টনি ‘স্নাইপার’ ক্রুসকে কুর্নিশ ভিনিসিয়ুসের

গোলের পর মাথা নুইয়ে ক্রুসকে কুর্নিশ করছেন ভিনিসিয়ুসএএফপি

লোকে বলে, সারা মাঠ খেললেও তাঁর জার্সিতে এতটুকু ভাঁজ কিংবা ময়লা বোঝা যায় না। লোকে আরও বলে, অভিজাত ফুটবল খেলার যদি কোনো সংজ্ঞা থেকে থাকে, তবে সেটা টনি ক্রুস। ম্যাচের আগে চুলের ভাঁজ যা, শেষ বাঁশি বাজার পরও তাই!

টমাস টুখেল সেসব সাধারণ ফুটবলপ্রেমীর কাতারে পড়েন না। বায়ার্ন মিউনিখের এই কোচ মিউনিখে সেমিফাইনাল প্রথম লেগের আগে তাঁর শিষ্যদের কী বলে সতর্ক করেছিলেন জানেন? রিয়াল মাদ্রিদ কখন গোল করবে, সেটা বোঝা যায় না, অতএব খুব সাবধান!

আরও পড়ুন

টুখেলের এই কথার ব্যবহারিক দিকটাই গতকাল রাতে অ্যালিয়াঞ্জ অ্যারিনায় দেখিয়েছেন ক্রুস। ভিনিসিয়ুস সেই ‘ম্যাজিক’কে গোলে রূপান্তর করে জাদুকরকে মাথা নুইয়ে কুর্নিশও করলেন। অথচ ওই স্নাইপারের গুলির মতো নিখুঁত ওই পাসের আগে কে জানত, কিছুক্ষণের মধ্যেই গোল হবে!

টুখেল ঠিক এই ভয়টাই করেছিলেন। যখন মনে হবে খেলাটা নিয়ন্ত্রণেই আছে, কোনো বিপদ নেই, মাঝমাঠে রিয়াল পাত্তা পাচ্ছে না, তাই ভয়েরও কিছু নেই, একটু প্রেস করে খেলাই যায়—ঠিক তখনই হয়তো পাঁচ থেকে দশ সেকেন্ডের পাস চালাচালি এবং বল নিজেদের জালে! এই হলো রিয়াল—যাদের হার না মানার মানসিকতা এবং শূন্য সম্ভাবনা থেকে গোল করার যে ‘ডিএনএ’, ক্রুস তার ধারক ও বাহক। নইলে ম্যাচের ২৪ মিনিটে ‘জাদু’টা দেখা যেত না।

ক্রুসেরর কাছ থেকে গোল উপহার দিয়ে উদ্‌যাপন ভিনিসিয়ুসের
এএফপি

মঞ্চে জাদুকরদের সহকারী থাকেন। সেই সহকারীকে দিয়ে তাঁরা কাজটি করিয়ে নেন। ক্রুসও তা–ই, যেন হুডিনি কিংবা ডেভিড কপারফিল্ড। আর ভিনিসিয়ুস তাঁর সহকারী। এবার সেই ‘জাদু’টা একবার স্মরণ করা যাক।

আরও পড়ুন

মাঝমাঠ থেকে একটু সামনে ক্রুসের পায়ে বল। ইতস্তত দৌড়াচ্ছিলেন। বিপদের কোনো সম্ভাবনাই নেই। কিন্তু ততক্ষণে সবার চোখের অলক্ষ্যে একটি কাণ্ডও ঘটে গেছে—বায়ার্নের দক্ষিণ কোরিয়ান সেন্টারব্যাক কিম মিন-জায়ে ভিনিকে ‘মার্ক’ করছিলেন। বেচারা কিম বুঝতেই পারেননি ভিনি তাঁকে কৌশলে একটু ওপরে টেনে এনেছেন, তাতে ডান দিকের রক্ষণভাগটা বেশ ফাঁকা হয়ে যায়, বল পাস দেওয়ার মতো একটি ‘চ্যানেল’ও তৈরি হয়ে গিয়েছিল। ক্রুসের মতো বুদ্ধিদীপ্ত মিডফিল্ডার সেই চ্যানেল দেখবেন না, তা হয় না। তিনি কী করলেন, পাকা জাদুকরের মতো নজরবন্দী করলেন মাঠে থাকা সবাইকে—বাদ শুধু ভিনিসিয়ুস। বল পায়ে বারবার বা বাঁ দিকে তাকাচ্ছিলেন যেন সবার নজরটা সেদিকেই থাকে। শুধু ভিনির সঙ্গে কথা হয়েছে চোখে চোখে। আর পাসটি ছাড়ার আগে একদম নিশ্চিত হতে ব্রাজিলিয়ান তারকাকে একবার হাতের ইশারাও করেছেন—ওই দিকে (ডানে) দৌড়াও!

