দেম্বেলে ব্যালন ডি’অর জিততেই পারেন, তবে না জেতারও কারণ আছে
প্রবাদ বলে—শেষ ভালো যার, সব ভালো তার। কিন্তু উসমান দেম্বেলের শেষটা তো ভালো হয়নি।
ব্যালন ডি’অর আলোচনায় শুরুতেই দেম্বেলের নাম নেওয়ার কারণ, এবারের পুরস্কারের দাবিদার হিসেবে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয়েছে এই ফরাসির নামটাই। শেষটা ভালো হয়নি বলতে ক্লাব বিশ্বকাপের ফাইনাল। ১৪ জুলাই ২০২৪-২৫ মৌসুমের সর্বশেষ এই ম্যাচে দেম্বেলের পিএসজি ইংলিশ ক্লাব চেলসির কাছে ৩-০ গোলে হেরেছে। নিউ জার্সির মেটলাইফ স্টেডিয়ামে ফেবারিট হিসেবে নেমেও যে পিএসজি জিততে পারেনি, তাতে অন্যতম কারণ দেম্বেলের নিষ্প্রভ হয়ে থাকা। ৯০ মিনিট মাঠে ছিলেন, ৪৫ বার বল স্পর্শ করেছেন। কিন্তু যে একবার গোলের সুযোগ পেয়েছেন বা করে নিতে পেরেছেন, সেটিই নষ্ট করেছেন।
একজন খেলোয়াড়ের শ্রেষ্ঠত্ব পরিমাপে বড় মঞ্চ আর বড় ম্যাচকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপের ফাইনালের পাল্লায় দেম্বেলের পারফরম্যান্সের ওজন বেশ হালকাই লেগেছে। যদিও এর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্যারিসের হোটেল দি ক্রিলনে ব্যালন ডি’অর কমিটির যে বৈঠকটি হয়েছে, তাতে তাঁর নামটি আলোচিত হওয়ার কথা গুরুত্বের সঙ্গেই।
ব্যালন ডি’অর কমিটির বৈঠকটি ছিল ২০২৫ সালের পুরস্কারের মনোনীতদের নাম চূড়ান্তের। ২০২২ সাল থেকে ফুটবলের বর্ষসেরার পুরস্কারটি দেওয়া হচ্ছে মৌসুমের ভিত্তিতে। মানে আগস্ট থেকে পরের বছরের মাঝামাঝিতে সব প্রতিযোগিতা শেষ হওয়া পর্যন্ত। সাধারণত লিগ ও মহাদেশীয় প্রতিযোগিতা শেষ হয়ে যায় জুনের মধ্যেই। এ বছর ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ থাকায় মৌসুম শেষ হয়েছে জুলাইয়ে এসে। সামনের বছরগুলোতে মৌসুম ধরা হবে বিশ্বকাপ আর ইউরো, কোপা আমেরিকা পর্যন্তও।
ফরাসি ম্যাগাজিন ‘ফ্রান্স ফুটবল’ তত্ত্বাবধানে ও উয়েফার সহ-আয়োজনে এবারের ব্যালন ডি’অর পুরস্কার ঘোষণা করা হবে ২২ সেপ্টেম্বর। তার আগে মনোনয়নপ্রাপ্তদের নাম ঘোষণা করা হবে ৭ আগস্ট। এই মনোনয়নপ্রাপ্তদের মধ্য থেকে ভোটে নির্ধারিত হবে চূড়ান্ত বিজয়ীর নাম। ভোট দেবেন ফিফা র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষ ১০০ তালিকায় থাকা দেশের মনোনীত সংবাদকর্মীরা।
ভোটাভুটি, তারও আগের মনোনয়ন তালিকা প্রকাশ এখনো বাকি। তবে শেষ হয়ে যাওয়া ২০২৪-২৫ মৌসুমের যে রেশ আরও কিছুদিন প্রবলভাবে থেকে যাবে, সেটা সম্ভাব্য ব্যালন ডি’অরজয়ী ঘিরেই। পিএসজি এবার লিগ আঁ, ফ্রেঞ্চ কাপ, ট্রফি দি চ্যাম্পিয়ন আর উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার পর দেম্বেলেকেই ব্যালন ডি’অরের মূল দাবিদার হিসেবে ধরে নিয়েছেন সবাই। ব্যক্তি পর্যায়ের বেশ কিছু তথ্য-উপাত্তও সাবেক ডর্টমুন্ড ও বার্সেলোনা ফরোয়ার্ডের পক্ষেই কথা বলছে। কিন্তু ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপে তাঁর শেষের বিবর্ণতা প্রতিদ্বন্দ্বিতার দৌড়ে তাঁকে পিছিয়ে অন্যদের কাছাকাছিও নিয়ে গেছে।
প্রথমে দেখে নেওয়া যাক, দেম্বেলে কী কী কারণে ব্যালন ডি’অর জিততে পারেন। পিএসজির মৌসুমে চার ট্রফির সাফল্য দেম্বেলেরও। এর সঙ্গে যোগ হবে পুরো মৌসুমে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে তাঁর ৩৫ গোল ও ১৬ অ্যাসিস্ট। পিএসজির সাফল্য আর দেম্বেলের ব্যক্তিগত সাফল্যের মধ্যে বিশেষ একটা যোগসূত্র আছে।
গত বছরের ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত চ্যাম্পিয়নস লিগে পিএসজির জয় ছিল মাত্র একটি, ড্রও একটি। কিন্তু হার ৫টি। আর এমন দুরবস্থার কারণেই সরাসরি চ্যাম্পিয়নস লিগের শেষ ষোলোয় জায়গা করতে পারেনি পিএসজি, খেলতে হয়েছে প্লে-অফে। আর শেষ ষোলোর জন্য প্লে-অফে খেলতে হওয়া দলটিই যে মে মাসের শেষ রাতে প্রথমবারের মতো ইউরোপসেরার ট্রফি হাতে তুলেছে, তাতে ছিল শেষ ১২ ম্যাচের ১০টিতেই জয় আর প্রতিপক্ষের জালে ৩৫ গোলের দুর্দান্ত পথচলা।
