হার মেনে নিয়ে এসেও জয় দেখলেন সৌদি সমর্থকেরা

গ্যালারিতে সৌদি আরবের সমর্থকদের উল্লাসছবি: রয়টার্স

ম্যাচ শেষে আমির খালিদের প্রতিক্রিয়াটা ভিডিও করে রাখা উচিত ছিল। করিনি বলে পরে খুব আফসোস হলো। আফসোস করে আর কী হবে! চারপাশে সৌদি আরব সমর্থকদের উল্লাস আর নাচানাচির মধ্যে তখন ভিডিও করার অবস্থা ছিল নাকি! চিৎকার-চেঁচামেচিতে কথাই তো শুনতে হচ্ছে মুখের কাছে কান পেতে।

২২ বছরের সৌদি তরুণ তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে কাজ করেন। ভালো ইংরেজি বলতে পারেন। ইংরেজি জানেন না বলে বলে তিন–চারজনের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর আমির খালিদকে পেয়ে যেন হাতে চাঁদ পেলাম। হাতে সৌদি আরবের পতাকা না থাকলে অবশ্য তাঁকে শনাক্ত করাই কঠিন হতো। চেহারা-ছবিতে তো নয়ই, পোশাক-আশাকেও কোনো সৌদি ছাপ নেই। জিনসের প্যান্টের সঙ্গে পরে আছেন টি-শার্ট। চোখে রোদচশমা।

মাঠে তখনো সৌদি আরবের খেলোয়াড়দের উল্লাস শেষ হয়নি। শেষ বাঁশি বাজতেই বেঞ্চের খেলোয়াড়েরা দৌড়ে নেমে গেছেন মাঠে। দলগত উল্লাস শেষে সবাই ছুটে গেলেন গ্যালারির দিকে। ওই দিকটা কীভাবে ঠিক করেছেন তাঁরা, তা একটা রহস্য বটে। সৌদি সমর্থকেরা তো আর গ্যালারির একটা জায়গায় সীমাবদ্ধ ছিলেন না।

অবিশ্বাস্য এক জয় পেয়েছে সৌদি আরব
ছবি: এএফপি

‌‘কেমন লাগছে’—প্রশ্নটা শোনার পর মাঠের দিকে চোখ রেখেই আমির খালিদ বললেন, ‌‘আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। অবিশ্বাস্য!’

বলার সময় ঠোঁট কাঁপছে। চিকচিক করছে চোখ। গ্যালারিতে বসে সরাসরি দেখার পরও বিশ্বাস হচ্ছে না বলার পর ‌‘এমন কিছু আশা করেছিলেন কি না’ প্রশ্ন করার আর সুযোগ থাকে না। তাই একটু ঘুরিয়ে জানতে চাইলাম, ‌এই ম্যাচে সর্বোচ্চ কী প্রত্যাশা ছিল তাঁর।

আমির খালিদ চমকে দিয়ে বললেন, ‌‘২-১।‌’

২-১ মানে? ম্যাচের স্কোরলাইন তো তাই-ই। তাহলে ‘আনবিলিয়েভল!’ ‘আনবিলিয়েভল’ বলছেন কেন? আনন্দে উন্মাতাল অন্য সৌদি সমর্থকদের ধাক্কা খেতে খেতে আমির খালিদ ব্যাখ্যা দিলেন, ‘আমার প্রত্যাশা ছিল, সৌদি আরব যেন একটু লড়াই করে। অন্তত একটা গোল দিয়ে ২-১-এ হারে।‌’

আরও পড়ুন

হার মেনে নিয়েই আসলে ম্যাচ দেখতে এসেছিলেন সৌদি সমর্থকেরা। প্রতিপক্ষ বিশ্ব ফুটবলের এক পরাশক্তি। যারা সর্বশেষ কবে হেরেছে, তা মনে করতেই কষ্ট হয়। এর আগে চার ম্যাচে যাদের কখনো হারানো যায়নি, দুটি ড্র-কেই মানতে হয়েছে জয়ের সমতুল্য। সেই আর্জেন্টিনার বিপক্ষে জয়ের পর সৌদি সমর্থকদের আনন্দটা কেমন হতে পারে, তা অনুমান করা কঠিন কিছু নয়।

