নেইমারের মাঠে গড়াগড়ি খাওয়া শুধুই কি অভিনয়

সার্বিয়ার বিপক্ষে এভাবেই ফাউলের শিকার হন নেইমারছবি: রয়টার্স

রবীন্দ্রনাথের গল্পে কাদম্বিনীকে মরিয়া প্রমাণ করিতে হইয়াছিল যে, সে মরে নাই। নেইমার দা সিলভা সান্তোস জুনিয়রকেও গ্রুপপর্ব থেকে ছিটকে গিয়ে প্রমাণ করতে হলো, মাঠে শুয়ে তাঁর ব্যথায় কাতরানোর পুরোটাই অভিনয় নয়।

তা ছিটকে পড়াটা শুধু গ্রুপপর্ব থেকেই তো! কে বলতে পারে! সার্বিয়ার বিপক্ষে ম্যাচের পর ব্রাজিলের কোচ তিতে সবাইকে আশ্বস্ত করতে চেয়েছিলেন। পরে বোঝা গেল, তিনি যা বলেছেন, তা আশাবাদের কথা। ব্রাজিল দলের ডাক্তার রদ্রিগো লাসমারের বিবৃতি তাই তিতের কথার সঙ্গে মিলল না। ডাক্তার যে শুধু ফুলে ঢোল নেইমারের অ্যাঙ্কেলই দেখেছেন, তাঁকে ঘিরে আবেগ-উন্মাদনা নয়।

প্রথমে সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে আগামীকালের ম্যাচটাতেই থাকছেন না বলে জানা গিয়েছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্যামেরুনের বিপক্ষে গ্রুপের শেষ ম্যাচে খেলাও ঢাকা পড়ে গেল সংশয়ে। ব্রাজিলিয়ান সাংবাদিকদের সূত্রে সর্বশেষ যা খবর, তাতে নেইমার দ্বিতীয় রাউন্ডে ফিরতে পারলেই এখন মহাখুশি তিতে।

ব্রাজিলিয়ান সাংবাদিকদের সূত্রে সর্বশেষ যা খবর, তাতে নেইমার দ্বিতীয় রাউন্ডে ফিরতে পারলেই এখন মহাখুশি তিতে
ছবি: রয়টার্স

ব্রাজিলের দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠা নিয়ে কোনো সংশয় নেই। এক ম্যাচ জেতাটা অবশ্যই নকআউট পর্বে যাওয়ার নিশ্চয়তা নয়। সেই নিশ্চয়তা আসলে ইতিহাস। ১৯৩০ ও ১৯৩৪ প্রথম দুটি বিশ্বকাপের পর ব্রাজিল মাত্র একবারই প্রথম পর্ব পেরোতে পারেনি। সেটিও ১২ বিশ্বকাপ আগে। ১৯৬৬ ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে ইউরোপ একজোট হয়ে ব্রাজিলের পেছনে লেগেছিল। আগের দুটি বিশ্বকাপ জিতেছে ব্রাজিল, এবার যেন কিছুতেই হ্যাটট্রিক না হয়। ব্রাজিল মানে তখন অনেকটাই পেলে। মূল টার্গেট ঠিক করতে তাই কোনো সমস্যাই হয়নি। বুলগেরিয়া ও হাঙ্গেরি ড্রেস রিহার্সাল দিয়ে রাখার পর শেষ গ্রুপ ম্যাচে পর্তুগিজরা বাকি কাজটা সম্পন্ন করে। অন্য দুজনের কাঁধে ভর দিয়ে বেরিয়ে যেতে হয় পেলেকে। ব্রাজিলকেও বিশ্বকাপ থেকে।

