শেষ বাঁশির সঙ্গে সঙ্গে কয়েক হাজার ছাত্রছাত্রী মেতে উঠলেন আনন্দ-উল্লাসে। তাঁদের উল্লাস থামছিলই না। ততক্ষণে প্রায় সন্ধ্যা নামতে চলেছে। কিন্তু ঘরে ফেরার তাড়া নেই কারও। গত বছর টুর্নামেন্টের প্রথম আসরের গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নেওয়া ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি আজ যে সব হতাশা ভুলে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বাদ পেয়েছে। ইস্পাহানি-প্রথম আলো আন্তবিশ্ববিদ্যালয় ফুটবলের দ্বিতীয় আসরে জয়ের পতাকা ওড়ানোর এই বিকেলটা দারুণভাবে উপভোগ করেছে পুরো ড্যাফোডিল পরিবার।
সাভারের বিরুলিয়ায় ড্যাফোডিলের ক্যাম্পাসেই আজ টুর্নামেন্টের ফাইনাল ‘স্বাগতিকেরা’ ২-১ গোলে হারিয়েছে আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিকে (এআইইউবি)। টান টান উত্তেজনায় ফাইনাল হয়েছে ফাইনালের মতোই। গতবার ফাইনাল গড়িয়েছিল টাইব্রেকারে—এবার নির্ধারিত ৭০ মিনিটেই শেষ।
১৩ মিনিটে অধিনায়ক ফয়েজ আহমেদ বক্সে ঢুকে দারুণ প্লেসিংয়ে গোল করে যখন এগিয়ে নেন এআইইউবিকে এতটুকু বিচলিত হয়নি ড্যাফোডিল। দুই মিনিটের মধ্যে অমিত হাসানের দেখার মতো দূরপাল্লার এক শটে ড্যাফোডিল ম্যাচে ফিরে আসে। বিরতির আগেই মাহবুবুর রহমান জুয়েলের গোলে এগিয়েও যায় ড্যাফোডিল। অনেক চেষ্টা করেও সেই গোল আল শোধ করতে পারেনি এআইইউবি। ড্যাফোডিল মাঠ ছেড়েছে জয়ের আনন্দ নিয়েই।
ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটিকে ৫-২ গোলে হারিয়ে এবারের টুর্নামেন্ট শুরু করে ড্যাফোডিল। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়কে ৮-০ গোলে উড়িয়ে গ্রুপ ফাইনালে আসে। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজির বিপক্ষে ১-০ গোলে জয়ে ওঠে কোয়ার্টার ফাইনালে। শেষ আটে সিসিএন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপক্ষেও জয় ১-০ গোলে। সেমিফাইনালে গতবারের রানার্সআপ ফারইস্টকে ৩-০ গোলে হারিয়ে ফাইনালও জিতে নিয়েছে শক্তিতে এগিয়ে থাকা ড্যাফোডিল।
২০২২ সালে বঙ্গবন্ধু আন্তবিশ্ববিদ্যালয় স্পোর্টস ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পথে ফাইনালে ড্যাফোডিল হারিয়েছিল গণ বিশ্ববিদ্যালয়কে। বিশ্ববিদ্যালয় ফুটবলে সেটিই এত দিন একমাত্র শিরোপা ছিল ড্যাফোডিলের। তাতে আজ যোগ হয়েছে নতুন পালক। ড্যাফোডিলের কাছে স্মরণীয় বিকেলটা হতাশার হয়ে এসেছে আইইউবির কাছে। বিশ্ববিদ্যালয় ফুটবলে প্রথম শিরোপা জয়ের আশা অপূর্ণই থাকল তাদের।
দুই দলেই খেলেছেন বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের খেলা একঝাঁক ফুটবলার। তবে ড্যাফোডিলে ছিলেন দুজন বড় তারকা। জাতীয় দলের ডিফেন্ডার রহমত মিয়া ও ঈসা ফয়সালকে নিয়ে ড্যাফোডিল হয়ে ওঠে আরও শক্তিশালী। ফরোয়ার্ড ফয়সাল আহমেদ ফাহিম নিজ ক্লাব বসুন্ধরা কিংস থেকে অনুমতি না পাওয়ায় খেলতে পারেননি। তবে ড্যাফোডিলের জার্সিতে টুর্নামেন্টের শুরু থেকে খেলেছেন চট্টগ্রাম আবাহনীর সোহানুর রহমান ও ফাহিম মোর্শেদ। খেলেছেন পুলিশের ফরোয়ার্ড দীপক রায়ও, যিনি জাতীয় দলে ডাক পেয়েছেন এরই মধ্যে। তারকা খচিত দল নিয়ে ড্যাফোডিল চ্যাম্পিয়ন হতে না পারলে তাদের জন্য সেটি হতো আক্ষেপের।