আর এ সময়েই দেম্বেলে ছিলেন সেরা ছন্দে। টানা দুই হ্যাটট্রিক করেছেন স্টুটগার্ট ও ব্রেস্তের বিপক্ষে, গোল করেছেন ম্যানচেস্টার সিটি, লিভারপুল আর আর্সেনালের বিপক্ষেও। ফরাসি ক্লাব ইতিহাসের প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে চ্যাম্পিয়নস লিগের এক আসরে সর্বোচ্চ ১২ গোলে অবদান রেখে হাতে মৌসুম সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারও।
এবার নজর দেওয়া যেতে পারে দেম্বেলে কী কী কারণে ব্যালন ডি’অর নাও পেতে পারেন। ভোটটা দেবেন সংবাদকর্মীরা। ইউরোপিয়ান স্পোর্টস মিডিয়া (ইএসএম) প্রতি মাসের সেরা খেলোয়াড়ের রেটিং করে থাকে। দেম্বেলে সেরা হয়েছেন মাত্র একটি মৌসুমে। দেম্বেলের জেতা লিগ আঁ ট্রফিকে অনেকে বিশেষ গুরুত্ব নাও দিতে পারেন। কারণ, পিএসজি লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ১৯ পয়েন্ট ব্যবধানে এগিয়ে থেকে, মানে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঝাঁজ বলতে গেলে ছিলই না।
পারফরম্যান্স মূল্যায়নে কে কত মিনিট মাঠে ছিলেন, সেটাও বিবেচ্য। এ ক্ষেত্রে দেম্বেলে লিগ ও মহাদেশীয় প্রতিযোগিতায় খেলেছেন ২৯০০ মিনিটের মতো, যেখানে কারও চার হাজারের বেশি মিনিটও আছে। আর পিএসজির মৌসুম-সাফল্যে আশরাফ হাকিমি ও দেজিরে দুয়ের অবদানও আছে উল্লেখ করার মতো।
এর বাইরে ক্লাব বিশ্বকাপ ফাইনালে ভালো না করার বিষয়টিও কারও কারও ভাবনায় থাকতে পারে। কম আলোচিত আরেকটি বিষয়ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। যেখানে ভোটাভুটি, সেখানে ভোট কাটাকাটিও হয়। ব্যালন ডি’অরে বার্সেলোনা ও রিয়াল মাদ্রিদের মনোনীতরা সব সময়ই বিশেষ মনোযোগ পেয়ে থাকেন, এ দুই ক্লাবের খেলোয়াড়েরা ভোটও পেয়ে থাকেন বেশ ভালো পরিমাণে। এবার বার্সেলোনা থেকে লামিনে ইয়ামাল ও রাফিনিয়া আর রিয়াল মাদ্রিদ থেকে কিলিয়ান এমবাপ্পে পিএসজির দেম্বেলের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারেন। কাটতে পারেন ভোটও। সব মিলিয়েই দেম্বেলের ব্যালন ডি’অর জয় যতটা সহজ ভাবা হচ্ছে, বাস্তবে ততটা নয়।
সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন দেম্বেলের প্রতিদ্বন্দ্বী কারা?
গোলে অবদান বিবেচনা করলে মোহাম্মদ সালাহ একজন। লিভারপুলের এই মিসরীয় তারকা মোট ৪৭টি গোলে অবদান রেখেছেন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অবদান যার, সেই হ্যারি কেইন ১৩ গোল পেছনে। সালাহ লিভারপুলের হয়ে জিতেছেন প্রিমিয়ার লিগও। পুরো মৌসুমে শীর্ষ পাঁচ লিগের খেলোয়াড়দের মধ্যে ইএসএমের সর্বোচ্চ ৪৩ ভোট পেয়েছেন সালাহ।
আবার বড় মঞ্চের পারফরম্যান্স বিচার করলে সামনে চলে আসেন রাফিনিয়া। বার্সেলোনার এই ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ড এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগে করেছেন সর্বোচ্চ ১৩ গোল। সব মিলিয়ে মৌসুমে ৩৪ গোল ও ২৫ অ্যাসিস্ট।
একই দলের লামিনে ইয়ামালও খুব পিছিয়ে নন। ১৮ বছর বয়সী এই তরুণ মৌসুমজুড়ে করেছেন ১৮ গোল ও ২৫ অ্যাসিস্ট। ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ লিগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অ্যাসিস্ট, লিগে সবচেয়ে বেশি সফল ড্রিবল, ম্যাচপ্রতি সবচেয়ে বেশি ড্রিবল—সবই ইয়ামাল। মাঝে স্পেন জাতীয় দলের হয়ে উয়েফা নেশনস লিগের ফাইনালেও খেলেছেন। স্পেন যদি পর্তুগালের কাছে না হারত, তবে ইয়ামালের নাম এখনকার চেয়ে আরও জোরালোভাবেই উচ্চারিত হতো।
তবে এর বাইরেও আশরাফ হাকিমি, হ্যারি কেইনরা যদি শীর্ষ পাঁচের আলোচনায় চলে আসেন তাহলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। দিন শেষে ব্যালন ডি’অর ভোটেরই খেলা, যেখানে উল্টেপাল্টে যেতে পারে যেকোনো কিছুই।