এবার সার্বিয়া এমন কোনো পরিকল্পনা করে নেইমারের পেছনে লেগেছিল মনে করাটা বাড়াবাড়ি হবে। তবে ঘটনা তো এটাই যে, ৭৯ মিনিটে উঠে যেতে বাধ্য হওয়ার আগেই ৯ বার সার্বিয়ানদের ফাউলের শিকার হয়েছেন নেইমার। ব্রাজিলের বিপক্ষে মোট ফাউলই হয়েছে যেখানে ১২টি। নেইমারের বিশ্বকাপকে অনিশ্চয়তায় ঢেকে দেওয়া বেপরোয়া ট্যাকলের কারণে নিকোলা মিলেনকোভিচকে কোনো কার্ড পর্যন্ত দেখতে হয়নি।

আরও পড়ুন

রাশিয়া বিশ্বকাপে নেইমারের মাঠে গড়াগড়ি খাওয়া নিয়ে কতরকম মিমই না বের হয়েছিল! পরে নেইমারও স্বীকার করেছিলেন, কখনো কখনো একটু বেশিই করে ফেলেছেন। সেই স্বীকারোক্তি আবার স্পনসর জিলেটের ব্যানারে ছিল বলে সহানুভূতির পরিবর্তে সমালোচনাই জুটেছিল বেশি। তবে পরিসংখ্যান তো এটাও জানায় যে, সেই বিশ্বকাপে ৫ ম্যাচে ২৬ বার ফাউল করা হয়েছে নেইমারকে। এই বিশ্বকাপের আগেই যেমন একটা হিসাব দেখছিলাম। ইউরোপের শীর্ষ লিগগুলোতে ২০২২-২৩ মৌসুমে সবচেয়ে বেশিবার ফাউলের শিকারও নেইমার। সংখ্যাটা ৬৬। কাতার বিশ্বকাপেও যন্ত্রণাকর এই রেকর্ডটা এরই মধ্যে নেইমারের।

সার্বিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে অ্যাঙ্কেলে চোট পেয়েছেন নেইমার
ছবি: রয়টার্স

নতুন কিছু নয়, বল প্লেয়াররা যুগে যুগেই এমন মারধোরের কবলে পড়ে আসছেন। তবে নেইমারেরও ‘সমস্যা’ আছে। যদিও সেই ‌‘সমস্যা’র কারণেই তাঁর খেলা দেখতে মজা! নেইমারের খেলার ধরনে বাড়তি একটা কিছু আছে, যা ফাউল করতে প্ররোচিত করে। বল নিয়ে তাঁর কারিকুরিতে কখনো বিরক্ত, কখনো বিব্রত, কখনো বা অপমানিত হয়ে প্রতিপক্ষ শরীরে পা চালিয়ে দেয়। ২০১৪ বিশ্বকাপে যদিও ঘটনা তা ছিল না। দৌড়ে এসে নেইমারের পিঠে হাঁটু চালিয়ে দিয়েছিলেন কলম্বিয়ার জুনিগা। নেইমারের বিশ্বকাপ শেষ হয়ে যায় সেখানেই, পরের ম্যাচেই ব্রাজিলেরও।

নিজের দেশে বিশ্বকাপ, সেটির এমন করুণ সমাপ্তি! নেইমারের সঙ্গে কাঁদতে দেখেছি পুরো ব্রাজিলকেই। ২০১৮ বিশ্বকাপে এসেছিলেন আধা ফিট হয়ে। বছরের শুরু থেকেই ভুগছিলেন চোটে। সেরা ফর্মের নেইমারকে তাই পায়নি সেই বিশ্বকাপ। এবার পাওয়ার কথা ছিল। ব্রাজিলের প্রথম ম্যাচের আগে অধিনায়ক থিয়াগো সিলভা জানিয়েছিলেন, এবার চোট-টোট কিচ্ছু নেই। নেইমারকে এত ভালো অবস্থায় কখনো দেখেননি।

