কখনো আন্তর্জাতিক ফুটবল না খেলা বিশ্বের একমাত্র দেশের অবশেষে অভিষেক
অভিষেক ম্যাচে দেশটি ৪–০ গোলে হেরে গেছে। তবে ফলটা তাদের কাছে মুখ্য বিষয় নয়।
ফিফার র্যাঙ্কিং ধরে এগোলে ২১১টি নাম পাওয়া যাবে, যাদের বেশির ভাগই স্বাধীন–সার্বভৌম দেশ, কিছু আবার পরাধীন ভূখণ্ড। তবে স্বাধীন দেশ হয়েও সেই তালিকায় একটি নাম নেই—মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ।
থাকবে কী করে, মার্শাল দ্বীপপুঞ্জই যে ছিল বিশ্বের একমাত্র দেশ, যারা কখনোই আন্তর্জাতিক ফুটবল খেলেনি। অবশেষে তাদের অপেক্ষার পালা ফুরিয়েছে। ‘পৃথিবীর শেষ দেশ’ হিসেবে আন্তর্জাতিক ফুটবলে গত রাতে অভিষেক হয়েছে মার্শাল দ্বীপপুঞ্জের।
যুক্তরাষ্ট্রের আরকানসাস অঙ্গরাজ্যের স্প্রিংডেল হাইস্কুল স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ম্যাচে মার্কিন ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জের কাছে ৪–০ গোলে হেরেছে মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ। তবে ফলটা যে তাদের কাছে মুখ্য বিষয় নয়, তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেশটির ফুটবল ফেডারেশনের পোস্ট দেখলেই বোঝা যায়।
ম্যাচ শেষে দলীয় ছবি পোস্ট করে মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ সকার ফেডারেশন (এমআইএসএফ) লিখেছে, ‘স্কোর যাই হোক না কেন, যা অর্জন করেছি তাতে গর্বিত। আজ রাতে আমরা ইতিহাস সৃষ্টি করেছি।’
প্রশান্ত মহাসাগরের ছোট দ্বীপরাষ্ট্র মার্শাল দ্বীপপুঞ্জের জনসংখ্যা মাত্র ৪২ হাজার। ভৌগিলিকভাবে ওশেনিয়া মহাদেশের অন্তর্ভুক্ত দেশটি এখনো ফিফা ও ওশেনিয়া ফুটবল কনফেডারেশনের (ওএফসি) সদস্য হয়নি। এমআইএসএফ দেশটির জাতীয় অলিম্পিক কমিটির পাওয়ার জন্য কাজ করছে। ফেডারেশনটি বর্তমানে জাতীয় ফুটবল দল, জাতীয় ফুটসাল দল ও জাতীয় নারী দল পরিচালনা করছে।
‘আমরাই পৃথিবীর একমাত্র দেশ, যাদের ফুটবল দল নেই’—একসময় নিজেদের এভাবেই পরিচয় দিত এমআইএসএফ। মাত্র ৫ বছর আগে ফেডারেশনটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কয়েক বছর আগেও দেশটির কোনো স্বীকৃত ফুটবল দল ছিল না।
তবে ২০২২ সালে ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডশায়ারের বাসিন্দা ও সাবেক আধা–পেশাদার ফুটবলার লয়েড ওয়ার্স মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ ফুটবল দলের প্রযুক্তিগত পরিচালকের দায়িত্ব নিলে দৃশ্যপট পাল্টে যায়। ওয়ার্স দেশটি থেকে প্রতিভাবান ফুটবলার তুলে আনার কাজ করতে থাকেন। তাঁর দলে এমন খেলোয়াড়ও আছেন, যাঁদের কয়েকজন ঐতিহাসিক ম্যাচটির আগে কখনো ১১ জনের (ইলেভেন আ সাইড) ফুটবল খেলেননি।
এমআইএসএফের উদ্যোগেই নতুন প্রতিযোগিতা ‘আউটরিগার চ্যালেঞ্জ কাপ’-এর আয়োজন করা হয়েছে। চার দলের এই টুর্নামেন্টে মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ ও মার্কিন ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জ ছাড়াও অংশ নিচ্ছে টার্কস ও কাইকোস দ্বীপপুঞ্জ এবং স্থানীয় ওজার্ক ইউনাইটেড অনূর্ধ্ব–১৯ দল।