ভিনি দৌড় শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই কিম নিজের ভুলটা বুঝতে পারলেও ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ক্রুসের পা থেকে পরিপাটি ‘বুলেট’টি (পাস) যে বেরিয়ে গেছে। বাকিটা আপনি দেখেছেন। না দেখলে ইউটিউবে দেখে নিতে পারেন।

গোলটি দেখার পর এটাও দেখবেন, বল জালে পাঠিয়ে ভিনি কেমন পাগলের মতো দৌড়ে ক্রুসের ‘উপহার’-এর কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে তাঁর কাছে ছুটে গেলেন। জাদুকরকে সামনে রেখে মাথা নুইয়ে করলেন কুর্নিশ। শুধু ভিনি কেন, গ্যালারিতে কিংবা টিভির সামনে বসে থাকা দর্শকদের অনেকেই হয়তো মনে মনে সেটুকু সেরে নিয়েছেন। এই জিনিস যে প্রতিদিন দেখা যায় না, আর সেটা দেখাচ্ছেনও এমন কেউ, যাঁর বয়স ৩৪। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে একটি মজার পোস্টও ভেসে বেড়াচ্ছে, ‘প্রথম লেগে মাঠে দুই দলের সব খেলোয়াড়ের মধ্যে শুধু ক্রুসের মাথায়ই সম্ভবত অবসরের ভাবনাটা আছে। এটা পাগলামি! আমরা এই লোকটির ফুটবল খেলা বন্ধ করার অনুমতি দিতে পারি না।’

আরও পড়ুন

অনুমতি ভিনিও দেবেন না। পেছন থেকে (মাঝমাঠ) পরিপাটি সব পাসের প্রাচুর্যের রাস্তা কে বন্ধ দেখতে চায়! ম্যাচ শেষে ভিনি তাই প্রাপ্য অর্ঘ্যই দিলেন ক্রুসকে। জার্মান কিংবদন্তির খেলার ছন্দ ও বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মিল রেখে মুভিস্টারকে বলেছেন আসল কথাটা, ‘ক্রুস সব সময় কাজটা সহজ করে দেয়।’ চাইলে এই কথাকে আপনি ভাঙতে পারেন। ক্রুসের জায়গায় অন্য কেউ হলে সম্ভবত বলটা বক্সে ফেলতেন কিংবা উইংয়ে দিতেন, বল ধরে রেখে প্রতিপক্ষকে আরও ওপরে তুলে তারপর আক্রমণে উঠতে পারতেন—সাধারণ ও রুটিন আক্রমণগুলো যেভাবে হয় আরকি!

কিন্তু ক্রুসের চোখ-পা ‘স্নাইপার’–এর, সে জন্যই সম্ভবত গোলের গোপন রাস্তাটা দেখতে পেয়েছিলেন। আর তাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি কথাও ঘুরপাক খাচ্ছে। কথাটা ইতালিয়ান কোচ রবার্তো মানচিনি বলেছিলেন জাবি আলোনসোকে নিয়ে। সেই কথাই একটু ঘুরিয়ে বলছেন রিয়ালের সমর্থকেরা, যা ক্রুসের খেলার ধরনের সঙ্গে একদম খাপে খাপ, ‘বার্সা ৪০ পাসে যা করে, ক্রুস সেটি করে এক পাসেই।’

ভিনি তেমন একটি পাস থেকেই তো গোল উপহার পেলেন, ‘সে আমাকে গোলটা উপহার দিয়েছে। আমরা একসঙ্গে প্রচুর অনুশীলন করি। আমরা একে অপরকে খুব ভালো বুঝি। দুটি গোল করে খুব ভালো লাগছে। এখন ঘরের মাঠে আমাদের জাদুকরি এক রাত প্রয়োজন।’

আরও পড়ুন

মিউনিখে সেমিফাইনাল প্রথম লেগ ড্র হয়েছে ২-২ গোলে। আগামী বুধবার রাতে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে ফিরতি লেগ। ভিনি সেখানে জাদুকরি এক রাত চেয়ে রাখলেন। সেটি এনে দেওয়ার মতো লোক রিয়ালে কম নেই। কিন্তু গাঁটের পয়সা খরচ করে আপনি সম্ভবত ওই লোকটির জাদু দেখতে চাইবেন, যে খুব একটা দৌড়ায় না। কারণ, দৌড়ানোর জন্য ফেদে ভালভের্দে, এদুয়ার্দো কামাভিঙ্গা, অঁরেলিয়ে চুয়ামেনিরা আছেন। মাঝমাঠে দুলকি চালে খেলা সেই লোকের কাজ হলো, অন্যদের প্রচুর দৌড়ানোর মাঝে অদৃশ্য সব পাসের চ্যানেলকে বাস্তবে রূপান্তরিত করা। এটা তো জাদুই!

ভিনিসিয়ুসকে দিয়ে গোল করিয়ে উদ্‌যাপন ক্রুসের
এএফপি

সবচেয়ে মজার হলো, ক্রুস সেই জাদু কীভাবে দেখাচ্ছেন। আর্জেন্টাইন অলস সৌন্দর্যের প্রতিভূ হুয়ান রোমান রিকেলমে সেটা একবার ব্যাখ্যাও করেছিলেন—ক্রুস ফুটবলের রজার ফেদেরার, ‘সে মাঠে নামবে, খেলবে, তারপর গোসল ছাড়াই ঘরে ফিরবে। এতটুকু ঘামে না, শরীরে এতটুকু ময়লাও লাগে না, এমনকি তাকে পড়েও যেতে হয় না।’

তবু কীভাবে কীভাবে যেন সব হয়ে যায়! ক্রুস বলতে পারেন, এটাই তো অভিজাত ফুটবল!