কেপ ভার্দে। ৪ পয়েন্ট পিছিয়ে দ্বিতীয় স্থানে ক্যামেরুন, যারা আফ্রিকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আটবার বিশ্বকাপে খেলেছে।
এবার বড় কিছুর আশা
প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে সুযোগ পেয়ে দারুণ আনন্দিত কেপ ভার্দের কোচ পেদ্রো লেইতাও ব্রিতো। সমর্থকদের কাছে পরিচিত ‘বুবিস্তা’ নামে। দেশটির স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির বছরে এমন অর্জনে খুবই আপ্লুত তিনি, ‘এটা শুধু ফুটবলের জয় নয়, আমাদের স্বাধীনতার জন্য যাঁরা লড়েছেন, তাঁদের জন্যও এক বিশাল জয়।’
৩৯ বছর বয়সী গোলরক্ষক ভোজিনহার কণ্ঠেও একই আবেগ, ‘শৈশব থেকে এই মুহূর্তের স্বপ্ন দেখেছি। অবশেষে তা সত্যি হলো।’ এখন স্বপ্নটা আরও বড় করেছেন ভোজিনহা, ‘আশা করছি আমরা ফুটবলের সবচেয়ে বড় আসরেও নিজেদের ছাপ রাখতে পারব।’
সেটা যদি হয়, কেপ ভার্দেতে যে আরও বড় উৎসব হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।