আগের ম্যাচগুলোর মতো ফাইনালেও ড্যাফোডিলের দিকেই সমর্থন ছিল একতরফা। মাঠের চারপাশে কয়েক হাজার ছাত্রছাত্রী সার বেঁধে দাঁড়িয়ে মুহূর্তটার সাক্ষী হয়েছেন। আশপাশের ভবনের ছাদ, ব্যালকনিতেও ছিল না তিল পড়ার জায়গায়। শিক্ষার্থী, সমর্থকদের বিপুল চাপ সামলে ম্যাচ পরিচালনাই কঠিন হয়ে পড়ে সাবেক ফিফা রেফারি জালাল উদ্দিনের জন্য। গোলের পর ড্যাফোডিলের সমর্থকেরা মাঠে ঢুকে পড়ায় কয়েক মিনিট খেলা বন্ধও রাখতে হয়। সমর্থকদের প্রত্যাশা ষোলো আনা মিটিয়ে ড্যাফোডিল খেলেছে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মতোই।
ফাইনালের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার পেয়েছেন ড্যাফোডিলের ‘নাম্বার টেন’ সোহানুর রহমান। নাক ফেটে গেলেও অসাধারণ খেলেছেন চূড়ান্ত লড়াইয়ে। ১০ গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার পেয়েছেন ড্যাফোডিলের মাহবুবুর রহমান জুয়েল। পুলিশ, শেখ জামাল ধানমন্ডির মতো দলে খেলা এই স্ট্রাইকার ড্যাফোডিলের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পথে রেখেছেন বড় অবদান। ৬ ম্যাচের তিনটিতেই ম্যাচসেরা, মাহবুবুরের হাতেই উঠেছে টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার। টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন দল পেয়েছে ৫ লাখ টাকা, রানার্সআপ ৩ লাখ।
প্রথম আলোর প্রধান ক্রীড়া সম্পাদক উৎপল শুভ্রর সঞ্চালনায় পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে মঞ্চে ছিলেন ইস্পাহানি গ্রুপের পরিচালক মির্জা আহমেদ ইস্পাহানি, ইমাদ ইস্পাহানি, ইস্পাহানি টি লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক (বিপণন) ওমর হান্নান, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, বোর্ড অব ট্রাস্টিজ, ড. মো. সবুর খান, এআইইউবির প্রক্টর প্রফেসর ড. মুঞ্জুর এইচ খান।
ছিলেন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান, টুর্নামেন্ট কমিটির প্রধান জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক আশরাফউদ্দিন আহমেদ চুন্নু, টুর্নামেন্টের টেকনিক্যাল কমিটির প্রধান জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক ইমতিয়াজ সুলতান জনি, টুর্নামেন্ট কমিটির সদস্য ও জাতীয় দলের সাবেক কোচ শফিকুল ইসলাম মানিক ও জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক মামুনুল ইসলাম।
গত বছর ইস্পাহানি-প্রথম আলো প্রথম আন্তবিশ্ববিদ্যালয় ফুটবলে অংশ নিয়েছিল ৩২টি দল। ঢাকার বাইরে খেলা হয় চট্টগ্রাম, কুমিল্লায়ও। এবার চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, ঢাকা—৪ অঞ্চলে ৪২টি দল খেলেছে। ১৭ নভেম্বর চট্টগ্রামে শুরু হয়েছিল এবারের টুর্নামেন্ট। ১৫ দিনে ৪২ দলের ৪১ ম্যাচে শেষে সবাই ফিরে গেলেন যে যাঁর গন্তব্যে। ভবিষ্যতে আরও বড় পরিসরে এই টুর্নামেন্টটি হবে, এই প্রত্যাশা নিয়ে।
রোল অব অনার
সাল চ্যাম্পিয়ন রানার্সআপ
২০২৩ গণ বিশ্ববিদ্যালয় ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
২০২৪ ড্যাফোডিল আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি