হিগুয়েইন সেই মিসগুলো না করলে আর্জেন্টাইন ফুটবলের ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো

২০১৮ বিশ্বকাপ শেষেই আর্জেন্টিনার জার্সি ছেড়েছেন হিগুয়েইন। কাল তাঁর অবসর ঘোষণার পর ফিরে ফিরে আসছে জাতীয় দলের হয়ে খেলার স্মৃতিছবি: টুইটার

‘অনেক কিছু দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ, পিপা!’

পুরো টুইটটি এমন, ‘আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের প্রতীক গঞ্জালো হিগুয়েইন ফুটবল থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন। অনেক কিছু দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ, পিপা!’

হিগুয়েইন কাল অবসর ঘোষণা করার পর তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে এই টুইট করা হয় আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে। ইন্টার মায়ামির মৌসুম শেষেই বুট তুলে রাখবেন ‘এল পিপিতা’। অবসরের ঘোষণার পর রিয়াল মাদ্রিদে তাঁর সাবেক কোচ জোসে মরিনিও ইনস্টাগ্রামে হিগুয়েইনের কাছে জানতে চেয়েছেন, ‘তুমি কি গোল করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছ?’

গোল তো ক্যারিয়ারে কম করেননি ৩৪ বছর বয়সী এই স্ট্রাইকার। আর্জেন্টিনার ইতিহাসে পঞ্চম (৩১) সর্বোচ্চ গোলদাতা, ইতালিয়ান সিরি ‘আ’-তে এক মৌসুমে সর্বোচ্চ গোল—বিদায়বেলায় এসব অর্জন সঙ্গী হবে হিগুয়েইনের। তবে মুদ্রার অপর পিঠও আছে।

মরিনিওর যেমন সন্দেহ, হিগুয়েইন গোল করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ায় অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন, তেমনি আর্জেন্টিনার সমর্থকেরাও কিন্তু জাতীয় দলের জার্সিতে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে তাঁর গোল মিসের মহড়া দেখে একসময় বিরক্ত বোধ করেছেন। ট্রল করেছেন। এমনকি কাল তাঁর অবসরের ঘোষণা নিয়েও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রসিকতা হয়েছে। সত্যিই সমর্থকমাত্রই পূজারি নয়, নিষ্ঠুরও!

২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনালে এই সুযোগ থেকেও গোল করতে পারেননি হিগুয়েইন। তাঁর সামনে ছিলেন শুধু গোলকিপার নয়্যার
ছবি: টুইটার

আবার গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে পছন্দের দলের খেলোয়াড়ের গোল মিসের কারণে সমর্থকদেরও কিন্তু মন ভেঙেছে। এদিক বিচারে খেলোয়াড়ের গোল মিস সমর্থকের জন্য নির্মম দুঃখও। হিগুয়েইনের কাছ থেকে এমন ‘দুঃখ’ বেশ ভালোই পেয়েছে আর্জেন্টিনার সমর্থকেরা।

রিয়াল মাদ্রিদ, নাপোলি, জুভেন্টাসে হিগুয়েইনের অর্জন কম নয়। তবু তাঁর নামটা উচ্চারিত হলে আর্জেন্টিনার সমর্থকদের মনে উঁকি মারে ২০১৪ বিশ্বকাপের ফাইনাল। হ্যাঁ, সেই মিসটা!

আরেকটু পেছন থেকে শুরু করা যায়। ২০১০ বিশ্বকাপে ৪ গোল করেছিলেন হিগুয়েইন। চার বছর পর ব্রাজিল বিশ্বকাপে তাঁকে অন্যতম সেরা স্ট্রাইকারদের কাতারেই রাখা হয়েছিল। তখন সবে রিয়াল মাদ্রিদ ছেড়ে যোগ দিয়েছেন নাপোলিতে।

সেই বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্ব ও শেষ ষোলোয় গোল পাননি। কিন্তু কোয়ার্টার ফাইনালে বেলজিয়ামের বিপক্ষে গোল করে আর্জেন্টিনাকে সেমিফাইনালে তুলেছিলেন। সেমিতে গোল পাননি, ডাচদের বিপক্ষে টাইব্রেকার জিতে ফাইনালে ওঠে আর্জেন্টিনা। এরপরই ১৯৮৬-র পর প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্নে বিভোর হন আর্জেন্টিনার সমর্থকেরা।

