জিদানের সেই বিখ্যাত (কিংবা কুখ্যাত) ঢুস: আসলে যা ঘটেছিল

মাতেরাজ্জিকে ঢুস মারছেন জিদান! বার্লিনে ৯ জুলাই ২০০৬ বিশ্বকাপ ফাইনালে জিদানের এই পাগুলে কাণ্ড নিয়ে কতজন কত কী লিখেছেন! বিতর্কিত সেই কাণ্ড নিয়ে পরে নানা সময় কথা বলেছেন দুজনই। ১৯ বছর পর আরও একবার ফিরে দেখা যাক সেই ঘটনা।

মাতেরাজ্জিকে ঢুস মারছেন জিদান! বার্লিনে ৯ জুলাই ২০০৬ বিশ্বকাপ ফাইনালেএএফপি

বিশ্বকাপ বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে কত আনন্দ-বেদনার ছবি। তেমনি একটি ছবি চিরদিনের জন্য ঠাঁই পেয়ে গেছে ফুটবল ইতিহাসের অ্যালবামে। ২০০৬ বিশ্বকাপ ফাইনালের দুই গোলদাতা যে ছবির দুটি চরিত্র। জিনেদিন জিদান ও মার্কো মাতেরাজ্জি। না, গোলের কারণে নয়, ছবিটা বিখ্যাত বা কুখ্যাত হয়ে আছে বিশ্বকাপে অভূতপূর্ব ও অভাবনীয় একটা ঘটনার কারণে। মাতেরাজ্জিকে ঢুস মারছেন জিদান! বার্লিনে ৯ জুলাই ২০০৬ বিশ্বকাপ ফাইনালে জিদানের এই পাগুলে কাণ্ড নিয়ে কতজন কত কী লিখেছেন! রচিত হয়েছে গল্প-কবিতা, গড়া হয়েছে ভাস্কর্যও। অনেকের মতে, সেই ঢুসেই শেষ হয়ে গিয়েছিল ফ্রান্সের দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ জেতার আশাও।

দায়টা কেউ দেন জিদানকে, কারও কাছে ভিলেন মাতেরাজ্জি। বিতর্কিত সেই কাণ্ড নিয়ে পরে নানা সময় কথা বলেছেন দুজনই। ১৯ বছর পর আরও একবার ফিরে দেখা যাক সেই ঘটনা।

আরও পড়ুন

জিনেদিন জিদান যা বলেছেন

মাতেরাজ্জি আমার জার্সি ধরে টানছিল। আমি ওকে বললাম, যদি সত্যিই সে জার্সিটা নিতে চায়, ম্যাচ শেষে আমি দিয়ে দিতে পারি। তখন সে কিছু বাজে কথা বলা শুরু করল। আমিও তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখালাম।
কেউ যখন আপনার মা-বোনকে নিয়ে অপমানজনক কথা বলবে, আপনি একবার-দুবার না শোনার ভান করে থাকতে পারেন। কিন্তু তৃতীয়বার কেউ যদি একই কাজ করে, তখন প্রতিক্রিয়া দেখানোটাই স্বাভাবিক।
আমি তো আগে একজন মানুষ, তারপর ফুটবলার। আর কিছু কথা এমন, যা যেকোনো মানুষের পক্ষে হজম করা কঠিন। কিছু কথা আছে, যা মানুষকে ভীষণ আঘাত করতে পারে। এমন সব কথা যেটা শুনলে মনে হবে, ওর মুখে ঘুষি মেরে দিই।

জিদানের ঢুস, মাতেরাজ্জির পড়ে যাওয়া এবং জিদানের লাল কার্ড দেখা
উইকিপিডিয়া

হ্যাঁ, আমার আচরণ মনে হয় সঠিক ছিল না। কিন্তু এমন আচরণের পেছনে তো প্ররোচনাও ছিল। আমি ক্যারিয়ারে যতবার লাল কার্ড দেখেছি, সবই ওই রকম পরিস্থিতিতে, প্রতিক্রিয়া দেখাতে গিয়ে। আমার মনে হয়, যে মানুষটা এমন আচরণের প্ররোচনা দেয়, সে-ই সবচেয়ে নিকৃষ্ট, আসল দোষী। রেফারির ভুল সিদ্ধান্তে ভুল মানুষটা শাস্তি পাচ্ছে—এমন তো আর কম হয়নি আমার সঙ্গে। একবার ভাবুন তো, বিশ্বকাপের ফাইনালে, আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শেষ করার মাত্র ১০ মিনিট আগে আমার ইচ্ছা হয়েছিল বলে আমি ওই রকম আচরণ করব? অবশ্যই না।

২০০৬ বিশ্বকাপ জিততে না পারলেও গোল্ডেন বল জিতেছিলেন জিদান
এএফপি

যা করেছি তার জন্য আমি গর্বিত নই, কিন্তু একই সঙ্গে ওই আচরণের জন্য আমি অনুতপ্তও নই। কারণ, অনুতপ্ত হওয়া মানে স্বীকার করা যে মাতেরাজ্জি যেটা করেছিল, সেটা ঠিক। আমার পক্ষে সেটা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।
ফুটবল মাঠে সম্ভবত এটাই আমার সবচেয়ে বাজে সময়। যেভাবে আমি ক্যারিয়ারটা শেষ করেছি, সেটা আসলেই মেনে নেওয়া কঠিন। অবসর নেওয়ার পর প্রায় এক বছর এমন একটা সমাপ্তি আমাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে।

