মেসির ‘সবুজ’ থাকার কী ক্ষুধা, কেমন সেই ‘অমরত্ব’

পোর্তোর বিপক্ষে ফ্রি কিক নিচ্ছেন মেসি। গোল পেয়েছেনএএফপি

অমরত্ব দেখতে কেমন?

ফুটবলেরটি বলা যায়। প্রতিপক্ষ দলের বক্সের মাথায় যে ছোট্ট ‘ডি’, তাঁর নিশ্বাস লাগোয়া দূরত্বে বলটি বসানো। সেখান থেকে কয়েক পা দূরে দাঁড়িয়ে গোলাপি কিংবা আকাশি-সাদা জার্সি পরা ৩৭ বছর বয়সী রক্তমাংসের যে মানুষটি, তাঁর নাম হতে পারে ‘অমরত্ব’।

লোকে তাঁকে ডাকেন লিওনেল মেসি, কেউ কেউ শুধু মেসি। তাঁর অর্জনের ডালিতে তাকিয়ে কেউ কেউ হয়তো সংগোপনে ওই নামেও ডাকেন,‘ইম্মর্টাল’ কিংবা অমর!

ফুটবলে প্রায় এমন কোনো শিরোপা নেই, যা তাঁর নেই। বয়সের ডালপালা গজিয়ে ক্রমে মহিরুহ হয়ে এখন পাতাঝরার ঋতুতে নামলেও তবু তাঁর ‘সবুজ’ থাকার কী ক্ষুধা! এ সবুজ মানে তরতাজা, এ সবুজ মানে যত দিন সম্ভব সদ্য প্রস্ফুটিত ফুলের মতো টিকে থাকার নেশা। মানুষ এটাই চায়। পার্থক্য হলো, অন্যদের চাওয়াটা হয়তো নিজের জীবনকেন্দ্রীক, মেসির ফুটবলে।

আরও পড়ুন

আর তাই, তাঁর মাঠে নামার প্রতিটি দিনের ক্যানভাসেই নতুন নতুন ছবির জন্ম হয়। যেমনটা হলো গতকাল রাতে আটলান্টায় ক্লাব বিশ্বকাপের ম্যাচে। পোর্তোর বিপক্ষে তখন ১-১ গোলের সমতায় মায়ামি। ফ্রি–কিক (৫৩ মিনিট) পায় স্বাগতিকেরা। কে শটটি নিতে পারেন, সবার জানাই ছিল। বক্সের মাথায় ছোট্ট ‘ডি’-র সামনে বসানো বলটি থেকে কয়েক পা দূরে দাঁড়িয়ে মেসি যখন বুক ভরে শ্বাস নিচ্ছিলেন, সেই সময় অনেক দর্শকই হয়তো আন্দাজ করে নিয়েছিলেন, এরপর কী ঘটতে যাচ্ছে! দুই দশকের বেশি সময় ধরে এমন সব মুহূর্ত ও দৃশ্য তো তাঁদের পরিচিত।

তারপর সেই চিরায়ত বাঁ পায়ের কিক ও বলের ধনুকের মতো বাঁক নিয়ে জালে আশ্রয় নেওয়া—এ পরিচিত দৃশ্যের পর দেখা মিলল আরও এক চেনা দৃশ্যের। দুই হাত দুই দিকে ছড়িয়ে শিশুর মতো ছুট লাগালেন মেসি—এ পর্যন্ত এসে একটু পেছন ফিরে তাকাতে পারেন। সাফল্যের উপচে পড়া ডালি নিয়েই মায়ামিতে এসেছেন মেসি।

ক্যারিয়ারে চাওয়া-পাওয়া বলে তাঁর আর কিছুই থাকার কথা নয়। কিন্তু ওই যে সবুজ, তরতাজা হয়ে টিকে থাকার নেশা, যার পাল্লায় পড়ে এই জনারণ্যে সাধারণ ও অসাধারণের পার্থক্য গড়ি আমরা—সেই নেশায় ডুবেই এখনো গোল করে শিশুর মতো আনন্দে ছুট লাগান, দলের জয়ে চোখেমুখে ভর করে অন্য রকম এক দীপ্তি। অন্য চোখে তা আনন্দ, মেসিকে দেখার আনন্দ। আর যখন সবাই জানেন, এই আনন্দ আর বেশি দিন অবশিষ্ট নেই, তখন অবচেতন মনেই তাঁর সবকিছুকে অমরত্ব দেওয়া শুরু হয়। মাঠে তাঁর হাঁটা থেকে দৌড়, পাস থেকে ড্রিবলিং, শট থেকে সেটপিস—সবকিছু, সবকিছুই চিরকালীন ফ্রেম পেতে থাকে।

আরও পড়ুন

যেমন ধরুন, মেসির গোলে পোর্তোর বিপক্ষে মায়ামির জয়টি। পর্তুগিজ ক্লাবটি একসময়ের ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন। পর্তুগালের সবচেয়ে সফল দুটি (অন্যটি বেনফিকা) ক্লাবেরও একটি। ফুটবল দলীয় খেলা, তাই প্রতিপক্ষ দলে যতই মেসি থাকুন এ ম্যাচে পোর্তোর জয়ই ছিল প্রত্যাশিত। ধারে-ভারে কোথায় ৭ বছর আগে ফুটবল সেভাবে জনপ্রিয় নয়, এমন এক দেশে জন্ম নেওয়া এক ক্লাব, আর কোথায় ১৩১ বছর আগে জন্ম নেওয়া ৮৬টি বড় ট্রফিজয়ী ক্লাব!