২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনালে এই সুযোগ থেকে হিগুয়েইন বল জালে পাঠালেও অফসাইডের কারণে গোলটি বাতিল হয়
ছবি: টুইটার

জার্মানির বিপক্ষে ফাইনালে প্রথমার্ধের ২০ মিনিটেই সমর্থকদের সেই স্বপ্ন আরও রঙিন হতে পারত। জার্মান সেন্টার ব্যাক ম্যাট হুমেলস একটা ভুল করে বসেন। বল ‘ক্লিয়ার’ করতে গিয়ে পেছনে হেড করেন, আর বলটা পেয়ে যান হিগুয়েইন। তখন সামনে শুধু জার্মানির গোলকিপার ম্যানুয়েল নয়্যার। অমন সুযোগ থেকে মোটামুটি মানের যেকোনো স্ট্রাইকারেরই গোল করার কথা। কিন্তু হিগুয়েইনের কী হয়েছিল কে জানে, বলটা ভলি করে পোস্টের বাইরে মারলেন!

পরে এজেকিয়েল লাভেজ্জির দুর্দান্ত ক্রস থেকে বল জার্মানির জালে পাঠিয়ে প্রায়শ্চিত্তের আনন্দে হিগুয়েইন দিগ্বিদিক ছুটলেও তাঁর দুর্ভাগ্য, অফসাইড! ১০ মিনিট পর নয়্যারকে আবারও একা পেয়ে যান এই স্ট্রাইকার। কিন্তু এবার তৎপর জার্মান গোলকিপার ঝাঁপিয়ে পড়ে ‘সেভ’ করেন এবং তাঁর হাঁটু গিয়ে লাগে হিগুয়েইনের মুখে। আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়েরা পেনাল্টির আবেদন করবেন কী, ম্যাচের রেফারি নিকোলা রিজ্জোলি উল্টো হিগুয়েইনকেই ফাউলের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করেন। বেচারা!

আট বছর আগের বিশ্বকাপ ফাইনালে সে গোল মিস ও অফসাইডের পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হিগুয়েইন ট্রলের শিকার হচ্ছেন। আর্জেন্টিনার সমর্থকেরাই তাঁকে নির্মম সব তকমা দিয়েছেন। ‘মিস মাস্টার’, ‘লর্ড অব অফসাইড’—এমন সব নামে তাঁকে আঘাত করেছেন, অবসর ঘোষণার পরও করছেন।

ব্রাজিলে সেই বিশ্বকাপ ফাইনাল আর্জেন্টিনা জিততে পারেনি। মারিও গোটসের গোলে ১-০ ব্যবধানের জয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় জার্মানি। অথচ হিগুয়েইন সে ম্যাচে দুটি মিস না করলে আর্জেন্টাইন ফুটবলের ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো। দেশের হয়ে বিশ্বকাপ জিততে না পারা লিওনেল মেসির অমরত্বও আরেকটু দৃঢ়তা পেত। গত বছর কোপা আমেরিকা জিতে দেশের হয়ে শিরোপা জয়ের খরা ঘোচানো মেসি আগেই এই সফলতা পেতেন, যদি...হ্যাঁ, আবারও হিগুয়েইনের গোল মিসের প্রসঙ্গ আসবে!

সেটি ব্রাজিল বিশ্বকাপ ফাইনালে হারের পরের বছর কোপা আমেরিকা ফাইনালে (২০১৫)। সান্তিয়াগোতে অনুষ্ঠিত সে ফাইনালে নির্ধারিত সময় গোলশূন্য ড্র ছিল আর্জেন্টিনা ও চিলি। অতিরিক্ত সময়ে বাঁ প্রান্ত থেকে লাভেজ্জির বাড়ানো বল ডানে একদম গোলপোস্টের কাছাকাছি পেয়ে যান হিগুয়েইন। ঠিক সময়ে পা ছোঁয়ালেই গোল হতো, কিন্তু সেকেন্ডের ভগ্নাংশ সময় দেরি করায় বল বাইরের জালে মারেন। পরে তো টাইব্রেকারে ৪-১ ব্যবধানের জয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় চিলি। টাইব্রেকারেও লক্ষ্যভেদ করতে পারেননি হিগুয়েইন।