কী বলছেন! এ জিনিস আসলে অনুমানযোগ্য নয়। অনুমান করতেও পারবেন না। স্টেডিয়ামে না থাকলে আসলে বোঝাই সম্ভব নয়, সৌদিদের আনন্দ-উল্লাসের মাত্রাটা কেমন ছিল। মাঝেমধ্যেই যে গর্জনের রূপ নিল, তা অবশ্যই মোটেই অস্বাভাবিক নয়। এত মানুষ একসঙ্গে চিৎকার করলে তা তো গর্জনের মতোই শোনাবে।

আরও পড়ুন

এত মানুষ মানে কত মানুষ? তা অবশ্য সুনির্দিষ্টভাবে বলা কঠিন। লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়াম এই বিশ্বকাপের আটটি ভেন্যুর মধ্যে সবচেয়ে বড়। অফিশিয়াল ধারণক্ষমতা ৮০ হাজার। যদিও উদ্বোধনী ম্যাচের স্টেডিয়াম আল বায়তের মতো এদিনও বড় চমক। আল বায়তের ধারণক্ষমতা ৬০ হাজার, অথচ মাঠে নাকি ছিলেন আরও কয়েক হাজার বেশি দর্শক‍! এদিনও লুসাইল স্টেডিয়ামের বড় পর্দায় ভেসে ওঠা দর্শকসংখ্যার সঙ্গে অফিশিয়াল ক্যাপাসিটি মিলল না। গ্যালারিতে নাকি ৮৭ হাজারেরও বেশি দর্শক।

সৌদি আরবের সমর্থকদের উৎসবের দিন
ছবি: এএফপি

এই ধাঁধার সম্ভাব্য উত্তর হতে পারে একটাই। টিকিট কিনে আসা দর্শকের সঙ্গে অন্য সব ভূমিকায় মাঠে থাকা দর্শক মিলিয়েই হয়তো মোট সংখ্যাটা হিসাব করা হয়েছে।  
সেই ৮৭ হাজার দর্শকের মধ্যে সৌদি আরবের কতজন? সীমান্ত পাড়ি দিয়ে সৌদি আরব থেকে কত সমর্থক এসেছেন কাতারে? সংখ্যাটা সুনির্দিষ্টভাবে জানার উপায় নেই। গত কয়েক বছর কাতারের সঙ্গে সৌদি আরবের রাজনৈতিক বৈরিতার কারণে এই বিশ্বকাপে সৌদি আরবের অংশগ্রহণ নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছিল একসময়।

প্রতিবেশী দেশে বিশ্বকাপ হওয়ার পরও সৌদি সমর্থকদের তা দেখতে পারা নিয়েও। সেই সমস্যা মিটে যাওয়ার পর দলে দলে সৌদি আরবের লোক কাতার ছুটে এসেছে। লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে তাই ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকল ছোপ ছোপ সবুজ। প্রথম ম্যাচেই এমন অভাবনীয় জয়ের পর সংখ্যাটা সামনে হয়তো আরও বাড়বে।

আরও পড়ুন

গ্যালারিতে আকাশি-নীলও ছিল। সবুজ যারা, তারা সবাই সৌদি নাগরিক। কিন্তু আকাশি-নীলের সবাই আর্জেন্টাইন নন। অন্য দেশেও আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের প্রচুর সমর্থক। তাঁরাও প্রিয় দলের জার্সি পরেই মাঠে এসেছেন। মাঠে ঢোকার আগে যেমন দেখা হলো এক দম্পতির সঙ্গে। স্বামী-স্ত্রী দুজনের গায়েই আর্জেন্টিনার জার্সি। চেহারা-ছবিতেও দিব্যি আর্জেন্টাইন।

আরও পড়ুন

তা মনে করেই কিছুক্ষণ কথা বলার পর আবিষ্কৃত হলো, তাঁরা আসলে মেক্সিকান। হাতে ঢাউস একটা মেক্সিকান পতাকাও আছে। তাহলে আর্জেন্টিনার জার্সি পরেছেন কেন? কারণ, মেক্সিকোর পরই আর্জেন্টিনাকে পছন্দ করেন। আসলে পছন্দ করেন মেসিকে।

আমির খালিদের কথা দিয়ে লেখাটা শুরু হয়েছিল। শেষটাও তাঁকে দিয়েই করি। প্রিয় ফুটবলার কে—প্রশ্নটা করার পর ভেবেছিলাম, এমন ঐতিহাসিক জয় এনে দেওয়া সৌদি আরবের দুই গোলদাতার কারও নামই হয়তো বলবেন। আমির খালিদ কী বললেন, জানেন?

‘আমার প্রিয় ফুটবলার মেসি।‌’