আরও পড়ুন

মার্কো মাতেরাজ্জি কী বলেছেন

মার্কো মাতেরাজ্জি
এএফপি

জিদানের ঢুস? ওটা আমি একদমই কল্পনা করিনি। পুরো ঘটনাটা এত হঠাৎ ঘটেছিল যে আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি। ভাগ্য ভালো। কারণ, যদি আগে থেকে আঁচ করতে পারতাম, তাহলে হয়তো দুজনেই লাল কার্ড খেতাম।
বক্সের ভেতর আমাদের একটু ধাক্কাধাক্কি হচ্ছিল। ম্যাচের প্রথমার্ধেই জিদান গোল করেছিল। আমাদের কোচ মার্সেলো লিপ্পি আমাকে বললেন, যেন ওকে (জিদানকে) ভালোভাবে মার্ক করি। তারপর বেশ কয়েকবার ওর সঙ্গে আমার ধাক্কাধাক্কি হয়। প্রথমবার ধাক্কা লাগার পরই আমি দুঃখ প্রকাশ করেছিলাম। কিন্তু জিদান খারাপভাবে সেটার প্রতিক্রিয়া দেখায়।
তৃতীয়বার ধাক্কাধাক্কির সময় আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। জিদান আমাকে বলল, ‘তোমার যদি আমার জার্সি দরকার হয়, ম্যাচের পরে এসো, দিয়ে দেব।’ আমি বললাম, ‘জার্সির চেয়ে তোমার বোনকেই আমার বেশি পছন্দ।’

কথাটা আসলেই নির্বোধের মতো হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এমন প্রতিক্রিয়া পাওয়ার মতো ছিল না। রোম, নেপলস, তুরিন, মিলান বা প্যারিসের যেকোনো পাড়ায় এর চেয়ে অনেক বাজে কথা রোজ শুনি।
অনেক পত্রিকায় লেখা হয়েছে আমি নাকি ওর মাকে নিয়ে বাজে কথা বলেছিলাম। আমি ওর মাকে নিয়ে কিছুই বলিনি। আমি যখন খুব ছোট, তখনই আমার মা মারা গিয়েছিলেন। আমি কোনো দিন কারও মাকে নিয়ে বাজে কথা বলিনি, বলব না।

আরও পড়ুন

পাঠকের জন্য তথ্য

ম্যাচের অতিরিক্ত সময়ে, ১১০তম মিনিটে, জিদান যখন মাতেরাজ্জিকে ঢুস দেন, তখন ১-১ সমতা চলছে। ওই ঘটনার পরপরই রেফারি লাল কার্ড দেখিয়ে মাঠ থেকে বের করে দেন জিদানকে। পরে ম্যাচ গড়ায় টাইব্রেকারে। আর সেই টাইব্রেকারে ৫-৩ গোলে ফ্রান্সকে হারিয়ে ইতালি বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয় চতুর্থবারের মতো। জিদান সেই বিশ্বকাপে দুর্দান্ত খেলেছিলেন, পেয়েছিলেন ‘গোল্ডেন বল’। হয়তো সেই মুহূর্তে মাথা গরম না করলে ফ্রান্সকে আরও একবার বিশ্বকাপও জেতাতে পারতেন।

কাতারের দোহায় জিদানের সেই ঢুস-কাণ্ডের ভাস্কর্য
এএফপি

ওই ঘটনার পরে সমালোচনার মুখে পড়া জিদানের পাশে দাঁড়ান ফ্রান্সের তখনকার প্রেসিডেন্ট জ্যাক শিরাক। বলেন, জিদান একজন ভালো মনের মানুষ। তাঁর মতে জিদানের ঢুসটা ছিল উসকানির ফল।
ঘটনার পর করা এক জরিপে দেখা যায়, ফরাসি জনগণের ৬১ শতাংশ জিদানের প্রতি সহমর্মী। তবে ফরাসি পত্রিকা লা ফিগারো এ ঘটনাকে ঘৃণ্য ও অগ্রহণযোগ্য বলে মন্তব্য করে।
ঘটনার তদন্তের পর ফিফা জানায়, জিদানকে লাল কার্ড দেখানো রেফারি এলিজন্দোর সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। তবে ফিফা মাতেরাজ্জিকে ৫ হাজার সুইস ফ্রাঁ জরিমানা ও দুই ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধ করে। জিদানকে সাড়ে ৭ হাজার সুইস ফ্রাঁ জরিমানা ও তিন ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। যেহেতু এর আগেই জিদান অবসর নিয়ে ফেলেছিলেন, তাই তিনি ওই নিষেধাজ্ঞার বদলে ফিফার পক্ষে তিন দিন কমিউনিটি সার্ভিস করেন।

আরও পড়ুন