এই মুহূর্তে টার্কস ও কাইকোস দ্বীপপুঞ্জ ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে ২০৬ ও মার্কিন ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জ ২০৭ নম্বরে আছে। আসরের সব ম্যাচ হবে আরকানসাসের ৩ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতার স্প্রিংডেল হাইস্কুল স্টেডিয়ামে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের এই এলাকাতেই সবচেয়ে বেশি মার্শালিজ সম্প্রদায় বাস করে।
দল গঠনের প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর অভিষেক ম্যাচ খেলতে নামার আগপর্যন্ত মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ জাতীয় ফুটবল দলের খেলোয়াড়েরা মাত্র পাঁচবার একসঙ্গে অনুশীলন করার সুযোগ পেয়েছেন। দ্বীপটিতে ফুটসাল বেশ জনপ্রিয়।
কিন্তু ফুটবল এতটা পিছিয়ে থাকার কারণ ছোট্ট এই ভূখণ্ডে পূর্ণাঙ্গ ফুটবল মাঠের বড়ই অভাব। মাঝে মাঝে বাস্কেটবল কোর্টেও ফুটবল খেলতে হয়। দলের সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড়ের বয়স ১৫ বছর, সবচেয়ে বেশি বয়সীর চল্লিশের কোঠায়। বেশির ভাগ খেলোয়াড়ই যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন এবং শখের ফুটবল খেলেন।
ফিফার সদস্যপদ পেলে এমআইএসএফ মোটা অঙ্কের আর্থিক সহায়তা পাবে, যা দিয়ে মার্শাল দ্বীপপুঞ্জের ফুটবলে ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নত করা সম্ভব। তবে প্রথমে কোনো একটি মহাদেশীয় ফুটবল নিয়ন্ত্রক সংস্থার সদস্য হতে হবে।
ওএফসিতে যোগ দেওয়ার জন্য এমআইএসএফ আবেদন করলেও এখনো সাড়া মেলেনি। তাই কনকাকাফ (উত্তর, মধ্য আমেরিকা ও ক্যারিবীয় ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা) বা এএফসিতে (এশিয়ান ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা) যোগ দেওয়ার কথা ভাবছে তারা। দেশটির নারী ফুটবল দলও আগামী এক বছরের মধ্যে প্রথম আন্তর্জাতিক খেলার পরিকল্পনা করছে।
মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ দলের সহকারী কোচ জাস্টিন ওয়ালি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য টাইমসকে বলেছেন, ‘আমরা চাই এখানকার ফুটবল জনপ্রিয় হোক, বাচ্চারা খেলুক, তাদের জন্য রোল মডেল তৈরি হোক এবং একদিন আমরা ফিফার অংশ হই।’
মার্শাল দ্বীপপুঞ্জের অভিষেক ম্যাচ নিয়ে ওয়ালি বলেছেন, ‘এই মুহূর্তটা আমার জন্য সন্তান জন্মের মতো—খুব বিশেষ ও স্মরণীয়।’
আগামীকাল শনিবার দলটি ‘আউটরিগার চ্যালেঞ্জ কাপ’–এ নিজেদের পরের ম্যাচে টার্কস ও কাইকোস দ্বীপপুঞ্জের মুখোমুখি হবে।
মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ অস্ট্রেলিয়ার উত্তর-পূর্বের ২৫০০ মাইল দূরে অবস্থিত এবং ২৯টি প্রবাল দ্বীপ নিয়ে গঠিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র সেখানকার নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং ১৯৪৬ থেকে ১৯৫৮ সালের মধ্যে ৬৭টি পারমাণবিক পরীক্ষা চালায়। ১৯৭৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় দেশটির টিকে থাকা এখন হুমকির মুখে।