এমন দুটি ক্লাবের মুখোমুখিতে ক্যারিয়ার সায়াহ্নে এসেও পার্থক্য গড়ে দিতে পারেন যিনি, সেটাও তরুণ বয়সে যেভাবে ছবির মতো সুন্দর ফ্রি–কিক নিয়েছেন, এই ভারী বয়সে এসেও ঠিক তেমন কিছুরই কার্বন কপি যিনি জন্ম দিতে পারেন, তাঁকে অমরত্ব না দেওয়াই তো অপরাধ! অবশ্য আমাদের দেওয়া না–দেওয়ায় তাঁর কিছু যায় আসে না। ইতিহাস তাঁকে সেই বরমাল্য দিয়েছে সম্ভবত ২০২২ বিশ্বকাপেই। এবার ক্লাব বিশ্বকাপেও হলো।

উত্তর ও মধ্য আমেরিকা এবং ক্যারিবিয়ান অঞ্চল মিলিয়ে কনক্যাকাফ কনফেডারেশনের প্রথম দল হিসেবে অফিশিয়াল ফিফা টুর্নামেন্টে ইউরোপিয়ান দলকে হারাল মায়ামি। এরপর এমন ঘটনা হয়তো আরও অনেকবারই ঘটবে, কিন্তু প্রথমবার তো কখনো মুছে ফেলা যাবে না। আর সেই প্রথমবার যিনি এই পার্থক্য গড়ে দিয়েছেন, তিনি এমনিতেই অমর।

আরও পড়ুন

যেমনটা এখন ফিফা টুর্নামেন্টেও। ফিফার সব টুর্নামেন্ট মিলিয়ে সর্বোচ্চ গোল এখন মেসির। এই পথে তিনি পেছনে ফেলেছেন ব্রাজিলের ‘স্কার্ট পরা পেলে’খ্যাত মার্তাকে। ছেলে ও মেয়েদের ফুটবল মিলিয়ে ফিফা আয়োজিত টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ গোল এখন মেসির। পোর্তোর জালে ফ্রি–কিক থেকে করা গোলটির মাধ্যমে মার্তাকে পেছনে ফেললেন মেসি। তাঁর গোলসংখ্যা ২৫, মার্তার ২৪।

ফিফার ১০টি টুর্নামেন্টে ৪০ ম্যাচে এ রেকর্ড গড়লেন মেসি। এ জন্য সময় লেগেছে তাঁর ২০ বছর। ২০০৫ সালে ফিফা অনূর্ধ্ব-২০ ছিল তাঁর প্রথম টুর্নামেন্ট। পাঁচটি বিশ্বকাপ মিলিয়ে মেসির গোলসংখ্যা ১৩। এবারসহ চারটি ক্লাব বিশ্বকাপ মিলিয়ে করলেন ৬ গোল এবং ফিফা অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপে একবার খেলে করেছেন ৬ গোল।

জানতে ইচ্ছা হতে পারে, ছেলেদের ফিফার সব টুর্নামেন্ট মিলিয়ে গোলে শীর্ষ পাঁচে মেসির পর অন্য চারজন কারা। উত্তর: রোনালদিনিও (১৯), রোনালদো নাজারিও (১৯), ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো (১৭) ও লুইস সুয়ারেজ (১৭)।

আর্জেন্টিনার সংবাদমাধ্যম ‘ক্লারিন’ জানিয়েছে, ফ্রি–কিক থেকে করা গোলেও একজনের পাশে বসেছেন মেসি। ব্রাজিলের ‘সাদা পেলে’খ্যাত জিকো, তাঁরও ফ্রি–কিক থেকে গোলসংখ্যা ৬৮। বিবিসি জানিয়েছে, ফ্রি–কিক থেকে সরাসরি গোলে মেসির চেয়ে এগিয়ে আছেন শুধু ব্রাজিলের দুজন—জুনিনিও (৭৭) ও পেলে (৭০)। তবে ক্লারিন আরও একজনের নাম জানিয়েছে এবং তিনিও ব্রাজিলিয়ান। করিন্থিয়ান্স কিংবদন্তি মার্সেলিনিও ক্যারিওকা। ব্রাজিল জাতীয় দলে (১৯৯৪-২০০১) চার ম্যাচ খেলা সাবেক এই অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার সরাসরি ফ্রি–কিক থেকে ৮০ গোল করেছেন। যদিও ক্লারিনের দাবি, তাঁর গোলসংখ্যা ৭৮।

ফ্রি কিক থেকে গোলের পর মেসির উদ্‌যাপন
এএফপি

সেটা যে সংখ্যাই হোক, চ্যালেঞ্জ যতই কঠিন হোক, মেসির সামনে সম্ভবত তা টিকে থাকবে না। ২০২৬ বিশ্বকাপের পর আর খেলবেন না—এমন গুঞ্জনকে এখনই সত্যি মেনে আশা করাই যায়, ফ্রি–কিক থেকে সরাসরি গোলেও অমরত্ব পেতে যাচ্ছেন মেসি। অবশ্য এ প্রসঙ্গে সেই পুরোনো কথাটিই ঘুরেফিরে আসে। অমরত্ব তো তাঁর নিশ্চিত হয়েছে আগেই। এখন যা করছেন, সেটা আসলে অমরত্বেরই জ্যোতি। যে আলোয় পুড়ে পর্তুগালের সাবেক ডিফেন্ডার জোসে ফন্তে ডিএজেডএন স্পোর্টসকে বলেছেন, ‘টাচড বাই গড, ইজন্ট হি?’

সৃষ্টিকর্তার স্পর্শধন্য তো সবাই। মেসির ক্ষেত্রে সম্ভবত একটু বেশিই। তা না হলে বল পায়ে মেসির দৌড় দেখে সমর্থকেরা বলতেন না, ওই দেখো, বল পায়ে ‘ঈশ্বর’দৌড়ান!