পরের বছর যুক্তরাষ্ট্রে সেই কোপা আমেরিকারই শতবর্ষপূর্তির ফাইনাল, প্রতিপক্ষও সেই চিলি। এবার প্রথমার্ধে মাঝমাঠ থেকে বল পেয়ে এক ডিফেন্ডারকে পেছনে ফেলে বল পায়ে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যান হিগুয়েইন। সামনে শুধু চিলির গোলকিপার ক্লদিও ব্রাভো। প্লেসিং শটটা দারুণ নেন হিগুয়েইন। কিন্তু বলের গতিপথ ছিল বাঁ পোস্টের বাইরে। এবারও গোল হলো না! আর চিলিও সেই টাইব্রেকারেই ৪-২ গোল ব্যবধানে জয় তুলে নেয়। অর্থাৎ আর্জেন্টিনার তিন ফাইনালেই গোলের সুযোগ নষ্ট করেছেন হিগুয়েইন।

এই তিন ফাইনালে হিগুয়েইন যেসব সুযোগ নষ্ট করেছেন, অন্য কোনো সময় হয়তো একই জায়গা থেকে গোল করেছেন। হয়তো কী! রিয়াল, নাপোলি, জুভেন্টাস ও আর্জেন্টিনার জার্সিতেও দারুণ সব গোল আছে হিগুয়েইনের। তাঁর ক্লাব-ক্যারিয়ারও ঈর্ষণীয়।

রিয়ালে তিনবার জিতেছেন লা লিগা, নাপোলিতে জিতেছেন ইতালিয়ান কোপা ও ইতালিয়ান সুপারকাপ, তিনবার সিরি ‘আ’ জিতেছেন জুভেন্টাসের হয়ে, চেলসিতে জিতেছেন ইউরোপা লিগ। কিন্তু আর্জেন্টিনার হয়ে? কিছুই জিততে পারেননি। যথেষ্ট ভালো ক্যারিয়ার গড়েও জুটেছে শুধু তির্যক কটু কথা।

হিগুয়েইন যেসব সময় এসব সমালোচনা সহ্য করে এসেছেন, তা নয়। গত মাসেই বলেছেন, ‘জীবনের এমন একটা পর্যায়ে আছি , যখন প্রশংসা কিংবা সমালোচনা—কোনোটাই আগের মতো গায়ে মাখি না। কারণ, আর সব সতীর্থের মতো আমিও আমার দলের জন্য, দেশের জন্য জীবন বিলিয়ে দিয়েছি কিংবা জীবনের চেয়ে বেশি কিছু দিয়েছি। আর্জেন্টিনার হয়ে আমি যা করেছি, সে জন্য আমি গর্বিত, আক্ষেপের কিছুই নেই।’

আরও পড়ুন

এর মানে একটাই—কিছু জিতুন আর না জিতুন, আর্জেন্টিনা দলকে ৯ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে যা দিয়েছেন, তা নিয়ে গর্বিত হিগুয়েইন। কিন্তু তাঁর সেই অবদানে আর্জেন্টিনার সমর্থকেরা যে সন্তুষ্ট নন, সেটা তো ২০১৪ বিশ্বকাপের ফাইনাল আর ২০১৫ ও ২০১৬ কোপা আমেরিকার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পাতাগুলোই পরিষ্কার করে দিয়েছে। আর্জেন্টিনার সমর্থকেরা সন্তুষ্ট হবেনই–বা কী করে!

ওই তিনটি ফাইনালে হিগুয়েইন সুযোগগুলো কাজে লাগাতে পারলে আর্জেন্টাইন ফুটবলের ইতিহাস যে অন্যভাবে লেখা হতো! সেটা হয়নি বলে যে ক্ষতটা তাদের হৃদয়ে তৈরি হয়েছে, তা কি এত সহজে মুছে যাওয়ার মতো!