২০১৪ বিশ্বকাপে নেইমার ২২ বছরের তরুণ। ফুটবল-পাগল এক দেশের প্রত্যাশা পূরণের পুরো ভার তাঁর ওপর। ২০১৮-তে পুরো ফিটই নন। বয়স-অভিজ্ঞতা সবকিছু মিলিয়ে এই বিশ্বকাপটা নিজের করে নেওয়ার বড় সুযোগ ছিল নেইমারের। আগের মতো ব্রাজিল দল আর নেইমার-সর্বস্ব নয়, এটাও তো পক্ষে ছিল তাঁর। এই ব্রাজিল দলে প্রতিভার প্রাচুর্য। সার্বিয়ার বিপক্ষে বদলি যে তিনজন মাঠে নেমেছেন, সেই রদ্রিগো-জেসুস-আন্তনিই যেমন বিশ্বের অন্য প্রায় সব দলেই হেঁটে হেঁটে প্রথম একাদশে ঢুকে যাবেন। এই বিশ্বকাপ তাই নির্ভার নেইমারের সেরা রূপটা দেখার অপেক্ষায় ছিল।

ফুলে গেছে নেইমারের অ্যাঙ্কেল
ছবি: রয়টার্স

মেসি-রোনালদোর মতো তিনিও বিশ্বকাপ ছাড়া সবকিছুই জিতেছেন। ব্রাজিলের জন্য মরীচিকা হয়ে থাকা অলিম্পিক ফুটবলের সোনাও ধরা দিয়েছে তাঁর পায়েই। তবে এর সবই তো দলীয় অর্জন।

অনেক বছর ধরে যে মেসি-রোনালদোর কথা বলার পর একটু বিরতি দিয়েই উচ্চারিত হয়েছে তাঁর নাম, তাঁদের গণ্ডা গণ্ডা ব্যালন ডি’অর। নেইমারের যা একবারও জেতা হয়নি। এই বিশ্বকাপে এসেছেন পেলের চেয়ে মাত্র দুই গোল কম নিয়ে। ব্রাজিলের পক্ষে সবচেয়ে বেশি গোলের রেকর্ড হয়ে যাওয়াটা চোট পাওয়ার আগে অবধারিত বলেই মনে হচ্ছিল। সঙ্গে বিশ্বকাপটাও জিতে গেলে ব্যালন ডি’অর-ও হয়তো অধরা থাকত না।

গাছে কাঁঠাল, গোঁফে তেলের মতো হয়ে যাচ্ছে নাকি! তেমন মনে হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। ‌‘গাছের কাঁঠাল’ অবশ্য এখন আরও মগডালে। ফিরবেন কি ফিরবেন না—এই সংশয় ঘুচিয়ে যদি ফেরেনও, সঙ্গে সঙ্গেই ছন্দে ফিরতে পারাটা সহজ কথা নয়। ফেসবুক পোস্টে নেইমার অবশ্য নিজেকে ‌‘অসম্ভবের যে ঈশ্বর আছে, তার সন্তান’ বলে ঘোষণা করেছেন। তাহলে তো তাঁর পক্ষে সবই সম্ভব।

সম্ভব ব্রাজিলকে বিশ্বকাপটা জিতিয়ে ব্রাজিলিয়ানদের সর্বজনীন ভালোবাসা পাওয়াও। যাদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটা বরাবরই অম্লমধুর। ব্রাজিলিয়ানরা নেইমারকে ভালোবাসে, আবার তাঁর তীব্র সমালোচকও। চোট নিয়েও যেমন নিষ্ঠুর রসিকতা হচ্ছে। সতীর্থ রাফিনিয়া যা সহ্য করতে না পেরে পাল্টা জবাবও দিয়েছেন। নেইমারের ব্রাজিলে জন্ম না হলেই ভালো হতো, রাগে-ক্ষোভে বলেছেন এমন কথাও।

নেইমার কখনোই এমন বলেন না। ৩০ বছর বয়সেই জীবনের অনেক রং দেখে ফেলেছেন। বিশ্বকাপ নিয়ে দেশে ফিরতে পারলেই ব্রাজিলিয়ানদের হৃদয়ে অক্ষয় আসন পেয়ে যাবেন—এটাও তাঁর জানা। তার আগে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন অবশ্য অন্য। নেইমার ফিরতে পারবেন তো! নাকি তাঁর জন্য বিশ্বকাপ হয়ে থাকবে দীর্ঘশ্বাসের অন্য নাম!